রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

বিদ্যাসাগর ও সমাজ সংস্কার

মো. সাইদুজ্জামান
বিদ্যাসাগর ও সমাজ সংস্কার

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শতশত বছরের জীর্ণতার ঘুণে ধরা বাঙালি সমাজে নবজাগরণের সুর তোলেন রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠী, ব্রাহ্মসমাজ প্রমুখ। তারা তৎকালীন বাঙালি সমাজে অনাচারের নানা কুয়াশায় ঢাকা সামাজিক বিভিন্ন আচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি সমাজ-সংস্কারক ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ-সংস্কার ও পুনর্গঠনে সমাজবিপ্লবীর ভূমিকা পালন করেন। বিদ্যাসাগর বরণীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন একজন কিন্তু প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্যে তিনি ‘একতম’। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতে, “প্রাচীন ঋষির জ্ঞান ও প্রতিভা, ইংরেজের কর্মশক্তি এবং বাঙালি মায়ের হৃদয় দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠিত।”

বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কারমূলক গ্রন্থের মধ্যে ‘বাল্যবিবাহের দোষ’, ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ উল্লেখযোগ্য। রচনাগুলোতে তিনি সমাজের বিভিন্ন অনাচার বিশেষ করে অবহেলিত নারীদের দুর্দশা তুলে ধরেছেন।

বহু পূর্ব থেকেই আমাদের অঞ্চলে বাল্যবিবাহ চলে আসছে। বিশেষজ্ঞ গবেষণায় দেখা যায়, মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রম না করলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যে সন্তানের জন্ম হয় প্রায়ই সে ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বেই মারা যায় বা পৃথিবীর আলো হতে বঞ্চিত হয়; আর যে সকল শিশু জীবিত থাকে তাদের অধিকাংশই শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে। অল্প বয়সে বিবাহ হলে মা অশিক্ষিত থাকে এবং সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষাদানে ব্যর্থ হয়। কারণ সন্তানের হৃদয়ে জননীর উপদেশ যেভাবে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় অন্য কারো দ্বারা সেটা সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগর এই উপলদ্ধি সকলের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘বাল্যবিবাহের দোষ’(১৮৫০ খ্রি.) রচনায় অধুনা সভ্য সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের অনুরোধ করে বলেন - “তাঁহারা স্ত্রীজাতির শিক্ষাদান বিষয়ে যেরূপ উদ্যোগ করিবেন তদ্রুপ বাল্যবিবাহ প্রথার উচ্ছেদকরণেও যত্নশালী হউন, নচেৎ কদাচ অভীষ্ঠসিদ্ধ করিতে পারিবেন না।”

বিদ্যাসাগর ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে যে অনতিদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন তাতে অত্যন্ত সহজ ভাষায় এবং যুক্তি প্রদর্শন করে বাল্য বিবাহের দোষ তুলে ধরেছেন এবং বয়স্ক বিবাহের উপকারিতা ও গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এতে তাঁর মনে সমাজ-সংস্কারের এবং বিপ্লবের দিক খুঁজে পাওয়া যায়। বাল্যবিবাহের শারীরিক, মানসিক, বংশগতি, নৈতিক, সামাজিক, সকল দিক বিবেচনা করে তিনি এর ক্ষতিকর প্রভাবই দেখতে পেয়েছেন। তাই তাঁর জিজ্ঞাসা- “অতএব যে বাল্যবিবাহ দ্বারা আমাদিগের এতাদৃশী দুর্দশা ঘটিয়া থাকে, সমূলে তাহার উচ্ছেদ করা কি সর্বতোভাবে শ্রেয়স্কর নহে?”

বিধবাবিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের সংগ্রাম বাঙালি সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কথিত আছে, পিতা ঠাকুরদাস এবং মাতা ভগবতী দেবীর উৎসাহে তিনি বিধবাবিবাহ আন্দোলন সূচনা করেন আবার কেউ কেউ বলেন, এক বিধবা বালিকার কান্না শুনে বিচলিত হয়ে তিনি এ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হন। আমাদের দেশে বিধবাবিবাহ চালু হওয়া উচিত কিনা এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি শাস্ত্রের দ্বার¯থ হয়েছেন। তাঁকে কেন শাস্ত্রবচনের আশ্রয় নিতে হয়েছে সে বিষয়ে সকলেই অবগত। ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ পুস্তকের (জানুয়ারি ১৮৫৫) ভূমিকায় তিনি বলেন- “যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদানুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এ দেশে শাস্ত্রই সর্বপ্রধান প্রমাণ এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্যকর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। অতএব, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত অথবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম ইহার মীমাংসা করাই সর্বাগ্রে আবশ্যক।”

বাঙালিরা সাধারণত যুক্তির উপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চায় না; তা সে পণ্ডিত, কি মূর্খ যাই হোক না কেন। কিন্তু শাস্ত্রে আছে এমন প্রমাণ করতে পারলে যুক্তিবিরোধী ব্যাপারও চোখ বুঝে গ্রহণ করে। শাস্ত্রে (ব্যাস সংহিতা) উল্লেখ আছে- বেদ, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা দিলে বেদকেই প্রমাণ হিসেবে ধরতে হবে আর স্মৃতি ও পুরাণের মধ্যে বিরোধ থাকলে স্মৃতিকেই প্রমাণ হিসেবে ধরতে হবে। অর্থাৎ স্মৃতিও পুরাণে বিবাদ বাধলে স্মৃতিই গ্রাহ্য হবে, পুরাণ বাতিল হবে। সুতরাং বৃহন্নারদীয় পুরাণ বা আদিত্য পুরাণে যাই থাক না কেন, পরাশর স্মৃতির বিধানই কলিযুগে একমাত্র গ্রহণীয়। পরাশর স্মৃতির শ্লোকে (৪.৩০) উল্লেখ আছে- “স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করিলে অথবা পতিত হইলে স্ত্রীদিগের পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত। যে নারী স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে ব্রহ্মচারীদিগের ন্যায় স্বর্গলাভ করে। মনুষ্যশরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম অছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসমকাল স্বর্গ বাস করে” (বিদ্যাসাগরকৃত অনুবাদ)। দেখা যাচ্ছে, কেবল বিধবা নয় কারো স্বামী নিরুদ্দেশ, ক্লীব, সন্ন্যাসী কিংবা পতিত হলে পরাশর স্মৃতি সে নারীর পুনর্বার বিবাহের বিধি দিয়েছেন। অবশ্য শ্লোকে এ কথাও বলা হয়েছে, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করলে স্বর্গ লাভ করবে এবং সহমরণে গেলে মানুষের শরীরে যত লোম আছে (সাড়ে তিন কোটি) তত বছর স্বর্গে বাস করবে। পরাশর তাঁর শ্লোকের প্রথমেই পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা দিয়েছেন কারণ তিনি জানতেন কলিযুগে বিধবাদের ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে জীবন নির্বাহ করা কষ্টকর হয়ে উঠবে। তাই বিদ্যাসাগর প্রথম পুস্তিকায় সিদ্ধান্ত করলেন- “অতএব কলিযুগে বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রবিহিত কর্তব্য কার্য তাহা নির্বিবাদে সিদ্ধ হইল।”

অনেকেই আবার আপত্তি তুলেছেন বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত হলেও শিষ্টাচারসম্মত নয়। সুতরাং এদেশে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত নয়। শাস্ত্রের মাধ্যমেই বিদ্যাসাগর সেই আপত্তির সমাধান দিয়ে বলেছেন ‘বশিষ্ঠ- সংহিতা’য় ঊল্লেখ আছে যে, শাস্ত্রে কোনো বিধি পাওয়া না গেলে শিষ্টাচারকে (লোকাচার) প্রমাণ বলে ধরতে হবে (লোকে প্রেত্য বা বিহিতো ধর্মঃ। তদলাভে শিষ্টাচারঃ প্রমাণম্।)। অতএব, শাস্ত্রে (পরাশর স্মৃতি) যখন কলিযুগে বিধবাবিবাহের বিধি রয়েছে তখন শিষ্টাচার বা লোকাচারের দোহাই দেওয়া একেবারে অমূলক। বিদ্যাসাগর জানতেন, এদেশের মানুষ তথাকথিত পণ্ডিতদের মুখাপেক্ষী। আবার ঐ সব পণ্ডিতেরা মানুষের কল্যাণ অপেক্ষা শাস্ত্রকেই বড় করে দেখে। তাই তিনি বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত কিনা সেটি প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বুঝেছিলেন এইসব পণ্ডিতেরা আসলে দেশাচারের দাস। তিনি মনে করেছিলেন কোন সামাজিক কাজকে শাস্ত্রসম্মত বলে প্রমাণ করতে পারলেই এ দেশের লোক নতমস্তকে গ্রহণ করবে কিন্তু তাঁর সে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ, পুস্তিকা প্রকাশের সাথে সাথে তিনি দেখলেন বাঙালি পণ্ডিত-মূর্খ নির্বিশেষে সকলেই শাস্ত্র, তত্ত্বকথা কিংবা যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয় না, তারা পরিচালিত লোকাচারের মাধ্যমে।

পুস্তকটি প্রকাশের পরপরই দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বহু শাস্ত্রীয় পণ্ডিত পক্ষে বিপক্ষে মত দেন। তারই ধারাবাহিকতায় একুশজন পণ্ডিতের যুক্তি খণ্ডন করে বিদ্যাসাগর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ দ্বিতীয় পুস্তক (অক্টোবর ১৮৫৫) প্রকাশ করেন এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলেন- “হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে।

হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারিনা।”

লক্ষ্যণীয় বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কার আন্দোলন মূলত নারীমুক্তি আন্দোলন। মানবের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত নারী সমাজকে ন্যায্য অধিকার দিতে গিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে দেশ গঠনের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করে গিয়েছেন। এ কাজগুলো তিনি করেছেন নিছক মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই, কোন ধর্মবোধের তাগিদ থেকে নয়। তিনি লক্ষ্য করেছেন, কৌলীন্য প্রথার চূড়ান্ত বিকৃতজনিত অভিশাপ নারীর জীবনকে করে তুলছিল দুর্বিষহ ও অমানবিক। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের যাতাকলে পড়ে অকাল বৈধব্যের অভিশাপগ্রস্ত হয়ে অনেককে পড়তে হয়েছিল ব্যভিচারের ¯্রােতে। নারী সমাজের এই দুর্গতি তথা অসামাজিক ব্যভিচারের ¯্রােত বন্ধ করার সাহসিক প্রচেষ্টাস্বরূপ তিনি বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। শাস্ত্রের প্রতি এদেশীয় মানুষের মাত্রাতিরিক্ত অনুগত্যের কারণে বিদ্যাসাগর এ ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় যুক্তিকে খাঁড়া করতে চেয়েছিলেন যাতে রক্ষণশীল, গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করা যায়।

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত ৯৮৬ জন লোকের স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র ১৮৫৫ সালের অক্টোবরে ভারত সরকারের কাছে পাঠান। এই বিলের খসড়া কাউন্সিলে প্রথমবারের মতো উত্থাপন করা হয় ১৮৫৫ সালের ১৭ নভেম্বর। দ্বিতীয়বার উত্থাপন করা হয় ১৮৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি। আশ্চর্যের বিষয় বিধবাবিবাহ আইন পাশের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠে এবং ১৮৫৬ সালের ১৭ মার্চ রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ভারত সরকারের কাছে যে আবেদনপত্র যায় তাতে ৩৭,০০০ জন লোকের স্বাক্ষর পড়ে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত শেষে তৎকালীন ভারত সরকার বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন।

১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর ১২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রথম বিধবাবিবাহ হয় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও পটলডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কালীমতী দেবীর সাথে। বিয়ের যাবতীয় অর্থ বিদ্যাসাগরই দেন। কিন্তু এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকে তাঁর পিছনে গুন্ডা লেলিয়ে দেয়। তারপরও তিনি দমে যাননি । ১৮৭০ সালের ১১ আগস্ট নিজের একমাত্র পুত্র ২২ বছর বয়সী নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৪ বছর বয়সী বিধবা ভবসুন্দরী দেবীর সাথে বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগর বলেছেন- “বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।” তিনি দেশাচারের নিতান্ত দাস নন, সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি আবশ্যকীয় সব করতে প্রস্তুত। বিধবাবিবাহে অর্থ সাহায্য দেওয়ার জন্য তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন এবং প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দিতেও রাজি ছিলেন।

বহুবিবাহ আমাদের অঞ্চলে একটি সামাজিক ব্যাধি। এদেশীয় এমন কোনো কুলীন ব্রাহ্মণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বহুবিবাহের সাথে যুক্ত নন। বহুবিবাহ প্রচলিত থাকাতে হিন্দু সমাজে নানারকম অনিষ্ট ঘটেছে। কারণ কুলীন ব্রাহ্মণদের মৃত্যুর ফলে সহস্র সহস্র বিধবা নারী, যারপরনাই যন্ত্রণা ভোগ করেছে। ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণ হত্যাপাপের ¯্রােত প্রবলবেগে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের লোকের পক্ষে এর প্রতিকার করা কোনো মতে সম্ভব নয়। এই সামাজিক দোষ থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারি হস্তক্ষেপ ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই বলে বিদ্যাসাগর মনে করতেন। তাই তিনি বলেন- “রাজশাসন দ্বারা, এই নৃশংস প্রথার উচ্ছেদ হইলে, সমাজের মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল ঘটিবেক, তাহার কোন হেতু বা সম্ভাবনা দেখিতে পাওয়া যায় না।”

বহুবিবাহ বাঙালি সমাজে কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিলো বিদ্যাসাগর কর্তৃক সংগৃহীত সে সময়ের কুলীন ব্রাহ্মণদের বিবাহের তালিকা দেখলে সহজেই বুঝা যায়। অবশ্য রক্ষণশীল কুলীন ব্রাহ্মণদের পক্ষ অবলম্বন করে কেউ কেউ বলেন বহুকাল পূর্বে এদেশে কুলীন ব্রাহ্মণদিগের অত্যাচার ছিলো। তখন অনেকে বহুবিবাহ করতো। কিন্তু বর্তমানে (উনিশ শতকে) এই অত্যাচারের মাত্রা প্রায় নিবৃত্তি হয়েছে। আর যা কিছু অবশিষ্ট রয়েছে অল্পদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ নিবৃত্তি ঘটবে। সুতরাং এ ব্যাপারে রাজশাসন নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মনে করেন, বিবাহ বিষয়ে পূর্বে কুলীনদের যেরূপ অত্যাচার ছিলো এখনো তাই আছে। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন জেলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কুলীন ব্রাহ্মণদের বিবাহের তালিকা তৈরি করেছেন। হুগলি জেলার বিভিন্ন গ্রামের ১৩৩ জন কুলীন ব্রাহ্মণদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বসো গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় চার কুড়ি (৮০) বিবাহ করেছেন। আবার তাঁতিসাল গ্রামের ১৮ বছর বয়সী আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাহের সংখ্যা এগারো (১১)। যে ব্যক্তি আঠারো (১৮) বছর বয়সে ১১টি বিবাহ সম্পন্ন করেছে ৬০-৭০ বছর সুস্থাবস্থায় জীবিত থাকলে তিনি কতটি বিবাহ করবেন তা সহজেই অনুমেয়! কেবল হুগলিতে নয় বর্ধমান, নবদ্বীপ, যশোর, বরিশাল, ঢাকা প্রভৃতি জেলাতেও বহুবিবাহকারী কুলীনের সংখ্যা তদপেক্ষা কম নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকও হতে পারে। কলকাতা থেকে মাত্র ৫/৬ ক্রোশ দূরে অবস্থিত জনাই গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মণদের যে তথ্য তিনি দিয়েছেন তাতেও বহুবিবাহের প্রাচুর্য লক্ষ্যণীয়।

কথিত আছে বিদ্যাসাগর তাঁর বহুবিবাহবিরোধী গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিলেতে গিয়ে মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে দিয়ে অনুযোগ করেছিলেন যে, যে-দেশের রাজ্যশাসন করেন এক মহীয়সী নারী সে দেশের নারী সমাজের এত দুর্গতি কেন। ঠিক একই জাতীয় উক্তি তাঁর বহুবিবাহ নিষেধক পুস্তকের প্রথম খণ্ডের শেষভাগে এক মন্দভাগিনী কুলীন কন্যার মুখেও পাওয়া যায়- “সকলে বলে এক স্ত্রীলোক আমাদের দেশের রাজা কিন্তু আমরা সে কথায় বিশ্বাস করি না; স্ত্রীলোকের রাজ্যে স্ত্রীজাতির এত দুরবস্থা হইবেক কেন?”

বহুবিবাহ রহিত করতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম আবেদনপত্র পাঠান ১৮৫৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। রাজবিদ্রোহের কারণে তাঁর আবেদনপত্র টেবিলেই পড়ে থাকলে নিরাশ না হয়ে তিনি আবার ১৮৫৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আবেদন পাঠান। পরবর্তীতে তিনশ স্বাক্ষর বিশিষ্ট একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে ১৮৬৬ সালের ২৪ মে জমা পড়ে। এ আবেদনপত্রে বহুবিবাহ রহিত আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রণপ্রথা উচ্ছেদেরও দাবি জানানো হয়। সরকার বিদ্যাসাগরসহ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে এ ব্যাপারে তথ্য জানতে চান। কিন্তু বিদ্যাসাগর ব্যতীত অন্যান্য সবাই এ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেননি। তাই হয়তো সরকার এ বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

বিদ্যাসাগর নারীজাতির মঙ্গলের জন্য বিধবাবিবাহ চালু ও বহুবিবাহ বন্ধের যে আন্দোলন করেছিলেন সেখানে বহু বাধার সম্মুখীন হন। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বিভিন্ন লেখায় তীব্র কটূক্তির মাধ্যমে এর বিরোধিতা করেন। বিধবাবিবাহকে বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে পরিহাস করেছেন, বহুবিবাহকে কোথাও নিন্দা করেননি। তিনি ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে লিখেছেন- ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’ এরূপ মন্তব্যে দুঃখ পেলেও বিদ্যাসাগর তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বঙ্কিমের ধারণা ছিল ইংরেজকে খুশি করার জন্যই সেযুগে সংস্কারকেরা ব্রাহ্ম আন্দোলন, বিধবা-বিবাহ আন্দোলন কিংবা কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ বন্ধ আন্দোলন করছিলেন। এ প্রসঙ্গে লোকরহস্যের ‘ইংরেজ স্তোত্র’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়- “আমি বিধবার বিবাহ দিব, কুলীনের জাতি মারিব, জাতিভেদ উঠাইয়া দিব- কেননা তাহা হইলে তুমি আমার সুখ্যাতি করিবে। অতএব হে ইংরাজ তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও।... পৈত্রিক ধর্ম ছাড়িয়া ব্রাহ্মধর্মাবলম্বন করিব। ... আমার প্রতি প্রসন্ন হও।”

শুধু বঙ্কিম নয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং অন্যান্য অনেক সাহিত্যরথীরাও এ সংগ্রামে বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর যেন হারকিউলিসের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন বাঙালি সমাজে। গ্রিক পুরাণের রাজা আউজিয়াস (অঁমবঁং)-এর হাজার হাজার ঘোড়া-গরু-মহিষ এবং আস্তাবল থেকে পর্বতসম আবর্জনা সরাতে যেমন মহাবীর হারকিউলিস (যবৎপঁষবং)-এর প্রয়োজন হয়েছিল তেমনি ভারতীয় শাস্ত্রাচারের দুর্গে বন্দি এ দেশীয় লাখ লাখ মানুষকে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন হয়েছিল দুঃসাহসী, অক্লান্তকর্মী, সর্বত্যাগী, সংগ্রামী বিদ্যাসাগরের। হারকিউলিস নদীর প্রবাহকে পরিবর্তন করে সব জঞ্জাল দূর করেছিলেন। বিদ্যাসাগরও তেমনি সমাজ ও শিক্ষা-সংস্কারের বেগবান প্রবাহ রচনা করে এদেশের মানুষের যুগযুগ ধরে সঞ্চিত আবর্জনার স্তূপ ও সুস্থ জীবনযাত্রার নানা প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে চেয়েছিলেন।

সমাজ-সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগর বাঙালির মানসপটে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড নতুন প্রজন্মের জন্য দিক-নিদের্শনা ও অনুপ্রেরণার উৎস। আজ দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতেও সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এতটুকুও ম্লান হয়নি বরং বাঙালি সমাজজীবনে তিনি ভাস্বর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়