প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
পিতৃহারা সাত-আট বছর বয়সের ছেলেটি স্কুল থেকে বাড়িতে এসে মাকে বলল, ‘মা, প্রিন্সিপাল আমাকে আদর করে কিছু ক্যান্ডি দিয়েছেন। আর তোমার জন্য এই চিঠিটা।’ মা চিঠিখানা খুলে পড়ে কেঁদে ফেললেন। মায়ের চোখে জল দেখে ছেলেটি বলল, ‘মা, কাঁদছ কেন?’ চোখ মুছতে মুছতে মা বললেন, ‘বাবা, এটা আনন্দের কান্না!’ বলেই ছেলেটিকে চুমু দিয়ে বললেন, ‘আমার জিনিয়াস বাবা, তোকে চিঠিটা পড়ে শোনাই।’ মা আনন্দের সঙ্গে চিৎকার করে স্যারের লেখা ভাষাগুলো বদলে নিজের মতো করে পড়তে লাগলেন, ‘ম্যাম, আপনার ছেলেটি সাংঘাতিক জিনিয়াস। আমাদের ছোট্ট শহরে ওকে শিক্ষা দেওয়ার মতো শিক্ষক আমার নেই। তাই যদি পারেন আপনার ছেলেকে বড় শহরে কোনো স্কুলে ভর্তি করে দিলে ভালো হয়। এই ছেলেটি একদিন বিশ্বে প্রচুর সুনাম অর্জন করবে।’ পত্রখানা পড়েই মা ছেলেটিকে চুমু দিয়ে বললেন, ‘এই জিনিয়াস ছেলেটিকে আমি নিজেই পড়াব।’ মা নিজেই শিক্ষা দিয়ে ছেলেটিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তথা সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বানালেন। ছেলেটির নাম টমাস আলভা এডিসন। বৈদ্যুতিক বাল্ব, শব্দ রেকর্ডিং, মুভি ক্যামেরা, চলমান ছবি ইত্যাদিসহ হাজারো আবিষ্কার তার। মায়ের মৃত্যুর পর এডিসন নিজ গ্রামে মায়ের সেই ছোট্ট বাড়িতে ঘর পরিষ্কারের সময় স্কুলের প্রিন্সিপালের দেওয়া চিঠিটা পেলেন। চিঠিখানা পড়ে টমাস কেঁদে ফেললেন। তাতে লেখা ছিল, ‘ম্যাডাম, আপনার ছেলে টমাস নিতান্তই নির্বোধ। সে এতটাই নির্বোধ যে, তাকে শিক্ষা দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। কারো আছে বলে আমাদের জানা নেই। আপনার ছেলের কারণে আমাদের স্কুলটির সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনার ছেলেকে স্কুল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হলো।’
ঘটনাটি বহু বছর আগের; কিন্তু বর্তমান সময়েও এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকবৃন্দ আছেন, যারা মনে করেন শিক্ষার্থীর অসফলতার দায়ভার শুধু শিক্ষার্থীর। এজন্য যে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমানভাবে দায়ী, তা তারা মানতেই চান না। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করলাম। আমার মেয়ে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় রসায়ন বিষয়ে নিতান্তই কম নম্বর পেয়েছিল। রসায়ন বিষয়ে গৃহশিক্ষককে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উনি বললেন যে, তার শিক্ষার্থী পড়া মনে রাখতে পারে না। আর কথা না বাড়িয়ে রসায়ন বিষয়টি গৃহশিক্ষকের পরিবর্তে আমি পড়ানো শুরু করলাম। পরবর্তী পরীক্ষায় সে ৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে রসায়ন বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলই বলে দেয়, সমস্যা শিক্ষার্থীর ছিল না। শিক্ষকের পড়ানোর পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণেই এ বিপর্যয়। আমার দীর্ঘ জীবনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা বলে পড়ানোর শুরুতেই শিক্ষার্থীকে ভালো করানোর সংকল্প নিয়ে পাঠদানের বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থী কী জানে না, তা বুঝতেই বিভিন্ন প্রশ্ন করে সময় অপচয় করেন অধিকাংশ শিক্ষক। অথচ প্রশ্ন করার শৈল্পিক রূপ সেটাই, যার মাধ্যমে জানা যাবে শিক্ষার্থীরা কী জানে অথবা কতটা জানতে পারদর্শী।’
শিক্ষকতার জীবনে ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে সবসময় নিষ্ঠাবান ছিলাম। প্রস্তুতি না নিয়ে কখনো ক্লাসে যাইনি। ক্লাস নেওয়ার আগে কী পড়াব এবং ঐ পড়া পড়াতে যেন আমার বই দেখতে না হয়, সে বিষয়ে আমি ছিলাম সদা সচেষ্ট। এজন্য ক্লাস নেওয়ার আগে আমাকে দুই থেকে তিন ঘণ্টা নিয়মিত পড়তে হতো। আমার ক্লাস শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনত। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা আমার বদ্ধমূল ধারণাকে পালটে দিয়েছে। সেদিনই বুঝেছিলাম, শুধু শিক্ষকই নন, শিক্ষার্থীও শিক্ষককে অনুপ্রাণিত করতে পারে। সকাল ৮টা, সময়টা ছিল শীতকাল। আমি যথাসময়ে ক্লাসে উপস্থিত। ক্লাস নিচ্ছি। সাধারণত আমি পড়ানোর পরে লেকচারের চুম্বক অংশগুলো পুনরাবৃত্তি করার জন্য শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করি। এতে ক্লাসটি মোটামুটি প্রাণবন্ত হতো এবং শিক্ষার্থীরা মনোযোগী থাকত। হঠাৎ লক্ষ করলাম একজন ছাত্র ক্লাসের কোণে মনমরা হয়ে বসে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি এমনভাবে বসে আছো কেন? মনোযোগ দিচ্ছ তো?’ প্রশ্ন শুনে ছাত্রটি বলল, ‘স্যার আমার অনেক জ্বর। এই জ্বর নিয়েই আপনার ক্লাস মিস দেব না বলেই ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি। ক্লাস শেষে হোস্টেলে গিয়ে শুয়ে পড়ব।’ ঘটনাটি আমার মধ্যে অদ্ভুত এক ভালো লাগা তৈরি করেছিল।
ইতিবাচক বিষয়ে শিক্ষককে সর্বদা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে। অতি সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। ১ নভেম্বর ২০২২ একটি ফোন কল পেলাম। উপাচার্য হওয়ার আগে আমি যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলাম, সেখানকার এক ছাত্র ফোন করেছে। বর্তমানে সে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানাল। দুই বছর আগে আমি তাদের অপারেটিং সিস্টেম কোর্সটি পড়িয়েছিলাম। এর ‘ডেড লক’ অধ্যায়টি পড়ার সময় সব বিষয় বুঝলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অর্থ বুঝছে না সে। বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সে আমাকে অনুরোধ করল। আমি তাকে আমার ব্যস্ততার কথা বলতে পারতাম; কিন্তু তা না বলে তাকে বললাম, ‘তুমি ঐ পৃষ্ঠার ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দাও। আমি ব্যাপারটি দেখে তোমাকে ব্যাখ্যা করব।’ কথা অনুযায়ী আমি তাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলাম। আমার সেই শিক্ষার্থী খুশি হয়ে আমাকে যে চমৎকার মেসেজ পাঠিয়েছে তাতে আবারও উপলব্ধি করলাম, শিক্ষকতা পেশার প্রশান্তি ও ঐশ্বর্য। আমি মনে করি, শিক্ষকের যে কোনো ইতিবাচক ব্যবহার ও সহায়তা শিক্ষার্থীর জন্য অনুপ্রেরণা।
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপে থাকে। তাদের মানসিক চাপ ও হতাশা কমানোর জন্য পরামর্শ দান শিক্ষকের গুরুদায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু ক্লাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের জীবনের সঠিক পথের দিশারি হওয়াও শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতার মাপকাঠি। পরিবার হলো মানুষের প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্র। এরপর সে শেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। আমার সন্তানদের অঙ্ক করাতে গিয়ে যদি বলতাম, সমাধানটি এভাবে নয়, ওভাবে করো। সন্তানরা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিত, বাবা আমাদের শিক্ষক এভাবেই করতে বলেছেন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের প্রতিটি কথাই শিক্ষার্থীর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। তাই নেতিবাচক কথা নয়, ইতিবাচক শব্দ চয়ন আমাদের অজান্তেই শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে সক্ষম। শিক্ষকের গুণাবলির বর্ণনা করতে গিয়ে আমেরিকান লেখক উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড বলেছেন, ‘ভালো শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান। আর মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন।’ প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকের অনুপ্রেরণাই শিক্ষার্থীর জীবনে এগিয়ে চলার পাথেয়।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।