প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২২, ০০:০০
বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য; সবকিছুর প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা। বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার একটা নির্যাস পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে দেয়া তার ভাষণ থেকে। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাব। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরব, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা।’
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে বেইজিংয়ে আয়োজিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি বা ভাষণেই নয়, আইনসভাতেও বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার পক্ষেও বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন সাহসী ভূমিকা। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো ছাড়াও তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ চান তৎকালীন স্পিকার ওহাব খানের কাছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ না দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ জানান, অন্যান্য সদস্য নিয়ে ওয়াকআউটের হুমকি দেন। ঐ দিন গণপরিষদে তিনি বলেন, ‘আমরা ইংরেজি বলতে পারব, তবে বাংলাতেই আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদি পরিষদে আমাদের বাংলায় বক্তৃতার সুযোগ না দেওয়া হয়, তবে আমরা পরিষদ বয়কট করব।...বাংলাকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করব।’
১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রকাশ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষা-ভাবনা সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানের সর্ব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ শিক্ষার মাধ্যম রূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে যত শীঘ্রই সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলন করিতে হইবে এবং পকিস্তানের সরকারি ও বেসরকরি সকল প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যবসায় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক জীবনে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের জন্য কার্যকরী উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে এবং সকল প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।’
স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনা করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে-এ কথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমার ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু যে কতটা আন্তরিক ছিলেন, ওপরের আলোচনা থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।
সম্প্রতি একটি গোলটেবিল আলোচনায় আমি অংশগ্রহণ করি। স্থানটি ছিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার কার্যালয়। সেখানে আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ইংরেজির একটি নামকরা পত্রিকার সম্পাদক। আমার বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে তাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘মহোদয় আপনি তো দীর্ঘদিন ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু আপনি যখন ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নটি আপনার অবচেতন মন কোন ভাষায় দেখে ইংরেজি নাকি বাংলায়? তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন-বাংলায়।’ তিনি যথার্থই সত্য কথা বলেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর মাতৃভাষায় কথা বলার দক্ষতা ১০০ ভাগ অর্জিত হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার বিষয়টি সব সময় প্রাকৃতিক ও স্বয়ংক্রিয়। এর জন্য কোনো শিক্ষক বা আলাদা কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না।
‘গণিত শিক্ষার্থীদের গণিতের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর মাতৃভাষার প্রভাব’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ পড়লাম। গবেষণার প্রয়োজনে ৩০ জন করে দুটি গ্রুপকে গণিত শেখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। একটি গ্রুপকে ঐ দেশের মাতৃভাষায় গণিত শিক্ষা দেওয়া হয়। অন্য গ্রুপকে ইংরেজি ভাষায় একই গণিত প্রথম গ্রুপের সমান সময় ধরে শেখানো হয়। গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, মাতৃভাষায় যারা শিখছে তাদের গাণিতিক সমস্যা অনুধাবন ও সমাধানের জ্ঞান ইংরেজিতে শেখা গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি। এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে গবেষকগণ একটি পর্যবেক্ষণ টেবিলও প্রবন্ধটিতে সংযোজন করেছেন।
বর্তমান পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যার উৎকর্ষ নির্ভর করে দক্ষ ও মানসম্পন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রামারের ওপর। দক্ষ ও মানসম্পন্ন প্রোগ্রামার হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে গণিত বিষয়ে পারদর্শিতা। কম্পিউটার প্রোগ্রামে পারদর্শী পৃথিবীর প্রথম ১০টি দেশ-চীন, রাশিয়া, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, তাইওয়ান, জাপান, ফ্রান্স, চেক-রিপাবলিক ও ইতালি। গণিতের পারদর্শিতার বিশ্ব মাপকাঠিতে দেশগুলোর অবস্থান এক থেকে ত্রিশের মধ্যে রয়েছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে দেশগুলোর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যম কিন্তু মাতৃভাষা। আমার মতে, এজন্যেই দেশগুলো গণিতের পারদর্শিতায় বিশ্বসেরা।
রাসেল কুপার লিখিত একটি গবেষণা রিপোর্টের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ‘ছয়টি দেশ দারিদ্র্যকে মোকাবিলা করছে মাতৃভাষায় শিক্ষা দ্বারা’-শিরোনামে রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়-নেপাল, বলিভিয়া, জিম্বাবুয়ে, মাদাগাছকার, রুয়ান্ডা ও জাম্বিয়া তাদের দারিদ্র্যকে মোকাবিলা করার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাকে নীতিগতভাবে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছে। গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশন ভিডিও অনুসারে ১৭১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার বাইরে বেরিয়ে আসবে যদি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব উপজাতির শিক্ষার্থী তাদের স্কুল শেষ করে শুধু মাতৃভাষায় পড়ার দক্ষতা নিয়ে। বেশি দূরে নয়, নিজ মহাদেশের রাষ্ট্র চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকালেই প্রমাণ পাওয়া যায়, সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের জাদুকরি শক্তি। পিতার ভাষা দর্শনের অনুসারী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেসকো। কিন্তু ইতিহাস বলে, সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের অগ্রতির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয় নিরন্তর। কবি জিওফ্রে চসারের আগে ইংল্যান্ডের রাজকীয় ভাষা ছিল ফরাসি। ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণি ফরাসি ভাষায় কথাবার্তা বলে আভিজাত্যের গৌরব অনুভব করতেন। কবি চসার প্রথম ফরাসি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ক্রমে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং ইংরেজ কবিরা ফরাসি ছেড়ে স্বদেশি ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। এভাবেই ইংরেজি ভাষা হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের সর্বস্তরের মানুষের ভাষা। বাংলা ভাষাকেও এ পথেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষার অন্তভুর্ক্তি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণামুখী জাতি গঠনের এক অদৃশ্য শক্তি। তাই তো দ্বিধাহীনকণ্ঠে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাষা দর্শন ছিলো সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রকৃত নির্দেশিকা।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।