প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২২, ০০:০০
বিশ্বের ইতিহাসে যুগে যুগে ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা স্বীয় দেশ, জাতি ও সমাজকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করেন। তাঁরা রাজনৈতিক অনাচার, কুসংস্কার থেকে সমাজকে তুলে এনে বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তেমনই এক মহাপুরুষের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তিনিই পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি।
মা-বাবা আদর করে শিশুর নাম রাখলেন খোকা। একদিন এই খোকা দুর্বার গতিতে জীবনের প্রতিটি ধাপে নিজেকে অতিক্রম করে খোকা নাম থেকে বহু বিশেষণে বিশেষায়িত হয়ে উঠতে লাগলেন। কী জাদু ছিলো তাঁর মধ্যে! যাঁর স্পর্শে সারা বিশ্বের সমকালীন রাজনীতিবিদ, কবি, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ শ্রেষ্ঠ মনীষীরাই তাঁকে নিয়ে ভেবেছেন ও লিখেছেন! প্রসঙ্গক্রমে ভারতের খ্যাতিমান লেখক নিরঞ্জন মজুমদারের ১৯৭১ সালে লেখা ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধের উল্লেখ করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মায়, কেউ ইতিহাসের একটি পঙক্তি, কেউ একটি পৃষ্ঠা; কেউ বা একটি অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব হচ্ছেন এই সমগ্র ইতিহাস’। এমন সব অসংখ্য স্তুতিবাক্য তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে। আলজেরিয়ায় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময় ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’
বঙ্গবন্ধু ৫৫ বছর জীবনের একটা বড় সময় বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে জেল খেটেছেন। বাঙালির মুক্ত জীবনের স্বপ্নই ছিলো তাঁর আরাধ্য বিষয়। সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেছেন। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা বলেছেন। সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে মানুষকে দুর্নীতি, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে বলেছেন। সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যে তিনি বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে-বিদেশে যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন বাংলায়। দেশের প্রতিটি কাজে ও শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার প্রচলনে তিনি ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট।
মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিলো গভীর ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু শিশুদের বলতেন, পৃথিবীতে যতো ধরনের ভালোবাসা আছে, তার ভেতর দেশপ্রেম হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট। পাকিস্তানের সংসদে শেখ মুজিব বক্তব্য দিতেন বাংলায়। তিনি বলতেন, দুনিয়ার সব দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তব্য দেয়। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিয়ে নিজেদের গর্বিত মনে করি। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাধর নেতা। প্রতিভার গুণেই তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির ভাগ্যবিধাতা। তীক্ষè মেধা আর অদম্য সাহসের জন্যে শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাদের তিনি শুধু চোখেই পড়লেন না, তাঁদের সান্নিধ্য পেয়ে হয়ে উঠলেন বাংলার রাজনীতির যোগ্য কা-ারি। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও সুবিধাবঞ্চিত বাঙালি জাতির জীবনজয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হন তিনি।
তাঁর আহ্বানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সব বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু সেদিন ১০ লক্ষাধিক জনতার সামনে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃত। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর ত্রিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক শাসকগোষ্ঠীর এই বর্বরোচিত হামলায় বহু মানুষ হতাহত হয়। এমন পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি রাষ্ট্র স্থান করে নেয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে বিশ্ব ইতিহাসের এই মহান নেতা চির উন্নত শিরে ফিরে আসেন নিজের দেশের মাটিতে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ঘাতকরা তাঁকে হত্যা করে। তিনি তো অমর। সময় যতো যাচ্ছে ততো বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর জীবনাদর্শের আলোয় উদ্ভাসিত হবে আমাদের আগামীর পথচলা। তাঁর স্বপ্ন বাঙালির অস্তিত্ব, তাঁর শিক্ষানুরাগ বাঙালির অনুপ্রেরণা। তাঁর সততা ও আন্তরিকতা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথের দিশারি।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।