সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১২ মে ২০২২, ০০:০০

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ও গভর্নরের কার্যালয়
অনলাইন ডেস্ক

কক্সবাজারের একটি বাজারের ইজারা-সংক্রান্ত রিট আবেদনের শুনানিকালে গত ১ মার্চ ২০২২ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের সভাপতিত্বকারী বিচারপতি মামনুন রহমান মন্তব্য করেছেন, ‘বর্তমান জেলা প্রশাসক ব্রিটিশ আমলের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নরের নতুন রূপ।’ বেঞ্চের আরেক বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামান (দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন, ১ মার্চ ২০২২)। উল্লেখ্য, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক যেই দপ্তরে কাজ বা অফিস করেন তার নাম ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয়’।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নামকরণ হঠাৎ প্রাসঙ্গিক মনে হবার কারণ কিছুদিন আগে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে প্রবেশের মুখেই বড় করে সাইনবোর্ড টানানো আছে-‘অধ্যক্ষের কার্যালয়, ...মেডিকেল কলেজ’! একটি মেডিকেল কলেজের অভ্যন্তরে অবশ্যই অধ্যক্ষের দাপ্তরিক কাজ করার আলাদা জায়গা বা অফিস আছে, কিন্তু সেই পদবী উল্লেখ করে মেডিকেল কলেজের নামকরণ করতে হবে কেনো? এমনিতেই সেই মেডিকেল কলেজের একটা সুন্দর নাম আছে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত অনেকেই কাজ করেন। অনুমান করি, আকারে ও আভিজাত্যে যেমনই হোক (হাতেগোনা কয়েকটি পদ ছাড়া) প্রত্যেকেরই কাজের উপযোগী একটি চেয়ার ও টেবিল আছে। সেই বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যদি ‘ভিসির পাঠশালা, ঢাকা’, কিংবা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘উপাচার্যের কার্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট’ রাখা হয়-তাহলে কি সেটা মানানসই হবে?

বাংলাদেশের একটা জেলার নাম চাঁদপুর। সেই জেলায় একটি সরকারি কলেজ আছে, এবং যার নাম ‘চাঁদপুর সরকারি কলেজ’। সেই কলেজের নাম কিন্তু ‘অধ্যক্ষের কার্যালয়, সরকারি কলেজ, চাঁদপুর’ রাখার প্রয়োজন হয়নি। আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি এই কলেজটি অধ্যক্ষ মহোদয়ই পরিচালনা করেন। যদিও কোন অফিস বা কার্যালয় একজন এককভাবে পরিচালনা করেন না, তথাপি আমরা তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যিনি প্রধান তিনিই পরিচালনা করেন।

চাঁদপুর পৌরসভা কার্যালয়ের নাম, ‘চাঁদপুর পৌরসভা’; সেটা ‘মেয়রের কার্যালয়, চাঁদপুর’ নয়। চাঁদপুর জেলা পরিষদের নামও ‘চেয়ারম্যানের কার্যালয়, চাঁদপুর’ নয়। প্রত্যেক উপজেলায় সরকারের প্রশাসনিক কার্যালয়ের নাম, ‘উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স’। এই অফিসের নাম কিন্তু ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়’ নয়! উপজেলা ভূমি অফিসের নামও ‘অফিস অব দি এসি (ল্যান্ড)’ নয়; ‘উপজেলা ভূমি অফিস’ নামে আছে। সব থেকে সুন্দর নাম হচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিসের-‘খামার বাড়ি’। অথচ এই অফিসের নাম হতে পারতো, ‘উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়’। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স বা জেলা প্রশাসন সেবা কেন্দ্রের নাম ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয়’!

জেলা প্রশাসক নামের ইতিহাস ও উৎপত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৭৬৯ সালে সীমিত ক্ষমতাসহ প্রতিটি জেলায় একজন সুপারভাইজার নিযুক্ত হন। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে জেলা কালেক্টর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ব্র্রিটিশ আমলে প্রথম সৃষ্ট পদটির নাম ছিলো ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। কিন্তু পরের বছরই তা বাতিল হয়ে যায় এবং ১৭৮৭ সালে পুনঃপ্রবর্তিত হয়। ১৭৮৭ সালের ২৭ জুন এক প্রবিধানের মাধ্যমে কালেক্টরদের উপর বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। পুলিশ বাহিনীর উপরও তাদের কিছুটা কর্তৃৃত্ব বর্তায়। ১৭৯৩ সালে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর কালেক্টরদের বিচার ক্ষমতা ও পুলিশের উপর কর্তৃত্ব বিলোপ করা হয়।

বাংলায় অবশ্য ১৮৩১ সালে কালেক্টররা পুনরায় বিচার ক্ষমতা লাভ করেন। এরপর থেকে বাংলায় তারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর অথবা শুধু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছেন। ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে উল্লিখিত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিধাটি দ্বারা জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটকেই বোঝানো হয়। কালেক্টর অভিধাটি ভূমিরাজস্ব আইন থেকে উদ্ভূত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সকল জেলার ক্ষেত্রেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদ চালু ছিলো। ১৯৬০ সালের পর পাকিস্তান আমলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নামের পরিবর্তে সারাদেশে ডেপুটি কমিশনার অভিধা পুনরায় চালু করা হয় (বাংলাপিডিয়া, শেষ সম্পাদিত ৫ মে ২০১৪), যা স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও টিকে আছে।

বাংলাদেশের পার্লামেন্ট হাউসের নাম ‘জাতীয় সংসদ ভবন’; এই প্রতিষ্ঠানকে তো আমরা ‘স্পিকারের কার্যালয়’ বলি না। দেশের উচ্চ আদালতের নাম ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’; এই প্রতিষ্ঠানকেও তো আমরা ‘প্রধান বিচারপতির কার্যালয়’ নামকরণ করিনি। সচিবালয়ের খুব কাছেই বিশাল ভবনজুড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অফিস। নামটা সুন্দর, ‘নগর ভবন’। অথচ এটাকে খুব আনায়াসেই করা যেতো ‘মেয়রের কার্যালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন’।

বাংলাদেশ রেলওয়ে হচ্ছে সরকারি মালিকানা ও সরকার কর্তৃক পরিচালিত দেশের একটি প্রধান পরিবহন সংস্থা। এর মুখ্য কর্মকর্তার পদবী হচ্ছে মহাপরিচালক। কিন্তু আমরা এই দপ্তরকে ‘রেলওয়ে মহাপরিচালকের কার্যালয়’ বলি না, বলি ‘রেল ভবন’। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর নামক স্থানে নির্মিত হচ্ছে। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করবে। কল্পনা করি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করার পর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান পদে একজন প্রকৌশলীকে বসানো হলো। তো তখন কি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নাম ‘প্রধান পারমাণবিক প্রকৌশলীর কার্যালয়, রূপপুর’ হয়ে যাবে?

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মতিঝিলে অবস্থিত ৩১তলাবিশিষ্ট এই ভবনে গভর্নরের দাপ্তরিক কাজ করার জন্যে অবশ্যই আলাদা জায়গা বা অফিস আছে। তো সেই গভর্নরকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম যদি ‘গভর্নরের কার্যালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ রাখা হয়, তাহলে কি খুব বেমানান হবে? মুসলিম প্রধান এই দেশে ‘বায়তুল আমান জামে মসজিদ’ নামটি খুব প্রচলিত। ধরি, চাঁদপুর জেলায় এই নামে একটি মসজিদ আছে। যেহেতু মসজিদে ইমামই প্রধান ব্যক্তি এবং তাঁর নেতৃত্বে মসজিদের কাজ পরিচালিত হয়, কাজেই সেই মসজিদের সাইনবোর্ডে কি ‘ইমামের কার্যালয়, বায়তুল আমান, চাঁদপুর’ লেখা হবে?

দেশে মন্ত্রণালয় হতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সরকারি অফিসের সংখ্যা ৪৬৬৫৪টি। তার মধ্যে মন্ত্রণালয়/বিভাগ ৭০টি ও অধিদপ্তর/দপ্তর ৩৫১টি। বিভাগীয় পর্যায়ের সরকারি অফিস ৪১৬টি, জেলা পর্যায়ে ৪৩৫২টি, উপজেলা পর্যায়ে ১৮১৬৭টি এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারি অফিসের সংখ্যা ১৮২১৬টি (বাংলাদেশ.গভ.বিডি, ৮ মার্চ ২০২২)। এর মধ্যে অধিকাংশ অফিসের নামকরণ স্থান, কার্যাবলি, উদ্দেশ্য, উৎপাদন, সেবার ধরণ বা সেবা গ্রহীতাদের প্রাধান্য দিয়ে করা হয়েছে। শুধু অল্প কিছু সরকারি অফিসের নামকরণ আমিত্ব বা ব্যক্তির প্রাধান্য দিয়ে করা হয়েছে, বা হয়ে গেছে।

অফিস অফ দি কন্ট্রোলার জেনারেল অফ একাউন্টস, অফিস অব দি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মস, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজ, কন্ট্রোলার জেনারেল ডিফেন্স ফাইন্যান্স, কারখানা ও স্থাপনা পরিদর্শক, প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ কিছু সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিস্থানের নাম ব্যক্তি বা তাঁর পদবীকে প্রাধান্য দিয়ে করা আছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে এই অল্প কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ সত্যিই আমাদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গভর্নরদের কথা মনে করিয়ে দেয়!

ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে বের হবার এই সময়ে এসে যদি আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষরা নিজেদের পদবী দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে উপস্থাপন করতে শুরু করেন (যেই অভিজ্ঞতার কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি), তাহলে আর বাকিরা পিছিয়ে থাকবেন কেনো? মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি গভর্নরকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা প্রত্যাশা করি, আমিত্ব বা ব্যক্তির প্রাধান্য থেকে সরে এসে, জনগণের সেবা প্রদানের জন্যে প্রতিষ্ঠিত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সব সরকারি, আধা-সরকারি দপ্তরের নাম প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি, উদ্দেশ্য, উৎপাদন, সেবার ধরণ বা সেবাগ্রহীতাদের প্রাধান্য দিয়ে পরিবর্তন করার উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করবেন।

নজরুল ইসলাম : লেখক ও এমফিল গবেষক (শিক্ষা), স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়