প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
নিষ্ঠুর নিয়তি একটা জীবনে আমাকে বহু মানুষের মুখোমুখি করেছে। বেঁচে থাকার রোজকার লড়াইয়ে অকূল পাথারের অচেনা বহু বাঁকে নানা চেহারার নানা চরিত্রের মানুষকে দেখার এবং জানার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সেসব অভিজ্ঞতা কখনোই সুখকর বা স্বাভাবিক ছিলো না। এক-একটা মানুষ যেনো এক-একটা হৃদয়গ্রাহী আঘাতের নীল পঙ্ক্তিমালা। কিন্তু এই তিক্ততাভরা অভিজ্ঞতার ভিড়ে ব্যতিক্রমী একজন মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলাম। নির্দয় এই সভ্যতায় এখনও কিছু মানুষ আছে, যারা নিষ্ঠুর নিয়মের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অন্তন্ত কোমলতাকে হত্যা করেনি। এখনো যারা বিবেক ও আদর্শের লালন করে। তিনি তাঁদেরই একজন।
সময়টা ছিলো ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। তখন আমি কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসে কর্মরত। পেশাগতভাবে কয়েকটা ফার্মাসিউটিক্যালস্ কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে মোটামুটি অভিজ্ঞ প্রার্থী হিসেবে আমার ডাক পড়ে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসে আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র মেডিকেল প্রমোশন অফিসার হিসেবে কাজ করার জন্যে।
এক উষ্মতম দুপুরে চাঁদপুরের মাটিতে পা রাখলাম। বেলা তিনটার দিকে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের চাঁদপুর রিজিওনাল অফিসে হাজির হই। ভেতরের একটা কক্ষ থেকে ভরাট কণ্ঠে উচ্চস্বরে কথোপকথন শোনা যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, তিনি ফোনে কাউকে যেনো শাসাচ্ছেন। একজনকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানতে পারি এই ভরাট কণ্ঠের লোকটি হচ্ছেন, গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের চাঁদপুর রিজিওনের সিনিয়র রিজিওনাল সেলস্ ম্যানেজার (আরএসএম) মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন। ভেতরে ভেতরে অনেকটা ভড়কে গেলাম। কথাবার্তা শুনে মনে হলো স্যার বেশ রাগী স্বভাবের মানুষ। সেলিং অর্গানাইজেশনে কাজ করার শুরু থেকেই আমি একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশের সন্ধান করছিলাম। কারণ একটি টিমওয়ার্কে পারস্পরিক বোঝাপড়া খুব জরুরি। আর এক্ষেত্রে একজন চৌকষ, দক্ষ, সাহসী ও কোমলপ্রাণ ব্যক্তির নেতৃত্ব একটা ফোর্সকে দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে নিতে সক্ষম। কাজেই আমি সর্বত্রই একটা মমতার বন্ধন খুঁজে ফিরছিলাম। মনে মনে ভাবলাম এখানেও হয়তো সেই পরিবেশটা খুঁজে পেলাম না!
কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পড়লো স্যারের কক্ষে। প্রথম দর্শনেই যে কেউই বলে দিতে পারবেন এই লোক বেশ রাগী এবং রুক্ষ স্বভাবের মানুষ। কিন্তু প্রায় মিনিট বিশেকের আলোচনা শেষে মনে হল যেমনটা ভাবছি ব্যাপারটা হয়তো তেমন নয়। মনে হচ্ছিলো, এ মানুষটা যেনো একটা অচেনা দিগন্ত। যেই দিগন্ত নীলিমায় আবিষ্কার করা যাবে অবাক করা সব বিস্ময়। আর আমি তো আজন্মকালের ধ্বংশ প্রলয়ের খেলায় মত্ত এক সৈনিক। ভেঙ্গে-চুরে নতুন করে গড়া, নতুনকে আবিষ্কার করা আমার রক্তে মিশে থাকা একটা নেশা।
তখন আমি কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসে মোটামুটি ভালো সময় পার করছিলাম। আসলে তখন নতুনকে আবিষ্কার করার নেশা থেকেই এ মানুষটার নেতৃত্বে নতুন পথে পা বাড়াই। গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করার প্রাক্কালে বেশ কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়। এমন জটিলতায় সাধারণত সবাই এড়িয়ে চলেন। কারো দুর্বলতার ভার কেউ কাঁধে নিতে চান না। এর পূর্বের ছয় বছরের পেশাগত জীবনে আমি তেমনটাই দেখেছি। সেই সময় এই মানুষটা সদয় হয়ে সঠিক পথ না দেখালে আমি বেকার হয়ে পড়তাম। একটা অচেনা-অজানা ছেলের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। সেই থেকে এই মানুষটার ছায়াতলে থেকে আজও দু মুঠো ডাল ভাতের লড়াই করে যাচ্ছি। সময়ে অসময়ে যত ঝড়-ঝঞ্ঝায় আক্রান্ত হয়েছি এ মানুষটার সহানুভূতিতেই ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
পেশাগত বিভিন্ন কারণে সবচেয়ে বেশি রুক্ষ ভাষায় আমাকে শাসন করেন বটে। কিন্তু বেলা শেষে তিনিই ছিলেন আমার একমাত্র ভরসাস্থল। একাধিকবার চাকুরি হারিয়ে নিঃস্ব হবার উপক্রম হয়েছিলো। এ মানুষটার সহানুভূতির ফলে বারবার রক্ষা হয়েছে।
দীর্ঘ পাঁচ বছর স্যারের সাথে কর্মরত রয়েছি। এমন শক্ত-পোক্ত একজন মানুষের ভেতরটা এতোটা কোমল হতে পারে তা সত্যি অভাবনীয়। সচরাচর ব্যক্তির বাহ্যিক দিকটা বিবেচনা করে আমরা তাঁর মানসিকতা সম্পর্কে ধারনা লাভ করে থাকি। কিন্তু এ মানুষটার ব্যক্তিত্ব বেশ জটিল। প্রথম দর্শনে তাঁর মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব না। আমি সেই প্রথম থেকেই লক্ষ্য করে আসছি স্যারকে। চেহারায় এবং বেশ-ভূষায় অত্যন্ত দৃঢ় ও কঠোর। বোঝার কোনো উপায় নেই যে এ মানুষটার ভেতরে বিরাজ করে শান্ত-শীতল একটা সরোবর। নেতৃত্বের আশ্চর্য কিছু গুণাবলিতে তিনি অনন্য। একজন মানুষকে কঠোর বাক্যে যেমন শাসন করতে পারেন তেমনি মমতাভরা কণ্ঠে সেই মানুষটার মুখে হাসি ফোটাতেও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হই যখন দেখি, একটা রিজিওনের অর্ধ শতকের বেশি কর্মকর্তার জীবিকার ভার মাথায় নিয়ে, অর্গানাইজেশনের প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও ন্যূনতম হতাশার প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি অকুতোভয় অদম্য সেনাপতির মতো লড়ে যান। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত, চৌকষ ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে চাঁদপুর রিজিওনে আমরা অর্ধ শতকের বেশি ফিল্ড ফোর্স ফার্মাসিউটিক্যালসের বৈরী পরিবেশ মোকাবেলা করে এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছি।
কঠোর পরিশ্রমী এ মানুষটা সকাল থেকে টানা কাজ করে যখন ঘরে ফেরেন তখন তাঁর প্রতিক্ষারত সন্তানেরা কোমলপ্রাণ পিতার উপস্থিতিতে উল্লসিত হয়। এতো কঠোর পরিশ্রম ও মানসিক চাপের ফলে যে কোনো ব্যক্তি তিরিক্ষি মেজাজ ধারণ করার কথা। অথচ ভীষণ কর্মক্লান্ত ও প্রচণ্ড মানসিক চাপ সত্ত্বেও তিনি আশ্চর্যজনকভাবে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ ও বন্ধু-বান্ধব সবকিছু সামাল দিয়ে থাকেন নিপুণ দক্ষতায়, হাস্যোজ্জ্বল চাহনীতে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাঁর তীক্ষè অন্তদৃষ্টি। কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কথা তিনি বুঝে নিতে সক্ষম অতি দ্রুততার সাথে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কারো ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে সক্ষম। সরলপ্রাণ মানুষগুলোর প্রতি তিনি বিশেষত দুর্বল হয়ে থাকেন। সততা ও সরলতাই হচ্ছে তাঁকে জয় করার মোক্ষম কৌশল। পেশাগত ক্ষেত্রে টুকিটাকি মিথ্যা যদিও বলি কখনো তবে তৎক্ষণাৎ তিনি সত্যটা তুলে ধরেন। ফলে তাঁর সাথে মিথ্যা বলা সম্ভব না। আর তাছাড়া তিনি হচ্ছেন সত্যের পূজারী। যতো বড় অপরাধই হোক তাঁর কাছে কেবল সত্যটা বলেই নিস্তার পাওয়া যায়। স্যারের একটা ব্যাপার আমাকে খুবই মোহিত করে। সকাল-সাঁঝে সারাক্ষণ তিনি আমাদেরকে শাসন করেলেও কোম্পানির উপরোস্ত কোনো কর্মকর্তার সামনে তিনি আমাদেরকে খাটো করেন না। বরং তাঁর কোনো কর্মকর্তা জটিলতার মুখোমুখি হলে তিনি তাকে রক্ষা করেন সুকৌশলে। যেনো নিজের সন্তানদেরকে নিজের ঘরেই শাসন করবেন। অন্যের কাছে ছোট হতে দেবেন না। রিজিওনের প্রতিটি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্যাদী তাঁর নখদর্পণে রয়েছে। পেশাগত হাজার ব্যস্ততার মাঝেও তিনি অসুস্থ কর্মকর্তার খবর নিতে ভোলেন না। একজন ব্যাচেলর কর্মকর্তা কোথায় থাকেন, কী খান সব খবরাখবর নিয়ে থাকেন আপনজনের মতো। যে কোনো ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার মতো মানসিক সামর্থ্যে তিনি বলীয়ান। তাঁর নেতৃত্বাধীন ফোর্সের যেনো দুর্বার কাণ্ডারী তিনি। অকূল পাথারে করালগ্রাসী ঢেউয়ের সাথে পাঞ্জা লড়ে তিনি যেনো আমাদের নিয়ে চলেছেন স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপে।
এই মহৎপ্রাণ মানুষটার ব্যক্তিগত জীবন খুব সহজ ছিলো না। যতদূর জানি, বাল্যবেলায় তিনি পিতৃ-মাতৃহারা হয়েছেন। তারপর জীবনের বহু অচেনা আঁধার গলি পাড়ি দিয়েছেন একাকী। নিজেই নিজের পথটা তৈরি করে নিয়েছেন। কখনো কারো ন্যূনতম সহযোগিতা ঝোটেনি। সমস্ত জীবনে একাই লড়াই করে তিনি আজকে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষটি। দুই সন্তান আয়ান-আরোয়াকে আবর্তন করে তাঁর জীবন। পরপোকারী এই মানুষটাকে দেখিনি কখনো কারো প্রতি অমঙ্গলকর বা হিংসাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে। চরম শত্রুর বিপদেও তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন।
চাঁদপুরে কাজ করার প্রথম থেকেই বিভিন্ন কোম্পানি আমাকে কাজ করার জন্যে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে আসছিলো। এ তালিকায় অনেক নামীদামী কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও এ মানুষটাকে ছেড়ে যেতে পারিনি। মাঝখানে কিছুদিন পেশা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারিনি। আমার অভাব-অনটনের কথা শুনে তিনি আবারও আমাকে ডেকে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আমাকে চাকুরিতে পুনর্বহাল করেন।
এমন মানুষের ঋণ কখনো শোধ করা সম্ভব হয় না। এই মানুষটার প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে অকৃত্রিম ভক্তি ও শ্রদ্ধা লালন করি যুগ যুগ ধরে।