মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ভাষাকন্যা হামিদা রহমান
অনলাইন ডেস্ক

নাম : হামিদা রহমান,

জন্ম : ২৯ জুলাই ১৯২৭, যশোরে,

মা : বেগম লুৎফুন্নেছা,

বাবা : শেখ বজলুর রহমান,

মৃত্যু : ১৪ আগস্ট ২০০৫, ঢাকায়,

বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক মর্যাদা বহুবছর ধরে সংগ্রাম আর পুরুষের পাশাপাশি লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। বাদ যায়নি 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবির আন্দোলনেও। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্রীরা, সহযোদ্ধা হয়ে ছিলো আন্দোলন সমাবেশে। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষাকন্যারা দাবি আদায়ে মিছিলে ছিলেন সামনের কাতারে। ১৯৪৮ সালের বলি আর ১৯৫২ সালের কথা বলি ভাষার জন্যে আন্দোলন শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল না। যৌথ ও বিচ্ছিন্ন ভাবে আন্দোলন হয় পুরো বাংলায়।

আজকের স্বাধীন যশোরের রয়েছে বাংলা ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস। স্কুল কলেজের ছাত্র শিক্ষকের মিলিত দাবী, আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল যশোরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ অলিগলি। ১৯৪৭ থেকে '৫২ এ সময়টা রাষ্ট্রভাষা বাংলার লড়াইয়ের মূল সময়। যশোর নাগরিক এম এম বন্ধুর সদস্যরা সে সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে ছিল মুখমুখি। সভা-সমাবেশে অনেক আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন নারীকে দেখা যেতো যিনি মুষ্টিবদ্ধহাত উঁচিয়ে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান দিতে। তিনি আর কেউ নন, তিনিই আমাদের প্রিয় ভাষাকন্যা হামিদা রহমান। যশোরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যাদের নাম স্বর্ণালোকিত ভাবে লেখা তাদের মাঝে হামিদা রহমানের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে আর থাকবেও। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থেকেও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে ১৯৫২ সালের আন্দোলনে সরাসরি উপস্থিত না থাকার মাঝেও রয়েছেন অনেকে, তাদের একজন ভাষাকন্যা হামিদা রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের শিক্ষার্থীরাও গঠন করে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে কাজী আবদুর রউফ যশোরে ভাষা আন্দোলন সংগঠনে সক্রিয় হন। তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এগিয়ে আসেন নারীনেত্রী হামিদা রহমান। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যশোরে 'তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি' নামে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেই পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আলমগীর সিদ্দিকী আর একমাত্র নারী যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন ভাষাকন্যা হামিদা রহমান। হামিদা রহমান কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, ১৯৪৭-৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে হামিদা রহমান দলীয় পরিচয় বাদ দেন। দলের বাইরে এসে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পরবর্তিতে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোর জেলার যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব নিয়ে পুরো দেশে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। আন্দোলন চলাকালীন সময় তার ভূমিকায় শাসক গোষ্ঠী (পুলিশ) এতটাই খ্যাপা ছিলেন যে, তার পুরাতন কসবার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালায়। তিনি একাধারে একজন প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের নেত্রী, ভাষা সৈনিক, বিশেষ কথা-সাহিত্য গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির অন্তর্গত আহ্বায়ক জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রেন্ডের সহসভাপতি ও তখনকার জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা ছিলেন।

দৈনিক জনতার সম্পাদক সাংবাদিক আহসান উল্লাহ এর খালা ছিলেন ভাষাকন্যা হামিদা রহমান। খালাকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘খালার শৈশব কেটেছে যশোর শহরের পুরাতন কসবা এলাকায়, উনাদের একতলা টিনের বাড়ি ছিল। হামিদা খালাকে খুব রাগী মনে হতো। ভয়ে কথা বলতাম না। দূর থেকে দেখতাম শাড়ি পরে বুকে বই নিয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। খালার দুই বোন মহুয়া আর শিরিন ছিল আমার সমবয়সী। তাঁদের দুই ভাই চারু ও পারু একাত্তরে শহীদ হন। ভাষা আন্দোলনে হামিদা খালার ভূমিকার কথা আমি বড় হয়ে জেনেছি। ঢাকার নীলক্ষেতে আমি একবার হামিদা খালার 'জীবন স্মৃতি' বইটা দেখতে পাই। ১০ টাকা দিয়ে কিনেও নিয়েছিলাম। নওরোজ কিতাবিস্তান ১৯৯০ সালে বইটি প্রকাশ করে। বইটি পড়ে হামিদা খালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। ১৯৯৩ সালে আমি হামিদা খালার সঙ্গে তাঁর ঢাকার ধানমণ্ডির বাসায় দেখা করি। আমি তখন যশোর সমিতি ঢাকার 'সাগরদাড়ি' সাময়িকীর সম্পাদক। একটি লেখার কথা ভেবেই তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি তাঁর ভাষা আন্দোলন, সংগ্রামীজীবন, শিক্ষাজীবনসহ আরো সব বিষয় নিয়ে একটি লেখা তৈরি করে দেন।-সংগ্রহীত।

১৯২৭ সালের ২৯ জুলাই যশোরের পুরাতন কসবায় জন্মগ্রহণ করেন ভাষাকন্যা হামিদা রহমান। মা বেগম লুৎফুন্নেছা আর বাবা শেখ বজলুর রহমান। তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয় মাইকেল মধুসূদন গার্লস স্কুল দিয়েই। ১৯৩৮-৩৯ সালে স্কুলে পড়ার সময় রাজনীতিতে হামিদা রহমানের হাতে খড়ি। তিনি ১৯৪২ সালে যশোর মধুসূদন তারাপ্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এবছর যশোরে তিনিই একমাত্র মুসলিম পরিবারের মেয়ে হিসেবে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

ম্যাট্রিক পাশের পরপরেই ১৯৪২ সালে নোয়াখালী নিবাসী সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন হামিদা রহমান। ১৯৪৩ সালে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ তখন একপর্যায়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, আর বিহারের জামসেদপুর ক্যাম্পে বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। এতে করে পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ আই এ ভর্তি হন। তখন তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৫৮ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৫ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাস করেন।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়ে ভাষার জন্য রাজপথে নামেন। ওই বছরই তাঁর নামে হুলিয়া জারি হয়। পার্টি থেকে তাকে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেওয়া হলে তিনি আত্মসমর্পণ না করে আত্মগোপন করেন এবং পার্টির কার্ড ফেরত দেন। বাধ্য হয়ে ১৯৪৯ সালে পারিবারিক কারণে তিনি রাজনীতি থেকে সরে আসেন। যার কারণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিতে পারেননি।

"১৯৪৯ সালে ঢাকার তেজগাঁও ভিলেজ একাডেমির হোম ইকোনমিক কলেজের প্রশিক্ষকের চাকরি নেন। হামিদা ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত চাঁদপুর লেডি প্রতিমা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপিক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে এখান থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরানা পল্টন গার্লস কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে 'গণশক্তি' পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন।"-- (তথ্যসূত্র : ফখরে আলম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, দৈনিক কালের কন্ঠ)

১৯৭০ সালে কলেজের চাকরি ছেড়ে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার দিকে মনোনিবেশ করেন হামিদা রহমান। ভারত বিভাজন বা দেশভাগ হল ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন অধিরাজ্য ভারত ও

পাকিস্তানে বিভক্ত করার ঘটনা। এই বিভাজনটি ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭-এ বর্ণিত হয়েছিল এবং এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। দুটি স্ব-শাসিত দেশ ভারত ও পাকিস্তান আইনত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অস্তিত্ব লাভ করে। দেশভাগের আগেই ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নতুন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু এমন যুক্তিতে কোলকাতার আজাদ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে এম এম কলেজের ছাত্রী হামিদা রহমান ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি ১০ জুলাই ১৯৪৭-এর সংখ্যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। চিঠির অংশ বিশেষ-

"বাঙালি হিসেবে যেমন আমরা পুরো বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর দাবি করেছিলাম, তেমনি আজ বাংলাদেশের বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে দাবি করব না কেন? পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘আজাদের’ পৃষ্ঠায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখে খুবই দুঃখ হয়। পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র। তাই তার ভাষা হবে জনগণের ভাষা। বাংলার সাড়ে চার কোটি লোক যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করে, যে ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করে, সে ভাষা তাদের নিজস্ব ভাষা হবে না, এ-ও কি বিশ্বাস করতে হবে? স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার সঙ্গে তাদের প্রাণের কোনো যোগই থাকবে না, এ-ও কি সত্য হবে?"

ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা ও শিক্ষকতার প্রতি হামিদা রহমানের দুর্বলতা দেখা যায়। জানা যায়, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় হামিদা রহমান কলকাতা এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে মাসিক ছয় টাকা বৃত্তি পান। এই বৃত্তির টাকা দিয়ে তিনি নিজ বাড়িতে একটি স্কুল গড়ে তোলেন। মাদুর, বই, স্লেট, পেনসিল, চক কিনে দেওয়ার পাশাপাশি শিশুদের লেখাপড়া শেখান। যশোরে পুরোনো কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাসহ তিনি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুধু দেশে নয় দেশের বাইরে গিয়েও তিনি শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনে অবস্থান করেন। লন্ডনে অবস্থান কালে সেখানে দুটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। লন্ডন উইমেন্স অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের মেম্বর ছিলেন তিনি। হাউস অব লর্ডস এবং হাউস অব কমেন্স হামিদা রহমান বক্তৃতা দেওয়ার দুলর্ভ সম্মান লাভ করেন।

স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন সময়ে প্রগতিশীল ধারার ছাত্র আন্দোলনের সাথে কাজ করার ফলে সাধারন মানুষের কাছে পৌছাতে পেরেছেন। কাজ করেছেন খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের মুক্তির প্রশ্নে দৃঢ় নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা রেখেছেন। সমাজসেবা এবং নারীমুক্তি আন্দোলনে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা স্মরণযোগ্য। বাংলাদেশ নারী আন্দোলন সংসদের সভানেত্রী এবং কার্যকরী সদস্য হিসাবে ছিলেন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ এবং বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন।

হামিদা রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রী-মিছিলটি মোমিন গার্লস স্কুল থেকে যশোর কালেক্টরেটের সামনে এসে হাজির হয়। এ সময় কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে হামিদা রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই ছাত্রীসমাবেশে বাধা দিতে এগিয়ে আসে। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা পুলিশকে প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা চালান। এ সময় পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং গুলি চালায়। এতে অনেক আহত হলেও কেউ মারা যাননি। হামিদা রহমান আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। কিন্তু পুলিশ সুফিয়া নামে একজনকে হামিদা রহমান ভেবে ধরে নিয়ে যায়।

পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর রাতে ছেলেদের পোষাক পরে যশোর কলেজের বৈঠকে যোগ দেন হামিদা রহমান। তাঁর 'জীবন স্মৃতি' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,

'আমি ও আলমগীর সিদ্দিক যুগ্ম কনভেনর হিসাবে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলি (১৯৪৮)। আমাদের সভাপতি ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি ডা. জীবন রতন ধর। সদস্য ছিলেন উকিল হাবিবুর রহমান, উকিল মসিউর রহমান. অনন্ত মিত্র, জালাল আহমেদ, আফজাল হোসেন প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতের স্থান ১১ মার্চ সমস্ত শহরময় হরতালের ডাক দেয়া হলো। প্রতিটি স্কুল কলেজ সেই ধর্মঘটে যোগ দিল। কেবল দিল না যশোরের মোমিন গার্লস স্কুল ও যশোর জিলা স্কুল। তখন যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন নোমানী সাহেব। তাঁর মেয়ে মোমিন গার্লস স্কুলে পড়ত। সে সক্রিয়ভাবেই সব মেয়েদের ধর্মঘটে যোগ দিতে বাধা দিয়েছিল। আমার আজও মনে আছে নোমানীর মেয়েকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির ওপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলাম। ঠোট কেটে রক্ত ঝরে গিয়েছিল তার, কেউ কেউ বলে তার একটি দাঁতও ভেঙ্গে গিয়েছিল। এই ধর্মঘটের পর আমার নামে ‘হুলিয়া’ জারি হয়। ছাত্রদের নামেও হুলিয়া ছিল। আমরা কজন ছাত্র ছাত্রী মিটিং এ যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের কলেজের বেয়ারা কেশবচন্দ্র সেদিন অত্যন্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কলেজের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে কলেজকে একেবারে অন্ধকার করে দিয়েছিল। ওপরের ঘরে একটি মাত্র মোমবাতি জ্বালিয়ে সেদিন আমরা খুব তাড়াতাড়ি মিটিংয়ের কাজ শেষ করি। হোস্টেল থেকে কেশব একটা পাজামা, একটা সার্ট ও একটা গামছা এনে দিয়েছিল আমাকে। আমি শাড়ি বদলে পাজামা ও সার্ট পড়ে মাথায় গামছা বেধে একটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কলেজের পিছনের দরোজা দিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লাম। ঐ পোশাকে কেউ আমায় সেদিন চিনতে পারেনি।'

স্কুল ম্যাগাজিনে লেখালেখির মধ্য দিয়েই হামিদা রহমানের সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি লেখালেখি চালিয়ে যান তিনি। কলেজ ম্যাগাজিনে তার লেখা 'সর্বহারা' ও 'রিকসাওয়ালা' শীর্ষক ছোটগল্প দুটি প্রকাশিত হলে সুধীসমাজে লেখিকা হিসেবে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।পাকিস্তান ও বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকায় ভাষা আন্দোলন ও নারী অধিকার নিয়ে হামিদা রহমানের লেখা প্রকাশ হয়।

সাহিত্য ও পত্রিকায় লেখালেখির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। যশোর থেকে প্রকাশিত আল মোমিন পত্রিকার তিনি মহিলা বিভাগের সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত নববানী মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ষাট ও সত্তরের দশকে ইত্তেফাক পত্রিকার মহিলা বিভাগে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। 'বিলকিস বেগম' ছদ্মনামে লেখা তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সাহিত্যিক হামিদা রহমান দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক বেগম, দৈনিক আজাদ, সংবাদ, পূর্বাণী, সাপ্তাহিক সেবা, আজকের কাগজ-এর সাথে লেখা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভাগীয় সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- 'নীল চুড়ি', 'বেনারসী', 'বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও তার বিকাশ', 'অধিকার আন্দোলনে নারী সমাজ', 'নারীর নৈর্বাক্তিক কান্না', 'বিলেতের চিঠি', 'নীড় হারা পাখি', 'নীলচুড়ি', 'স্বাতী', ও 'শাহী মহল'।

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ দেশব্যাপি হরতাল কর্মসূচি পালিত হয় এবং এ সময় যশোরে ওই কর্মসূচি সফল করার জন্য অন্যদের সঙ্গে হামিদা রহমান অগ্রগামী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। আন্দোলনে পুলিশ গ্রেফতার চালায়। ১২ মার্চ যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এদিন খবর ছড়িয়ে পড়ে ১১ মার্চ যাদেরকে আটক করে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদেরকে খেতে দেওয়া হয়নি। তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এই খবরে যশোরের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

১৩ মার্চ সকালে মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে ছাত্ররা মিছিল বের করে। হাজার হাজার ছাত্রের এই বিক্ষোভ মিছিলে সাধারণ মানুষও অংশ নেয়। মিছিলের নেতৃত্ব দেন ক্যান্টেন ডা. জীবন রতন ধর, আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার আহম্মেদ সিদ্দিকী, শেখ আমানুল্লাহ প্রমুখ। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে মেয়েদের একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি সংগঠিত করতে তাকে সাহায্য করেন রুবি আহমদ ও সুফিয়া খাতুন। মিছিলটি মোমিন গার্লস স্কুলের সামনে থেকে যাত্র শুরু করে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে চৌরাস্তা হয়ে কালেক্টরেটর ভবনের দিকে এগিয়ে গেলে কোতয়ালি থানার ওসি আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল মিছিলটি প্রতিরোধ করে ভবনে ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু মিলিছকারীরা পিছনে না গিয়ে সামনে এগোতে চেষ্টা করেন। এরপর শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে মেয়েরা সেই সংর্ঘষে অংশ নেন। জনতার সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলার মধ্যে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলে। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও ছাত্র আহত হন। এক সময় ওসি আবদুল জব্বারের কানে একটি ইটের আঘাত লাগে। তার কান ছিঁড়ে লক্ত ঝরতে থাকে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করে। ছাত্র নেতা আলমগীর ছিদ্দীকি এ সময় গুলিবিদ্ধ হন। হামিদা রহমান এবারও রক্ষা পান। ইটের টুকরো সাথে করে আন্দোলনে যাওয়ার বিষয় নিয়ে ভাষাসৈনিক বিমল রায় চৌধুরী বলেন,

"১৯৪৭ সালে যশোর এমএম কলেজের প্রথম ছাত্রী আমাদের গুপি আপা (হামিদা রহমান)। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর শাড়ির আঁচলে ইটের টুকরো থাকত। আমরা সেই ইট পুলিশকে ছুড়ে মারতাম। তিনি খুব সাহসী ছিলেন। তাঁকে থানার বড় বাবুও ভয় পেতেন। আমরা যশোরের ছাত্র-জনতা বাংলা ভাষার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট করেছি। যশোরের ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল একটি সফল আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন গুপি আপা।

আটচল্লিশ সালের জানুয়ারি মাসে যশোরের ছাত্রনেতারা ভাষার দাবিতে একটি বিবৃতি প্রচার করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি শহরের চুড়িপট্টি এলাকার আলমগীর সিদ্দিকীর বাসায় এক জরুরি সভা হয়। ওই সভায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ১৫-২০ জন ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাবেশ থেকে গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এর যুগ্ম আহ্বায়ক হন আলমগীর সিদ্দিকী ও হামিদা রহমান, সভাপতি ছিলেন ডা. জীবন রতন ধর। এরপর ২ মার্চ এমএম কলেজে পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। কিন্তু মোমিন গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের ধর্মঘটে যোগ দিতে দেয়নি ওই স্কুলের ছাত্রী ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে। তখন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ছুটে আসেন গুপি আপা। তিনি কোমরে কাপড় বেঁধে স্কুলে ঢুকে ডিসির মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে ক্লাস থেকে বের করে আনেন। কিল-ঘুষিও দেন। গুপি আপার কারণেই মোমিন গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা ধর্মঘটে যোগ দিতে পেরেছিল।" --- (তথ্যসূত্রঃ ফখরে আলম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, দৈনিক কালের কন্ঠ)

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার দুই ভাই শহীদ হন। ১৯৭১ সালে দৈনিক আজাদ পৈত্রিকায় স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের সম্পর্কে তার গুরুপ্তপূর্ণ তথ্যভিত্তিক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। হামিদা রহমান দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন পরবর্তীতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে ১৪ আগস্ট ২০০৫ সালে ৭৮ বছর বয়সে ঢাকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষাকন্যা হামিদা রহমানের ভাতিজা মোস্তফা আরিফ রহমান বলেন, "আমার তখন ১০-১১ বছর বয়স। ফুফুু আমাকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছেন। আমার হাত ধরে শহীদ মিনারে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, এই শহীদ মিনার আমাদের। আমরাই বুকের রক্ত দিয়ে তৈরি করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে ভাষা আন্দোলনের গল্প শুনিয়েছেন। এমএম কলেজের একটি হলের নাম রাখা হয়েছে তাঁর নামে। সহজে হয়নি। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাদের আরো দাবি, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তাটি পুরাতন কসবায় গেছে ফুফুর (হামিদা রহমান) নামে তার নাম রাখা হোক।"

ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের পরবর্তী সময়ে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে ভাষা-সংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ বলেন, “ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার ফলে সামাজিক অবস্থানের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। আমাদের দেশে কাউকে কোন কৃতিত্বের জন্য সম্মান দেয়া হয় না। তবে ইদানিংকালে দেখা যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ার ফলে ‘ভাষা সৈনিক’, ‘ভাষা কন্যা' বলা হচ্ছে। আমাকে একুশে পদকও দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান আমলে এর জন্য কোন কিছুই বলা হত না।"--- (তথ্যসূত্রঃ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, বইঃ ভাষা-আন্দোলন ও নারী, পৃ. ১৩৯)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়