প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
বাঙালির মুক্ত জীবনের কথা
আধুনিক যুগেও পৃথিবীময় আপনার দৃষ্টি প্রসারিত করুন, দেখবেন ভূখণ্ডহীন পরাধীন জাতির দুঃখণ্ডদুর্দশা, শুনবেন তাদের হূদয়ের আর্তনাদ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে বাঙালি জাতিকে যিনি মুক্ত করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির জীবনে এসেছিলেন আলোকবর্তিকা হয়ে। তার অসামান্য ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন বাংলাদেশ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির ‘মুজিব’ নামের প্রতিটি অক্ষরকে প্রসারিত করলে হূদয়মাঝে প্রতিধ্বনিত হয় ‘মুক্ত জীবনের বন্দনা’। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন। বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করাই ছিল তার জীবনের একমাত্র আরাধ্য বিষয়।
|আরো খবর
১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। প্রায় হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্বে ভাষা ও সংস্কৃতিসহ সব বিষয়ে অমিল থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় মিলের কারণে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ করা হয়। এই নতুন রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনে কোনো মুক্তির স্বাদ আনতে পারেনি। শাসকের হাতবদল হয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ ভিনদেশি শাসক দ্বারা শাসিত হতে থাকে। আমাদের ওপর নেমে আসে নানা প্রবঞ্চনা ও শোষণ। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বাঙালি জাতি পায় মুক্তির স্বাদ। বাঙালিকে স্বাধীন দেশ ও জাতিসত্তা উপহার দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ১২ বছরের বেশি সময় জেল খেটেছেন, ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়েছেন, ২৪টি মামলায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন ও দুই বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাজগুলোর সূচনা করে গিয়েছিলেন। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে শিল্পোন্নত দেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রণয়ন করেছিলেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮)। পরিকল্পনাটির মূল উদ্দেশ্য ছিলÍদারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকারদের কর্মসংস্থান, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিকরণ। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে দেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা, বিভিন্ন অর্থকরী ফসল উৎপাদন করে কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব দূর করা এবং শ্রমিকের জীবনমান উন্নত করাও ছিল এই পরিকল্পনারই অংশ। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য ও কার্যকর ছিল, তা ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি থেকে স্পষ্ট হয়। সে বছর জাতীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯. দশমিক ৬ শতাংশ, যা এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ। পরাধীন জাতির রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক মুুক্তিই শেষ কথা নয়। নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিকে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য দরকার ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিসহ আরো অনেক কিছু। পৃথিবীতে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের উন্নতির কারণ হলো বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই তারা অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। তাই স্বাধীনতার পর তিনি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেন।
সে লক্ষ্যে তিনি ১৯৭২ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা। সমকালীন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৫ সালে ১৪ জুন বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র নির্মিত হয়। যার ফলে বাংলাদেশ সহজেই টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল।
আধুনিক বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত অর্থনৈতিক খাত হলো সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি। ১৯৯৪ সালে অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাউলি প্রথম সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন। আধুনিক যুগের মানুষের সীমাহীন চাহিদা পূরণ করতে হলে সাগরতলের সঞ্চিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম অ্যাক্ট’ পাশ করেন। আইনটির মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সাগরের অভ্যন্তরের বিশাল সম্পদের উৎস ব্যবহার, বাণিজ্যে সমুদ্রপথের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে দেশের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব সেই সময়েই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা। সংস্কৃতির স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এই আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন। সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানের সংসদে শেখ মুজিব বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলায়। তিনি বলতেন, দুনিয়ায় সব দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করেন। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে গর্ববোধ করি। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ বাঙালির আত্মমর্যাদার নতুন ইতিহাস। তার প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভিনদেশি ভাষায় পড়াশোনা করে কোনো জাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের প্রতিটি দাপ্তরিক কাজে ও শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার প্রচলনে তিনি ছিলেন সর্বদা আন্তরিক ও সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, বাংলার মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি, স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এভাবেই দেশের সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার চেষ্টায় সর্বদা নিমগ্ন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির একটি দেশ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাঙালির আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে চারা গাছ রোপণ করেছিলেন, তা আজ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ শেকড় থেকে শিখরের অগ্রযাত্রায়।
ড. মোঃ নাছিম আখতার : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।