প্রকাশ : ২২ মে ২০২৪, ০০:০০
বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন
বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় যাঁরা গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের অন্যতম প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন। বিশেষত পূর্ববাংলা, নগর ঢাকা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর গবেষণা অসামান্য। তাঁর গবেষণা ও উপস্থাপন-সারল্য সাধারণ মানুষকে ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সহযোগিতা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও গণআন্দোলনেও তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ অবশ্যপাঠ্য করতে তাঁর অগ্রণী অবদান রয়েছে।
মুনতাসীর মামুনের পুরো নাম মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন। তিনি ১৯৫১ সালের ২৪ মে ঢাকার ইসলামপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস চাঁদপরে, কচুয়ার গুলবাহার গ্রামে। বাবা মেজবাহ উদ্দিন খান, মা জাহানারা খান। তাঁর দাদা আশেক আলী খান চাঁদপুরের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর চাচা।
মুনতাসীর মামুন বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট প্রাইমারি, হাইস্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইতিহাস বিভাগে। এ বিভাগ থেকে স্লাতক ও স্নাতকোত্তর এবং ১৯৮৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি নিজের বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯১ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ২০১৬ সালে তিনি অধ্যাপক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে ইতিহাস বিভাগের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ পদে তাঁকে নিয়োগ দেয় সরকার। মুনতাসীর মামুন খুব অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। শৈশবেই গল্প লিখে সারাদেশে তিনি প্রথম হয়েছিলেন, লাভ করেছেন প্রেসিডেন্ট পুরস্কার।
মুনতাসীর মামুনের মূল পরিচয় তিনি অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও গবেষক। বিশেষত পূর্ববঙ্গ ও ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যবিষয়ক গবেষণার জন্যে তিনি সমাদৃত। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েও তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম রয়েছে।
মুনতাসীর মামুন তিনশতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা। ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা, প্রবন্ধ, চিত্রসমালোচনা ছাড়াও লিখেছেন গল্প, কিশোর সাহিত্য; করেছেন অনুবাদও। তাঁর প্রথম গ্রন্থ সত্যেন সেনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : লাইফ অ্যান্ড সোসাইটি ইন ইস্ট বেঙ্গল : ১৮৫৭-১৯০৫, (১৯৮৬), উনিশ শতকের পূর্ব বাংলা (১৯৮৬), প্রশাসনের অন্দরমহল (১৯৮৭), কালীপ্রসন্ন ঘোষ (১৯৮৯), বাংলাদেশের রাজনীতি : এক দশক (১৯৯৯), ১৯ শতকে পূর্ববঙ্গের মুদ্রণ ও প্রকাশনা (২০০৫), আইন, আদালত ও জনতা (২০০৫), ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়া (২০০৬), ১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা (২০০৮), আমার ছেলেবেলা (২০০৮), দুঃসময়ের দিনগুলি (২০১০) ইত্যাদি। ঢাকা নিয়ে তাঁর গবেষণা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর ঢাকাবিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : ঢাকার কথা, পুরান ঢাকা, ঢাকার খাল পোল ও নদীর চিত্রকর, সিভিলিয়ানদের চোখে ঢাকা, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, ১৯ শতকের ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা, ঢাকার স্মৃতি ১-১৪, ঢাকার সেইসব বিখ্যাত মানুষ, দেয়ালের শহর ঢাকা ইত্যাদি। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ : পাকিস্তানী জেনারেলদের মন : বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার সমগ্র, শান্তিকমিটি ১৯৭১, জয় বাংলা, পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর, বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, বীরাঙ্গনা ১৯৭১, ইয়াহিয়া খান ও মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র, রাজাকারের মন ইত্যাদি।
মুনতাসীর মামুনের সাংগঠনিক কার্যক্রম বিশেষ গুরুত্ববহ। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও গণআন্দোলনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছিলেন ডাকসুর সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি। তাঁর উদ্যোগে ও সম্পাদনায় প্রথমবারের মতো ডাকসুর মুখপত্র ‘ছাত্রবার্তা’ প্রকাশিত হয়। তিনি সেন্টার ফর ঢাকা স্টাডিজ-এর প্রতিষ্ঠাতা, ঢাকা নগর জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া তিনি জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং জাতীয় আর্কাইভস্-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সালে মুনতাসীর মামুনকে ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর সাম্মানিক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ৩ বছর তিনি এ পদে কাজ করেন।
মুনতাসীর মামুনের কর্মজীবন দীর্ঘ ও সাফল্যমণ্ডিত। কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১০ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি লেখক শিবির পুরস্কার, সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার, নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার, হাকিম হাবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক পুরস্কার, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, অলক্ত স্বর্ণপদক পুরস্কার, ড. হিলালী স্বর্ণপদক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিয়েন্স শহর কর্তৃপক্ষ সম্মান জানিয়ে মুনতাসীর মামুনকে ‘অনারেবল ইন্টারন্যাশনাল অনারারি সিটিজেনশিপ’ প্রদান করেছে।
সূত্র :
১. ঢাকা : স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী (অখণ্ড), মুনতাসীর মামুন; অনন্যা প্রকাশনী, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৭। ২. সুহৃদ ও সহযোদ্ধা মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, ভোরের কাগজ, ২৩ মে ২০১৯। ৩. প্রিয় মুনতাসীর মামুন, চৌধুরী শহীদ কাদের, ভোরের কাগজ, ২৪ মে ২০১৯।