মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর দর্শন
অনলাইন ডেস্ক

(গত সংখ্যার পর)

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার দর্শন

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি কোন ধর্মীয় রাজনীতি ছিল না। তাঁর রাজনীতিতে শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর গন্তব্য ছিল। মানুষকে ভালোবেসে তিনি প্রতিদানে মানুষের ভালোবাসা পেতে চেয়েছেন। তিনি কোন সম্প্রদায়ের নেতা নন। আর একারণেই তিনি বলতে পারেন, তাঁর জীবনের শক্তির উৎস হলো জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। আমাদের বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’য় তিনি কোন সাম্প্রদায়িক দফা সংযুক্ত করেননি। তাঁর ভাষণে তিনি সর্বদাই ‘ভায়েরা আমার’ বলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সম্বোধন করেছেন। দক্ষিণ বাংলার বিপ্লবী পুরুষ পূর্ণ চন্দ্র দাসের জীবন তাঁকে আলোড়িত করেছিল। নেতাজী সুভাষের বক্তব্য ও দর্শন তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসাবাদ তিনি নিজের মতো করে পরিমার্জিত করে নিয়ে ছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ঊনিশশো সত্তরের ভোটে তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে যোগ করে নিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা। এই ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন ও প্রচার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা এবং নিজ নিজ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে রক্ষা করা হবে। স্বীয় ধর্ম ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্ম প্রচারের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা হবে না। নিজ ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলে কোনো ব্যক্তিকে ধর্ম সম্পর্কীয় কোনো নির্দেশ গ্রহণ অথবা কোনো ধর্মীয় উপাসনা বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে জোর করা হবে না।’ একই নির্বাচনে তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলিম সকল ধর্মবিশ্বাসী সম্প্রদায় হতে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন এবং তারা বিজয়ীও হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি চার মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম হিসেবে স্থান দিয়েছেন। সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করেছেন। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা' বিষয়ে বলা হয়েছে :

ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য-

(ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

উপরন্তু, ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়ছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না৷

২৮(৩)-এ বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না৷

চাকরির ক্ষেত্রেও তিনি অসাম্প্রদায়িক নীতির কথা বলেছেন বাংলাদেশের সংবিধানের মাধ্যমে৷ সংবিধানের ২৯ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না৷

কাজেই বাংলাদেশের মহান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে অনুচ্ছেদগুলো জানিয়ে দেয়, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার স্থান কত গভীর ও বিস্তৃত ছিলো। বলতে গর্ব হয়, বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাংলাদেশের মহান সংবিধানই দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি যে মানুষের জন্যে ছিল, ধর্মের বা সম্প্রদায়ের জন্যে নয়, তার শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ১৯১তম পৃষ্ঠায়। বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী ও নির্যাতিত ত্যাগী সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষকে বলেছেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা কেবল মুখের কথা ছিল না। তিনি সকল কাজে-আচরণে তা বাস্তবায়নও করেছেন সর্বতোভাবে। আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে সৌদি বাদশাহ ফয়সালকে মুখের ওপর কড়া জবাব দিয়ে তিনি দেশের এককোটি অমুসলিম জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন। জবাবের দৃঢ়তায় এ কথা স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধুর রক্তে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল বলেই তিনি বিশ্বের শক্তিধর মুসলিম দেশের বাদশাহকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কোন ছাড় দেননি।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমূহ অধ্যয়ন করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙালির একতা। তিনি জানতেন, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির সমতুল্য হয়ে উঠবে একদিন। আর এই একতার চৌম্বকীয় শক্তি ছিল তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মহান স্লোগানে আমরা বলেছি, ' বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃস্টান-আমরা সবাই বাঙালি। এই স্লোগানই বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের বীজমন্ত্র। তিনি নয়া চীনে গিয়ে দেখেছেন, মানুষ ধর্মের আফিম হতে মুক্তি পেয়ে কর্মের চাকায় আবর্তিত হয়ে নির্মাণ করে চলেছে দেশকে। সেই কর্মবাণীই বঙ্গবন্ধু বুকে ভরে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর দেশের জন্যে, জনগণের জন্যে। ধর্মনিরপেক্ষতার নির্যাস দিয়েই তিনি রচনা করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্ন। এ স্বপ্নের চূড়ান্ত গন্তব্য বৈষম্যহীন, দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বাকশালের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের উন্নয়ন রূপকল্প বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু সর্বদাই সতর্ক ছিলেন। তাঁর সেই সতর্কতার নমুনা পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে দেয়া তাঁর ভাষণগুলোতে। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে দেওয়া ভাষণে নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা –আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি’। তিনি আরো বলেন, ‘ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারার শামিল’। ১৯৭৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে যারা ধর্মের ব্যবহার করে তারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যারা মানুষকে ভালোবাসে তারা কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।’ সত্যিকার অর্থেই তাই। যারা মানুষকে ভালোবাসে তারা ধর্মের নামে মানুষকে বিভেদে দীর্ণ করতে পারে না। তিনি তাঁর দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেন,‘তোমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছো। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে।’

(চলবে)

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়