সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে মাতৃভাষা
ড. মোঃ নাছিম আখতার

বেশি দূর নয়, নিজ মহাদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। দেখবেন সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের সাফল্য। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন নামের রাষ্ট্রগুলো তাদের সর্বস্তরে মাতৃভাষাকে লালন, ধারণ ও প্রতিষ্ঠিত করে বৈশ্বিক উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে অগ্রসরমাণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়া নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৪৮ সালের ১৫ আগস্ট।

দক্ষিণ কোরিয়া তার যাত্রা শুরু করে নিজের মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে। ৩৮ হাজার বর্গমাইল আয়তনের দেশটি তার পাঁচ কোটি মানুষের জন্যে বিশ্বের জ্ঞানভা-ারকে মাতৃভাষায় রূপান্তর করে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার প্রতিটি ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রচলন করতে সমর্থ হয়। এর ফলে জ্ঞানচর্চা ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে থাকে দেশটিÑপরিণত হয় শিল্পোন্নত দেশে। ২০২০ সালে দেশটির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিলো ৩১ হাজার ৬৩৭ ডলার। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রাণভোমরা হলো গণিত। গণিতের উৎকর্ষে দক্ষিণ কোরিয়া সপ্তম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরিতে বিনিয়োগ না করে গবেষণা, উদ্ভাবন ও শিল্পের উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। নিজেদের উৎকর্ষ সাধনে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের পথে হাঁটে। জাপানিরা সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারে যতœবান ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। এক লাখ ৪৫ হাজার ৯৩৭ বর্গমাইল আয়তনের সাড়ে ১২ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটি পৃথিবীর জ্ঞানভা-ার তাদের নিজ ভাষায় রূপান্তর করেছে। একটু খেয়াল করুন দেখবেন জাপানও গণিতের পারদর্শিতায় পৃথিবীতে ষষ্ঠ। জাপানের বর্তমান মাথাপিছু আয় ৪৪ হাজার ৫৮৫ ডলার।

২০২১ সালের ৩০ জুন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম ‘গবেষণায় চীনকে টপকাতে যুক্তরাষ্ট্রে আইন পাস।’ খবরে প্রকাশ, বর্তমান সময়ে গবেষণায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অগ্রসরমাণ। বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী দেশ হিসেবে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথার কারণ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনে ফান্ড বৃদ্ধি ও গবেষণার সুযোগ বাড়াতে নতুন একটি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল সচিবালয় চালুর কথা বলেন।

এশিয়ার দুটি দেশ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। তাদের একটির উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ভাষা মাতৃভাষা, অন্যটির উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ভাষা ইংরেজি। মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে যে দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে, তারাই গবেষণায় আমেরিকাকে পেছনে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে অগ্রসরমাণ দেশটির তুলনায় চীনের মাথাপিছু আয় পাঁচ গুণ বেশি। অথচ পড়ুয়া জাতি হিসেবে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করা দেশটি এগিয়ে আছে। উল্লেখ্য, তারা পড়ুয়া জাতি হিসেবে পৃথিবীতে প্রথম। তবু তাদের গণিত ও বিজ্ঞান উৎকর্ষের মাপকাঠিতে পিছিয়ে। প্রগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (পিআইএসএ)-ইকোনমিক করপোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর উদ্যোগে পৃথিবীর ৮০টি দেশের ১৫ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতা। এটি প্রতি তিন বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় ২০১৮ সালে চীন প্রথম স্থান অধিকার করে। ওই তালিকাটি পর্যবেক্ষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, তা হলো যে দেশগুলো তাদের মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়েছে তাদের অবস্থান তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই ১ থেকে ৭২ অবস্থানের মধ্যে নেই। একটু খেয়াল করুন দেখবেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ইংরেজি ভাষায় করা হয়। গবেষণায় গতি সঞ্চারের নেপথ্যের শক্তি গণিত এবং গণিতে পারদর্শিতার মাধ্যম মাতৃভাষা।

গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর মাতৃভাষায় কথা বলা ও বোঝার দক্ষতা ১০০ শতাংশ অর্জিত হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার বিষয়টি সব সময় প্রাকৃতিক ও স্বয়ংক্রিয়। এর জন্য কোনো শিক্ষক বা আলাদা কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না।

‘গণিত শিক্ষার্থীদের গণিতের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর মাতৃভাষার প্রভাব’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ পড়লাম। গবেষণার প্রয়োজনে ৩০ জন করে দুটি গ্রুপকে গণিত শেখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। একটি গ্রুপকে ওই দেশের মাতৃভাষায় গণিত শিক্ষা দেওয়া হয়। অন্য গ্রুপকে ইংরেজি ভাষায় একই গণিত প্রথম গ্রুপের সমান সময় ধরে শেখানো হয়। গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, মাতৃভাষায় যারা শিখছে তাদের গাণিতিক সমস্যা অনুধাবন ও সমাধানের জ্ঞান ইংরেজিতে শেখা গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি। এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে গবেষকরা একটি পর্যবেক্ষণ টেবিলও প্রবন্ধটিতে সংযোজন করেছেন।

বিশ্বের আনুমানিক সাত হাজার ভাষার মধ্যে মাত্র ২৫টি ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে বাংলা ভাষা একটি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। পিতার ভাষা দর্শনে অনুসারী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টা ও উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেসকো। কিন্তু ইতিহাস বলে সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের অগ্রগতির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয় নিরন্তর। কবি জিওফ্রে চসারের আগে ইংল্যান্ডের রাজকীয় ভাষা ছিল ফরাসি। ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণি ফরাসি ভাষায় কথাবার্তা বলে আভিজাত্যের গৌবর অনুভব করতো। কবি চসার প্রথম ফরাসি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং ইংরেজ কবিরা ফরাসি ছেড়ে স্বদেশি ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। এভাবেই ইংরেজি ভাষা হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের সর্বস্তরের মানুষের ভাষা। বাংলা ভাষাকেও এ পথেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্তি হতে পারে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণামুখী জাতি গঠনের জাদুকরী শক্তি।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়