প্রকাশ : ১২ মে ২০২২, ০০:০০
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি আর ঈদ মানে আনন্দ ভাগাভাগি করার উত্তম একটি দিন। প্রচলিত এই কথা শুধুমাত্র দেশে থাকা মানুষদের জন্যে মানায়। আমরা যারা দেশান্তরে তাদের জন্যে এ-কথা নহে। আমার কাছে ঈদ মানে বেদনার গাংচিল। ঈদ আসলে সুন্দর স্বপ্নরা দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়। ফেলে আসা সোনালি অতীত নিমিষেই মন খারাপের দেশে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আনন্দ রূপ নেয় নিরানন্দে। বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রবাস থেকে ঈদের বার্তার এ স্মৃতিচারণ। সুখণ্ডশান্তি আর সমৃদ্ধি খোঁজে আমরা পরবাসী। আমাদের প্রেরিত অর্থ নিজ পরিবারের মাঝে হাসি ফোটে আর দেশের অর্থনীতির চাকা বেগবান হয়।
২.
আমরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্যে যতোই ঘাম জড়াইনা কেনো আমাদের সুখের আর নিরাপত্তার যেনো কোনো বালাই নেই। যার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই বিমানবন্দরে হয়রানি, লাগেজ খুঁজে না পাওয়া, জমি নিয়ে প্রতারণার শিকারসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রবাস থেকে দেশে গেলে। মন্ত্রী থেকে উচ্চ পদস্থ সকল কর্মকর্তা বিষয়টা জানেন, তবু যেনো প্রতিকার নেই। এটাই আমাদের দীর্ঘ প্রবাসজীবনের সুখ। তবে কি এ রকম সুখের আশায় প্রায় দেড়কোটি বাংলাদেশি দেশান্তর। বার থেকে চৌদ্দ অথবা কোনো সময় ষোল ঘণ্টা কাজ করতে হয় প্রবাসে। সেই ঘাম জড়ানো অর্থ দেশে পাঠাই পরিবার এবং নিজে ভালো থাকার জন্যে। কিন্তু কারণে-অকারণে ভালো থাকা হয়ে উঠে না। আমরা ইতোমধ্যে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করলেও একটু সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হতে পারিনি। ঈদ আসলেই এই স্মৃতিগুলো বড্ড পীড়া দেয় মনে।
৩.
ঈদ আসে ঈদ যায় এর মাঝে সুখ-দুঃখের কাহিনি আমরণ পর্যন্ত থেকে যাবে। প্রবাসের ঈদ আমার কাছে একেবারেই সাদামাটা। যদি এক কথায় বলি ঈদ মানে ঈদ নয়। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি দেশে ঈদ করা হয় না। শেষ ঈদ দেশে কবে করা হয়েছে মনে নেই। তবে ঈদের সুখ-দুঃখ এখনও মনে বিরাজমান, যা প্রায়ই মনে পড়ে আর বোবা কান্নায় বুক ফাটে। শান্ত¡না দিই ওরে মন প্রবাস তো এমনই। কাছে নেই আত্মীয়, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব দেশের মতো একে অপরের বাসায় দাওয়াতের ধূম নেই, যা ঈদের মাঝে বাড়তি আনন্দ জোগায়। এটাও সত্য, প্রবাসে হয়ে উঠে না অনেক কিছু কর্মব্যস্ততার কারণে। কিন্তু কারো কোনো আন্তরিকতার কমতি নেই। নানা ব্যস্ততায় ক্রমশ আপন মানুষগুলো পর হয়ে যায়। এরই নাম প্রবাস।
৪.
আমরা যারা ইউরোপ-আমেরিকাসহ নন-মুসলিম দেশে অভিবাসী তাদের বেশির ভাগ প্রবাসীদের প্রায় একই সমস্যা। ঈদের দিনও কাজ করতে হয়। আর আমাদের কাজগুলোর সময়সূচি ভোর থেকে শুরু হয়। অনেক সময় ঘুমের ঘাটতি নিয়েই আবার পরের দিন আমাদের কর্মস্থলে যোগদান করতে হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষ তেমন জানে না ঈদ কি। তবে যতোটা না ঈদকে জানে তার চেয়ে বেশি চিনে রমজানকে। আমরা যারা রোজায় পানাহার বন্ধ রাখি এ রকম দৃশ্য তাদের নজরে আসে ফলে প্রতি বছর রমজানের পূর্বে সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করে কবে থেকে রোজা শুরু। এ ব্যাপারটা বেশ আনন্দ জোগায় যে আমাদের উত্তম একটি মাসের খবর তারা রাখেন। যেহেতু পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই যার ফলে ঈদের মতো এসব উৎসবে সরকারি বা বেসরকারি কোনো ছুটি থাকে না। কর্মস্থলের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগতভাবে ছুটি নিতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানে আবার ছুটিও পাওয়া যায় না। আবার কেউ আবার কয়েক ঘণ্টার জন্যে ছুটি নিয়ে ঈদের নামাজ শেষ করে ভোঁদৌড় দিতে হয় কর্মসংস্থানে যাওয়ার জন্যে। এসব দেশে আরেকটি সমস্যা হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট ছুটির দিন থাকলেও ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সপ্তাহের যে কোনো একদিন ছুটির দিন নির্ধারণ করে। এর ফলে ঈদের দিনে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয় ছুটি নিয়ে। গত বছর করোনার মধ্যে ঈদ উদ্যাপন করতে হয়েছে প্রবাস জীবনের সবচেয়ে সাদামাটা ঈদ কোনো রকম নামাজ আদায় করে যে যার যার মতো স্থান ত্যাগ করতে হয়েছে। কারণ সরকারের কিছু নিয়ম বেঁধে দেয়ার ফলে কেউ কারো সাথে আলিঙ্গন বা কুশল বিনিময় করতে পারেনি। স্বাভাবিক ঈদে যেখানে আনন্দ নেই জটিল পরিস্থিতিতে কি আর আনন্দ হবে। প্রবাসে দেশের মতো যে উৎসবমুখর পরিবেশ তা কোনো জনমেই পাওয়া যাবে না এমন চিরন্তন সত্য মেনে বাকি জীবন প্রবাসে কাটাতে হবে। এতো কিছুর পরেও বলবো নিরাপদ জীবন নিয়ে বেশ ভালো আছি। ভিনদেশেও কোনো ভয়-সংকোচ ছাড়া একটি নিশ্চিত নিরাপত্তায় জীবন কেটে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপে স্বাধীন ভোগবিলাস করা যায়, যদিও মধ্যপ্রাচ্যে ঈদের আনন্দ আছে কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কোনো স্বাধীনতা নেই। কারণ নিজের পাসপোর্টটা পর্যন্ত মালিকের কাছে রেখে দিতে হয়। আমার এক যুগের বেশি ইউরোপ জীবনে বেশির ভাগ ঈদ হয়েছে কর্মদিবসে যার ফলে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে নামাজ পড়ে আবার কাজে চলে যেত হয়েছে। এই হলো প্রবাস জীবনের ঈদ। এরপরও বলবো ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট থাকুক মুসলিমদের মধ্যে। ধর্ম-বর্ণ সবশেষে যেন শান্তিময় জীবন বর্ষিত হয় দেশ-বিদেশের সবার মাঝে। ঈদুল ফিতরের না বলা কিছু কথার মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে যেনো কোনো প্রবাসী কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে নজর দিলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো সরকারের প্রতি।
জমির হোসেন : সভাপতি,
ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেসক্লাব।