প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২২, ০০:০০
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে বলেছেন, ‘...মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’ বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিলো, শিক্ষা, চাকুরি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে গুরুত্ব পেয়েছিলো পঁচাত্তরের পর সেই ধারা বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়াশীলতা তীব্রতা পায়। ‘বেতার’, ‘চালনা বন্দর’, ‘পৌরসভা’, ‘রাষ্ট্রপতি’ প্রভৃতি বাংলা শব্দ বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ইংরেজির ব্যবহার হতে থাকে।
বর্তমানে একটি গোষ্ঠী প্রত্যহ, প্রতিনিয়ত যথাযথ, ঝলমলে, প্রচলিত, সুস্পষ্ট বাংলা শব্দ-বাক্যকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার মধ্যে বিদেশি শব্দ-বাক্য ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। বিদেশি ভাষার বিশেষ করে ইংরেজি শব্দ-বাক্য বাংলা বর্ণমালায় লিখছেন বা প্রতিবর্ণীকরণ রূপ দিচ্ছেন। আরেকটি শ্রেণি সেগুলোকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাংলা ভাষায় আত্মীকৃত শব্দ হিসেবে ভুক্তি করছেন-স্বীকৃতি দিচ্ছেন। পরিকল্পনা, রাজনীতি, প্রশাসন, বাণিজ্য, শিক্ষা, শিক্ষাক্রম, পাঠদান, কর্মশালা, বিভাগ-অনুষদ, গবেষণা, বিজ্ঞাপন, গল্প-উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, কবিতা, প্রবন্ধ সর্বত্র এবং সর্বস্তরে এ প্রক্রিয়া চলমান। ফলে বাংলা ভাষা দিন দিন নির্বাসিত হচ্ছে, স্বদেশে দ্বিতীয় ভাষায় পরিণত হচ্ছে।
দেশের স্বীকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামের ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার দিন দিন কমছে। বিদ্যালয়ের নাম, দোকানপাটের নাম, রাস্তার নাম, পণ্যের নাম, প্রচার মাধ্যমের নামে ইংরেজির আধিক্য। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম সংক্ষিপ্তকরণেও বাংলার রেওয়াজ নেই। বাংলা ভাষা বিদ্রুপে পড়ছে দৈনন্দিন ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ব্যাংকিং কার্যক্রম, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রহসনের শিকার হচ্ছে বেতার, টেলিভিশন, করোনাসংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, অঞ্চল বিন্যাস, টিকাসংক্রান্ত বার্তা, মুঠোফোন, নিবন্ধনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কাজে। বাধা-বিপত্তি না থাকার ফলে, সর্বস্তরে বাংলার সঙ্গে বিদেশি ভাষার মিশ্রণ, যথোপযুক্ত বাংলা শব্দ বাদ দিয়ে বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকৃত রূপের প্রয়োগ একপ্রকার নিয়মে পরিণত হয়েছে। উপরন্তু অপ্রয়োজনীয় এবং বিশেষ শ্রেণির বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বিশেষ বিশেষ বিদেশি শব্দকে বাংলায় প্রতিবর্ণী করে অভিধানে ভুক্তি করার সহজাত প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। এ অবস্থাকে ভাষার আত্মীকরণ না বলে বাংলার ওপর নৈরাজ্য বলাই শ্রেয়।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সে যুক্তিতেও এক শ্রেণি ইংরেজি বিস্তার করছে। বাস্তবে, উন্নয়নের কাজে একাধিক ভাষার ব্যবহার নানারকম বিঘœ ঘটায়। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় একটি ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে তা যথোচিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়। বাংলাই বাঙালির টেকসই উন্নয়নের মাধ্যম। ইংরেজিই যদি উন্নয়নের প্রধান ভাষা হতো তাহলে কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়ার এতো উন্নয়ন সম্ভব হতো না, উন্নতির প্রসারও হতো না। যদি শুধু বাংলাকে উন্নয়নের ভাষারূপে ব্যবহার করা হয়, তাহলে বাংলা ভাষা দ্রুত মানরূপ পাবে। নতুন শব্দ, পরিভাষা গঠিত হবে। বাক্যসংগঠন ও ভাষার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
অতীতেও বাংলা ভাষার সঙ্গে শত্রুতা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের মাত্রা ভিন্ন। বিদ্যমান ধারায় বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীনতা, মানচিত্র, পতাকা, চেতনা, বিপ্লব, আন্দোলন প্রভৃতি ঐতিহাসিক ও চেতনাদীপ্ত শব্দকে বাদ দিয়েও পরভাষার শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনের সরকার আইন করেছে, সে দেশের ভাষার মধ্যে কোনো বিদেশি ভাষার শব্দ-বাক্য মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান তাদের ভাষা উন্নয়নে জনসচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশে ১৯৮৭, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও শুদ্ধ প্রয়োগের আইন বা হাইকোর্ট এর রুল জারি হলেও বর্তমান সমস্যা সমাধানে এগুলোর কার্যকর দৃষ্টান্ত নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারির এক আলোচনায় বলেছেন, ‘আমরা করপোরেশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার সব সরকারি-বেসরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নামফলক বা চিহ্নফলক অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। কোনো ইংরেজি শব্দ বাংলা বর্ণ দিয়ে লেখা যাবে না।’ করোনা আক্রান্ত অঞ্চল ভাগের ক্ষেত্রেও তিনি বাংলায় লাল-সবুজ অঞ্চল উল্লেখ করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘পরভাষার প্রতি এখনো তোষণ নীতি’ শিরোনামের নিবন্ধে শেখ ফজলুল হক মণি লিখেছেন, ‘আধুনিক পৃথিবী অনেক ক্ষুদ্র হইয়া গিয়াছে এবং প্রতিটি জাতির মধ্যেই সহযোগিতা আবশ্যক। এই কারণে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সমন্বয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য মাতৃভাষার বাইরেও অন্য ভাষা শিখিতে হইবে-এইরূপ প্রয়োজন থাকিতে পারে। তাই বলিয়া মাতৃভাষার চর্চাকে ও উহার প্রচলনকে অবরুদ্ধ করিয়া সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হইবার কথা কল্পনা করা চলে না।’
বাংলা ভাষা প্রচলনের মূলকথা হচ্ছে সর্বত্র ও সর্বস্তরে বাংলা প্রয়োগ। শুদ্ধ-নির্ভুল বাংলার ব্যবহারই যথাযথ পা-িত্য। অকারণে বাংলার সঙ্গে, বাংলার মধ্যে বিদেশি ভাষা মিশ্রণের প-িতমানী জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ করে না। প্রতিবর্ণীকরণের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় যত্রতত্র পরভাষার শব্দের ব্যবহারও বাংলা ভাষাজ্ঞানীর দৃষ্টান্ত হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় অনেক নতুন শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। কিছু ইংরেজির অনুবাদ করে, কিছু পুরনো শব্দ বা ধাতুর ওপর কাজ করে। বাংলা ভাষার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও মহান ব্যক্তিদের অবদানের ফলেই এ ভাষা পৃথিবীর মধুরতম ও উন্নত ভাষাগুলোর অন্যতম। তার শব্দভা-ারও অনেক সমৃদ্ধ।
বাংলা ভাষার সূত্রেই গ্রোথিত বাংলার শোষিত শ্রেণি, প্রগতিশীলতা, স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ, বাঙালির গর্ব ও মৌলিকত্ব। শুধু দেশপ্রেম ও জনসচেতনতামূলক উদ্যোগের ওপর নির্ভর না করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা, উন্নয়ন ও যথাযথ বিকাশে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলা ভাষা বিসর্জনের বর্তমান সংস্কৃতিতে নিজেরাই হেয়ালে-খেয়ালে তাল মিলাচ্ছি কি না সেই আত্মোপলব্ধিও প্রয়োজন। কোনো শ্রেণি সুকৌশলে, সুসজ্জিত উপায়ে প্রচলিত-সুব্যবহৃত বাংলা শব্দ-বাক্যের পরিবর্তে বিদেশি শব্দ ব্যবহারে সগৌরবে উৎসাহ দিচ্ছে কি না তার গবেষণা প্রয়োজন। পুনশ্চঃ সংবিধানে উল্লিখিত ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ অনুচ্ছেদ বজায় রেখে, একক-নির্দিষ্ট রাষ্ট্রভাষার বাংলাদেশে, বাংলা শব্দ-বাক্যকে বাদ দিয়ে বিদেশি ভাষার ব্যবহার শুধু বাংলার সঙ্গে প্রহসন নয়, রাষ্ট্র, সমাজ ও দেশের সঙ্গেও বিদ্রুপতা।
ড. মুহম্মদ মনিরুল হক : শিক্ষা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।