প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
সূচনা-সূত্র
বঙ্গবন্ধু দৈহিক উচ্চতায় ছফুট ছাড়ালেও তাঁর কর্ম ও দর্শনের উচ্চতায় তিনি ছাড়িয়ে গেছেন পর্বতের ব্যাপ্তিকেও। তাঁর দর্শনের গভীরতা ও শক্তির কারণে স্বয়ং কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর অবয়বে দর্শন করেছেন হিমালয়। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবির মানুষটি তুষার-স্নিগ্ধতার উপমা নন মোটেই, বরং তিনি সাহসে-শৌর্যে বাঙালির কাছে হিমালয়ের মতোই অটল। বঙ্গবন্ধুর দর্শন শক্তির এক অনন্ত উৎস। এ দর্শনে বিভেদ নেই, নেই কোনো বৈষম্য। বঙ্গবন্ধুর দর্শন অন্তর্ভুক্তিমূলক দর্শন, এটা হিংসার দর্শন ছিলো না। এ দর্শনের মূল কেন্দ্রে ছিলো অসাম্প্রদায়িকতা, তথা ধর্মনিরপেক্ষতা। তাঁর কাছে অসাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ ছিলো বাঙালির শেকড়ের প্রতিমা। বৃক্ষ যেমন তার শেকড়ের ওপরে ভিত্তি করে দাঁড়ায়, পুষ্টি ও বিকাশ লাভ করে, তেমনি তিনিও অসাম্প্রদায়িকতার শক্তি দিয়েই বাঙালিকে আত্ম-প্রতিষ্ঠার ও আত্ম-অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিজয়ী করে তুলেছেন। তিনি জানতেন, ‘একতায় উত্থান, বিভেদে পতন’। তাই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সুসংহত করেই তিনি বাঙালিকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের প্রবহমান স্রোতস্বিনীতে পরিণত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে অসাম্প্রদায়িকতার মৌল ভূমিকার কারণেই তাঁর আন্দোলন-সংগ্রামে মানুষের ঢল নেমেছিলো অপ্রতিরোধ্য হয়ে। তাঁর দর্শনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অবস্থানকে আমরা সূর্যের সাদা রশ্মির সাথে তুলনা করতে পারি। সূর্যের সাদা রশ্মিতে যেমন সাতটি বর্ণ তথা বেগনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লালের সহাবস্থান থাকে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনাতেও সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান সুস্থিত হয়ে আছে এবং সামষ্টিকভাবে তারা সূর্য্যরে রশ্মির মতোই এক ও অনন্য পরিচয় ‘বাঙালি’ বলেই বিকশিত হয়েছে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ‘যত মত তত পথ’ এ অমৃতবাণী বঙ্গবন্ধু লালন করতেন হৃদয়ে। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি সকল বিশ্বাসকে অটুট রেখে সবাইকে বাঙালি জাতিসত্তার ছাতার নিচে সঙ্ঘবদ্ধ করে রচনা করেছেন তাঁর অমোঘ বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর এই দর্শনজাত বাণীই হয়ে গেছে বাঙালির ভবিষ্যত বিনির্মাণের অমূল্য পাথেয়।
বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ ছিলো ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার রক্ষা-কবচ। তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই সকল ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার। মুসলিম যেমন তার ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিবে না, তেমনি হিন্দুও তার ধর্ম পালন করবে বাধাহীনভাবেই। একই কথা বৌদ্ধ এবং খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একথা তাঁর মুখের কথা নয়, তিনি তাঁর কর্মে ও চেতনায় বার বার অসাম্প্রদায়িক দর্শনের প্রতিফলন ঘটিয়ে গেছেন। এমনকি ঊনিশশো ছাপ্পান্ন সালে প্রণীত শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ ঘোষণা করা হলে বঙ্গবন্ধু এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, ‘পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি হয়নি।’
বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে মধুমতী-বাইগার বিধৌত পাটগাতী ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু শৈশবেই অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধরকে, যাঁর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অটুট ছিলো রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময়েও। এরপর একে একে পণ্ডিত সাখাওয়াতউল্লাহ্, হামিদ মাস্টার কিংবা মৌলভী স্যারের পাশাপাশি তাঁর শিক্ষার বুনিয়াদ তৈরিতে শিক্ষক শ্রদ্ধেয় গিরিশ চন্দ্র, নারায়ণবাবু, রসরঞ্জন, মনোরঞ্জন প্রমুখের নাম করা যায়, যাঁরা তাঁকে নির্মাণ করেছিলেন জ্ঞানের আলোর শক্তিতে। তাঁরা তাঁর অন্তর্চক্ষুকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। শৈশবে গুরুসদয় দত্ত প্রবর্তিত ব্রতচারী আন্দোলনের তিনি একজন চর্চাকারী ছিলেন, যাঁর মনের মধ্যে ‘বিশ্বমানব হবি যদি/শাশ্বত বাঙালি হ’-এই মূলমন্ত্র পল্লবিত হয়ে উঠেছিলো। শাশ্বত বাঙালি হয়ে ওঠা মানেই আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষরূপে গড়ে ওঠার দীক্ষাই তিনি লাভ করেছিলেন। মাধ্যমিক স্কুলে থাকাকালীনই তিনি সান্নিধ্যে আসেন আরেক অসাম্প্রদায়িক চেতনার বরেণ্য মানুষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর, যিনি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু রূপে আবির্ভূত হন। বাড়ির যে পরিবেশ, তাতে ছোটবেলা হতেই বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। তিনি একজন ভালো মানের গ্রন্থ-পাঠক ছিলেন, যাঁর পাঠবিশ্ব বিরাট ও বিস্তৃত ছিলো। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো দার্শনিক তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিলেন তাঁর মনন-নির্মাতা। রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মত্রাণ’ কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছিলো আর নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি ছিলো তাঁর মুখস্থ। আলবেরুনীর ‘ভারততত্ত্ব’ তাঁকে যেমন চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে তেমনি রিডার্স ডাইজেস্ট তাঁকে সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে রাখতো সর্বদাই। তিনি সাপ্তাহিক বসুমতী, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পাঠে যেমন মনের উদারতাকে সুস্থির করেছেন, তেমনি কারাগারে রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ পড়তে না পারার আক্ষেপে দগ্ধ হয়েছেন। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ তাঁকে পথ দেখাতো কারার আঁধার প্রকোষ্ঠে আর এমিল জোলার ‘তেরেসা রেকুইন’ জাতীয় উপন্যাস তাঁকে জীবনঘনিষ্ঠ চিন্তায় শাণিত রাখতো সর্বদা। তাঁর সনাতন বন্ধুর কাকীমার আচরণে তিনি দুঃখ পেলেও কারাগারে চন্দ্র বাবুর সাহচর্য তাঁকে সে দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। সুরেন্দ্রনাথ মৈত্ররা তাঁকে কৈশোরে কারাগারের ভাত খাওয়ালেও গীতালি দাশগুপ্তের মতো শিক্ষকেরাই তাঁর বাড়িতে শিক্ষার দীপ জ্বালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এভাবে শৈশব হতেই খোকারূপে শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিলো গ্রামবাংলার সোঁদামাটির ঘ্রাণ গায়ে মেখে। (চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]
* লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]