প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
জঙ্গি-সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অনেক সাফল্য থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জনমনে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কঠোর হস্তক্ষেপে জঙ্গি তৎপরতা প্রায় নির্মূল হয়েছিল। এমন ধারণা যখন মানুষের মধ্যে বিরাজ করছিল, ঠিক তখনই জঙ্গিরা পুনরায় তাদের তৎপরতা শুরু করল, যার সর্বশেষ মহড়া হলো আদালত চত্বরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তথ্যমতে, জঙ্গিরা প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
এক্ষেত্রে তারা পুলিশের চোখেমুখে পিপার স্প্রে মেরে আসামিসহ মোটরসাইকেলে দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জঙ্গিদের এত বড় তৎপরতা এবং তাদের সক্ষমতা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। সারাদেশ এবং সীমান্তে এখন চলছে রেড এলার্ট। প্রসিকিউশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের তথ্যমতে, ঐদিন জঙ্গিদের বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেওয়া হয়নি।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কারাগার থেকেই হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও ডা-াবেড়ি পরানোসহ আরও যেসব নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, তা নেয়া হয়নি। অর্থাৎ দুর্র্ধষ এসব আসামিকে আলাদাভাবে না এনে সাধারণ আসামিদের সঙ্গে আনা-নেওয়া করা হয়েছে, যা জেল কোডের পরিপন্থি। তবে প্রতিদিন গড়ে ৫০০-৬০০ আসামি আনা-নেওয়ার পেছনে মাত্র ১৫০ জন পুলিশ সদস্য প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
আজকাল জঙ্গিরা শুধু নিজেরাই সন্ত্রাস করে না, আধুনিক অস্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কেমিক্যাল ব্যবহার করে অর্থের বিনিময়ে অনৈতিক কাজের জন্য ভাড়াও খাটে। তাদের প্রযুক্তি এতই আধুনিক যে, টার্গেটকারী কখন, কোথায়, কিভাবে আছে এবং যাতায়াত করে তা সহজেই ট্রাকিং করতে পারে, যা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কাছেও নেই।
পুলিশের এক সাবেক ডিআইজির (গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান) মতে, আসামি ছিনতাইয়ের এই ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতাও আছে? এমনকি এই বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদেরও হাত থাকতে পারে। কারণ, আটককৃত দুই জঙ্গি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে যে, ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশ বা কারাগারের ভেতরের কারও হাত আছে কিনা, এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি জানার পরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা উদ্দেশ্যমূলকও হতে পারে। সাম্প্রতিক একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ জন কারারক্ষীকে জঙ্গি সংগঠনের জন্য কাজ করতে দেখা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি ২০১৬ থেকে আগস্ট ২০২১-এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৯৬৩ জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদের মধ্যে ২০ বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল নোমান, যিনি জামিনে বেরিয়ে আরেক জেএমবি প্রধান আবু মোহাম্মদের নির্দেশে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরি করতে শেখেন এবং ২০২০ সালের ২৪ জুলাই পল্টনের পুলিশ বক্সে একটি আইইডি স্থাপন করেন। আইইডি একটি বিস্ফোরক ব্যবস্থা, সাধারণত রাস্তার পাশে বোমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে বিদ্রোহী গেরিলা কমান্ডো বাহিনীর অপারেশনে দেখা যায়।
পুলিশের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালেও ত্রিশালে পুলিশভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ইদানীং পুলিশ হেফাজত থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। দায়িত্বে অবহেলা, রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচার এবং গতিবিধি সন্দেহে ইতোমধ্যেই কয়েক পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ বিভাগ থেকেও নেওয়া হচ্ছে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
অনেকের ধারণা, বর্তমান সময়ে সরকার এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক সমাবেশ (শোডাউন) চলছে দেশব্যাপী সর্বত্র। এসব শোডাউনে সাধারণ জনগণের যে কি ভোগান্তি হয়, তা কেউই ভাবে না। এর ওপর যেখানে সেখানে আতঙ্ক ছড়িয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করা, জানমালের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানো যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। এতে পালিয়ে থাকা জঙ্গিরা আরও বেশি চাঙ্গা হয়। জনমনে নেমে আসে অশান্তি ও অস্থিরতা।
আর এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তায়ই হোক, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশেই হোক, জঙ্গিরা যদি গোপন তথ্য আগেই জেনে ফেলে, তাহলে তা কারোর জন্যই মঙ্গলকর নয়। একটা সময় ফেসবুক মেসেঞ্জারের মতো সাধারণ অ্যাপস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করত জঙ্গিরা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকেটা ভেঙে পড়ে। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টও যাতে কেউ খুলতে না পারে, সে বিষয়েও ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।
নামে-বেনামে যাতে অতিরিক্ত সিম বিক্রি না করে তাও বলা আছে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষকে।
জঙ্গিরা কিন্তু দিন দিন প্রযুক্তির আপডেট অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেই চলছে। বর্তমানে এরা গোপনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য অ্যাপস ও ডার্কওয়েব ব্যবহার করছে। মূলত নিজেদের মধ্যে একান্তে যোগাযোগ, বিশেষ গোষ্ঠী তৈরি করা এবং গোপনীয়তা সুরক্ষায় ডার্কওয়েব খুবই কার্যকর। ইন্টারনেটের যে অংশে সরাসরি কোনো অ্যাক্সেস নেই এবং সার্চ ইঞ্জিনগুলোও যে সকল ডেটাকে ইনডেক্স করতে পারে না, শুধু বিশেষ ওয়েব ব্রাউজার (সফটওয়্যার) ব্যবহার করে এতে প্রবেশ করা যায়, তাকে ডার্কওয়েব বলে।
একইভাবে জ্যামার ব্যবহার করে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা নির্বিঘেœ তাদের অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছে। জ্যামার একটি মোবাইল ফোন যা কোনো এলাকায় বসালে, সেখানকার ফোন নেটওয়ার্ক কাজ করে না। সাধারণত সরকারি নিরাপত্তামূলক কাজে, হাসপাতালে নীরবতার জন্য কিংবা পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের অসাধু উপায় অবলম্বন রোধ করতে জ্যামার ব্যবহৃত হয়। নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় বিপদে পড়া ব্যক্তিও সাহায্যের জন্য পুলিশ কিংবা আত্মীয়স্বজনকে ফোন করতে পারে না।
ফলে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষ করে নিরাপদে সটকে পড়ে। সাধারণত এসব প্রযুক্তি সরকারি নিরাপত্তামূলক কাজে আমদানি ও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেট, স্টেডিয়াম মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে ও অনলাইনে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে আইন অমান্য করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে এগুলো আমদানি ও বিক্রি করছে। সরকারের কঠোর নজরদারিতে এসব পণ্য আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা উচিত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো অনসাইট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ওআইভিএস) নামের মোবাইল আকৃতির একটি ডিজিটাল ডিভাইস, যার এক ক্লিকেই যে কোনো ব্যক্তির সব ধরনের তথ্য বের করা সম্ভব নিমিষেই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই ডিভাইসটি বর্তমানে ব্যবহার করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এতে সাফল্যও পাওয়া যাচ্ছে ভালো এবং দ্রুত। অস্ত্র, মাদক, জঙ্গি, খুনি, প্রতারণাসহ ৪০টি ক্যাটাগরি রয়েছে এ প্রযুক্তির মধ্যে। র্যাবের বৃহৎ ডাটাবেজ অনুযায়ী একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কিংবা আসামি গ্রেপ্তারের পর তার যেকোনো একটি তথ্য যেমন- ফিঙ্গারপ্রিন্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ, নাম এমনকি ডিভাইসের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নিলেই জানা যাবে সে অস্ত্র ব্যবসায়ী, মাদক কারবারি, জঙ্গি, খুনি নাকি প্রতারক।
থ্রিসিক্সটি টেকনোলজি অপর আরেকটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যা ইন্টারনেট ও সাইবার সিকিউরিটি, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইত্যাদি কাজে উন্নত দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিঙ্গাপুরের মতো রাষ্ট্রে অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অনেক উন্নত দেশেও থ্রিসিক্সটি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তথ্যমতে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা রয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি)। এখন তারা তাদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পুরনো ও প্রশিক্ষিত সদস্যদের পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে নতুন সদস্য সংগ্রহে তৎপর।
সেজন্য তারা নানা ধরনের ‘এনক্রিপটেড অ্যাপ’ ব্যবহার করে নতুন সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিভিন্ন ধরনের বৈঠক করে আসছে। এইভাবে প্রায় শতভাগ অপরাধের সঙ্গে আগে বা পরে প্রযুক্তির একটি যোগসূত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে তৎপর থাকতে হবে। এর মাধ্যমে অপরাধীর সম্পৃক্ততা দূরত্ব খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বের সকল উন্নত রাষ্ট্রে অপরাধ দমনে তথ্যপ্রযুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত যেমন সহজ হয়, তেমনি অপরাধ সংঘটনে অপরাধীকে সতর্ক বার্তা দেওয়া যায়। শুধু জঙ্গীবাদ দমনই নয়, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতেও তথ্যপ্রযুক্তি খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও আটককৃত জঙ্গিদের কারাগারে কাউন্সেলিং করা, স্কুল-কলেজে লিফলেট-ফেস্টুন বিতরণ, বেতার, টেলিভিশন, পত্রিকায় ফিলার-অ্যাড, সচেতনতামূলক প্রচার ইত্যাদি কার্যক্রমেও জঙ্গিবাদ নির্মূলে সহায়ক হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।