রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

ন্যানোটেকনোলজি এবং ন্যানোমেডিসিন

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
ন্যানোটেকনোলজি এবং ন্যানোমেডিসিন

ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর, মাইক্রো থেকে ন্যানোর দিকে এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চোখ। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির সহায়তায় গোটা বিশ্বকে যেমন নিয়ে আসা হচ্ছে আরও কাছাকাছি, তেমনি প্রযুক্তি আর পণ্যকেও করে তোলা হচ্ছে সূক্ষ্মতর। কম্পিউটারের ভেতরে থাকা ইলেক্ট্রনিক সার্কিট চিপ চোখে দেখা গেলেও এখন এটি এত সূক্ষ্ম হয়েছে যে, তা মানুষের মস্তিষ্ক এবং শরীরের পালসের মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে। ইলন মাস্কের কোম্পানি, নিউরোলিংক ইতোমধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কে মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস স্থাপন করে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

ইন্টারফেসটিতে একটি চিপ এবং ইলেক্ট্রোড অ্যারো রয়েছে, যাতে ১০০০ টিরও বেশি সুপারথিন, নমনীয় কন্ডাক্টর (ন্যানো সাইজের) থাকে। এই ইলেক্ট্রোডগুলো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেরিব্রাল কর্টেক্সে ঢোকানো হয়, যা মস্তিষ্কের গতি সম্পর্কিত চিন্তার জন্য দায়ী। অর্থাৎ মস্তিষ্কের সংকেতগুলোকে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে বোধগম্য করা এবং সেগুলোকে মানুষের ভাষায় প্রকাশ করাই নিউরোলিংকের লক্ষ্য। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহার কিভাবে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে চলছে গবেষণা।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, ন্যানোটেকনোলজির সফল প্রয়োগে চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ব্যবহার করবে সহজতর। দেহে কোনো কাটাছেঁড়া না করেই সারানো যাবে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক ব্যাধি। খাদ্যশস্যকে করা যাবে কয়েকগুণ পুষ্টিসমৃদ্ধ। হয়তো ন্যানোপুষ্টি সমৃদ্ধ এক কাপ খাবার খেলেই মানুষের দিব্যি কেটে যাবে সারাদিন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ন্যানো প্রযুক্তি ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মেডিক্যাল টুলসের পাশাপাশি চিকিৎসার ধরনেও। এখন রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নিরূপণে চিকিৎসকগণ আরও নিবিড় বিস্তারিত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগে উৎপাদিত ওষুধকে বলে ‘স্মার্ট ড্রাগ’। এগুলোর ব্যবহারে দ্রুত আরোগ্য লাভ হয়। ন্যানোফাইবার সার্জিক্যাল অপারেশনে শুধু অপারেশনকেই সহজ করছে তা নয়, রোগীদের অপারেশন উত্তর জটিলতা থেকেও রেহাই দিচ্ছে। চিকিৎসার প্রয়োজনে মানব দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ফেলতে হয়।

আবার কেউ কেউ জন্মগতভাবেই বিকলাঙ্গ হয়ে থাকেন। তাদের জন্য নিখুঁতভাবে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রতঙ্গ বানানো এবং ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে। ন্যানোমেডিসিন ন্যানোম্যাটেরিয়ালস এবং জৈবিক যন্ত্রের চিকিৎসা প্রয়োগ থেকে শুরু করে ন্যানোইলেক্ট্রনিক বায়োসেন্সর, এমনকি জৈবিক মেশিনের মতো আণবিক ন্যানোপ্রযুক্তির সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জৈবিক অণু বা কাঠামোর সঙ্গে ইন্টারফেস করে ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলোতে কার্যকারিতা যুক্ত করা যায়।

ন্যানোম্যাটেরিয়ালের আকার বেশিরভাগ জৈবিক অণু এবং কাঠামোর মতোই। তাই, ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলো ভিভো এবং ইনভিট্রো বায়োমেডিক্যাল গবেষণা এবং অ্যাপ্লিকেশন- উভয়ের জন্যই উপযোগী হতে পারে। জীববিজ্ঞানের সঙ্গে ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলোর একীকরণ ডায়াগনস্টিক ডিভাইস, বিপরীত এজেন্ট, বিশ্লেষণাত্মক সরঞ্জাম, শারীরিক থেরাপি অ্যাপ্লিকেশন এবং ওষুধ সরবরাহ বিকাশের অনেক গবেষণা আছে। ইন ভিভোর আক্ষরিক অর্থ ‘জীবন্তের মধ্যে’। ভিভো ইমেজিং কৌশলগুলো জীবন্ত প্রাণীর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং রোগগুলোকে অ-আক্রমণমূলকভাবে ট্র্যাক করতে এবং সময়ের সঙ্গে তাদের পর্যবেক্ষণে সহায়তা করে।

ন্যাশনাল ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে নতুন বাণিজ্যিক অ্যাপ্লিকেশন আশা করে। যাতে উন্নত ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা, নতুন থেরাপি এবং ভিভো ইমেজিং অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। উদীয়মান ন্যানোপ্রযুক্তির জন্য বৈশ্বিক অর্থায়ন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবছর ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘ন্যানোমেডিসিন’ দেবে চিকিৎসার নতুন নতুন উপায়, দিতে পারবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোষ মেরামত ও কোষ প্রতিস্থাপনের সুযোগও। এ প্রযুক্তি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য মলিকুলার টুলের সমন্বয়ে এক যন্ত্রবহর গড়ে তুলতে পারবে।

যার আকার হবে আমাদের দেহকোষের চেয়েও ছোট। সম্প্রতি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জয়েন্ট সেন্টার ফর বায়োএথিক্স’-এর একটি গবেষণাপত্রেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তি এবং ‘ন্যানোমেডিসিন’-এর প্রয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনেও অপরিহার্য মনে করা হয় এই প্রযুক্তিকে। কারণ, ভবিষ্যতে ক্যান্সার কোষ চিহ্নিত করতে ‘ন্যানোমেডিসিন’-এ ‘কোয়ান্টাম ডটস’ ব্যবহার করা হবে।

উল্লেখ্য, ‘ন্যানোস্কেল পার্টিকল বা ‘ন্যানোপার্টিকলস’ এর উদ্ভাবন করা হচ্ছে নতুন ড্রাগ ডিজাইনের জন্য। ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কোষে ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব। শুধু রোগাক্রান্ত অঞ্চলে সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যাল এজেন্ট জমা করার মাধ্যমে এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় ওষুধের সামগ্রিক ব্যবহার এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যেতে পারে। টার্গেটেড ড্রাগ ডেলিভারি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হয়। ফলে, সেবন ও চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস পায়।

উপরন্তু, টার্গেটেড ড্রাগ ডেলিভারি অশোধিত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস করে, যা স্বাস্থ্যকর কোষগুলোর অবাঞ্ছিত এক্সপোজার কমিয়ে দেয়। ওষুধের ডেলিভারি শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উভয় ক্ষেত্রেই জৈব উপলভ্যতাকে সর্বাধিক করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি ন্যানোইঞ্জিনিয়ারড ডিভাইসগুলোর দ্বারা আণবিক লক্ষ্যমাত্রা দ্বারা সম্ভাব্যভাবে অর্জন করা যেতে পারে।

চিকিৎসা প্রযুক্তির জন্য ন্যানোস্কেল ব্যবহার করার একটি সুবিধা হলো যে, ছোট ডিভাইসগুলো কম আক্রমণাত্মক এবং সম্ভবত শরীরের অভ্যন্তরে খুব সহজে এবং নিরাপদে স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়াও জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার সময়ও কম লাগে। এই ডিভাইসগুলো সাধারণ ওষুধ সরবরাহের চেয়ে দ্রুত এবং আরও সংবেদনশীল। ন্যানোমেডিসিনের মাধ্যমে ওষুধ সরবরাহের কার্যকারিতা মূলত (ক) ওষুধের দক্ষ এনক্যাপসুলেশন (খ) শরীরের লক্ষ্যবস্তু অঞ্চলে ওষুধের সফল বিতরণ এবং (গ) ওষুধের সফল মুক্তি।

পারমাণবিক বা আণবিক স্কেলে অতিক্ষুদ্র ডিভাইস তৈরি করার জন্য ধাতব বস্তুকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞানকে ন্যানোটেকনোলজি বলে। ন্যানো হলো একটি পরিমাপের একক। এটি কতটা ছোট তা কল্পনা করা কঠিন। ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগকে বলা হয় ১ ন্যানো মিটার (ন্যানো = একশো কোটি ভাগের এক ভাগ = ১দ্ধ১০-৯)। একটি মার্বেল যদি ন্যানোমিটার হয়, তবে পৃথিবীর আকার হবে এক মিটার। অন্যভাবে, একটি চুলের চল্লিশ হাজার ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এক ন্যানো। একটি ভাইরাসের আকৃতি হয় সাধারণত ১০০ ন্যানোমিটার। ফলে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম এককটিই হলো ন্যানো। সেজন্য ন্যানোস্কেলে তৈরি যে কোনো ডিভাইস হয় খুব ছোট, খুবই সূক্ষ্ম।

ন্যানোপার্টিকেল মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স (এমডিআর) মেকানিজমকে বাধা দিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ন্যানোপার্টিকেলগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করা বা বিভিন্ন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহারে কেমন সম্ভাবনা আছে, তা এখনো গবেষণার অধীনে রয়েছে। কারণ, ন্যানো এবং মাইক্রোসাইজড পদার্থের প্রতি জটিল হোস্টের প্রতিক্রিয়া এবং শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গগুলোকে লক্ষ্য করতে অসুবিধার কারণে ন্যানোপার্টিক্যালগুলোর জৈববণ্টন এখনো অসম্পূর্ণ।

এদের আকার, আকৃতি, বিষাক্ততা, পরিবেশগত প্রভাব এবং রোগের ধরন অনুযায়ী তৈরি এবং পরিবর্তিত হয়। এই কারণগুলো বিল্ড আপ এবং অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ, কিছু ন্যানোপার্টিক্যাল ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে দক্ষ, আবার কিছু কিছু নন-মেডিসিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের ন্যানো পার্টিক্যালগুলো দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। তবে এটি মানবদেহের অঙ্গের মধ্যে বিশেষত লিভার এবং প্লিহায় আটকে যায়, পরবর্তীতে সেগুলোকে ভেঙে ফেলা বা নির্গত করা যায় না। তবু ন্যানোপার্টিকুলেট সিস্টেমের সম্ভাব্যতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলোকে অপ্টিমাইজ করতে এবং আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য এখনো অনেক কাজ চলছে।

বিজ্ঞানের বড় আবিষ্কারগুলো যেমন আশীর্বাদ বয়ে এনেছে বিশ্বের জন্য, তেমনি ঘটেছে বিভিন্ন সময় নানা ধ্বংসাত্মক ঘটনা। ঘটেছে পারমাণবিক দুর্ঘটনা। আবার আণবিক বোমার অপব্যবহার। তাই ন্যানোপ্রযুক্তিও যেন মানব সমাজ বিশেষ করে চিকিৎসায় কোনো ক্ষতির কারণ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়