সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রত্যাশা
সুধীর বরণ মাঝি

একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না! দুর্ঘটনা কোনো মানুষেরই কাম্য নয়। দুর্ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত অপ্রীতিকর। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে জাতির কাছে এক মহা আতঙ্কের নাম। বাসা থেকে বের হওয়ার পর পুণরায় সুস্থভাবে ফিরবে কি-না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের জন্যে যেমন সারাজীবনের কান্না ঠিক তেমনি একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র কখনো কখনো সারা বিশে^র জন্যেও অপূরণীয় ক্ষতি। দুর্ঘটনায় ঝড়ে যাচ্ছে বর্তমান এবং আগামীর অনেক সম্ভবনা। পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে যেখানে বাংলাদেশের মতো এমন অনাকাক্সিক্ষত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেক বেশি। যা আমাদের গোটা ব্যবস্থার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনের একটি ভয়াবহ অভিশাপ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দেশের সড়কগুলো একটি মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই যেদিন কোনো সড়ক দুর্ঘটনা নামক মৃত্যুপুরির সংবাদ পাওয়া যায় না। প্রতিদিনই আমাদের সড়কগুলোতে যন্ত্রদানবের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দেশের বহু জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষক, নিষ্পাপ শিশু থেকে বৃদ্ধ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে একদিকে যেমন কেড়ে নিচ্ছে বহু জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবীর প্রাণ তেমনি দেশ হারাচ্ছে তার সোনার সন্তান, সম্পদ আর দেশের অমিত সম্ভবনা। এ মৃত্যুপুরির ফাঁদে পড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ অকালে পরপারে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের সড়ক পরিবহনব্যবস্থা দেশের স্বপ্নের কারিগরদের অকালে পৌঁছে দিচ্ছে পরপারে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সড়ক বিভাগ মানুষকে পরপারে পাঠানোর দায়িত্ব নিয়েছে। এ সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে চরম দুঃখ-কষ্টের সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং সাথে সাথে সোনার বাংলার গড়ার স্বপ্নকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যুর অন্যতম ঘাতকও। অসুস্থ রাজনীতির বিষাক্ত থাবায় দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো পরিবহন সেক্টরেও বিরাজ করছে ভয়াবহ নৈরাজ্য, যা সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। স্বার্থের নীল থাবা আর উদাসীনতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বাংলাাদেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হয় বলে একটি বেসরকারি সূত্রে প্রকাশ যাতে গড়ে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৩৯। দুর্বল আইন ও সরকারের উপযুক্ত মনিটরিংয়ের অভাবের সুযোগ নিয়ে চালক নামের ঘাতকরা রীতিমত হত্যার লাইসেন্স পেয়েছে। এমন অবস্থা এখন নিত্যদিনের চিত্র। অদক্ষ ও আনাড়ি চালকের বেরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, মালিকের স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালিপনা, জনসচেতনতার অভাব, দায়ী চালকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত বিধান না থাকা আবার শাস্তি নিশ্চিত না করা, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ত্রুটিপূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানীক সড়ক, যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামা, আঁকাবাকা সড়ক, সড়কের পাশে যেখানে সেখানে দোকানপাট নির্মাণ, ব্যক্তিস্বার্থের কারণে সড়কের অধিক মোড় ইত্যাদি কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। দুর্বল আইন, উপযুক্ত মনিটরিং এবং সরকারেরর দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কর্তব্যে অবহেলা আর উদাসীনতার সুযোগে চালকেরা রীতিমত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ১৭ বছরে সাড়ে ৭০ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধলক্ষাধিকের অধিক মানুষ মারা যায় এবং আহত ও পঙ্গুত্ব হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক।

বাংলাদেশ পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০০০ প্রাণ বিনাশ হয়, আহত হন ৫০০০ জন। ২০২১ সালে করোনাকালেও সারাদেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন, আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। এতে আরো দেখা গেছে যে, অধিকসংখ্যক দুর্ঘটনা রুরাল এরিয়ায় সংঘটিত হয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক বিশ^রোডে তুলনামূলক কমসংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে রাস্তায় কর্মরত ট্রাফিক পুলিশও দুর্ঘটনায় কবলিত হয়।

বিআরটিএ সূত্রে প্রকাশ, বাংলাদেশে নিবন্ধনকৃত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ এবং লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা মাত্র ৯ লাখ ৬০ হাজার। দেশে প্রায় ১০ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক বা ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক রাস্তায় প্রতিনিয়তই গাড়ি চালাচ্ছেন বলে পরিবহনখাত পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এর চেয়ে নৈরাজ্য ও ভীতিকর অবস্থা আর কি হতে পারে? সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থনেতিক ক্ষতি সাধিত হয়। যা দেশের মোট উন্নয়ন কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান প্রধান কারণসমূহের মধ্যে আছে অদক্ষ চালক, ট্রাফিক আইন না জানা, ট্রাফিক আইন না মানা, দুর্বল ট্রাফিক আইন, সড়কের বেহাল অবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থের প্রতি বেশি মনোযোগ, অবৈধ উপায়ে বা ঘুষের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স লাভ, পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের সংকট, অপ্রতুল ট্রাফিক সাইন, ট্রাফিক আইন এবং সড়ক আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা, অপরিকল্পিত/অপর্যাপ্ত/অবৈজ্ঞানিক/ভাঙ্গা/অপ্রস্ত রাস্তা/অধিক পরিমাণে আঁকাবাঁকা/অধিক ট্রার্নিং, অমনোযোগী/মদ্যপ/তন্দ্রাযুক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, যত্রতত্র যাত্রী উঠানো-নামানো, হেল্পার দিয়ে গাড়ি চালানো, গাড়ি চালনো অবস্থায় ফোনে কথা বলা, অযথা ওভার টেকিং/অযথা ওভারস্পিড/প্রতিযোগিতা, যাত্রী অসচেতনা, যেখানে সেখানে রাস্তা পারাপার, পর্যাপ্ত ওভার ব্রিজের এবং ফুটওভার ব্রিজের সংকট, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, ফিটনেসবিহীন পরিবহন, অসচেতনভাবে লেন পরিবর্তন ইত্যাদি।

কোনো বিষয়ের কারণ চিহ্নিত করতে পারলে সমাধান করা সহজ হয় কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখি আমরা তার উল্টো চিত্র। এখানে কারণ চিহ্নিত করা হলেও সমধান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা, বাড়ছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। আমাদেরকে সড়কের এই মৃত্যুপুরি থেকে দেশের জাতীয় স্বার্থে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা। আইনের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে আইনেকে যুগোপযোগী করে আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং মনিটরিং বিষয়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি সড়কের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। যাত্রীবাহী এবং পণ্য পরিবহনবাহী সকল যানবাহনের ত্রুটি দূর করতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর এবং নিষ্ঠাবান হতে হবে। সড়ক পরিবহন মালিক, ড্রাইভার, শ্রমিক, হেল্পারদের চাপে রাখতে নির্দিষ্ট সময়ের পর রূটপারমিট বাতিল এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করার মতো দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, মালিকরা রাষ্ট্রের চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয়। চলমান পরিবহনগুলোর বার্ষিক সার্ভে সম্পন্ন হওয়ার পর এর ধারাবাহিকতায় রুটিন মেইনটেন্যান্স রক্ষণাবেক্ষণ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। ফিটনেসবিহীন কোনো পরিবহন যাতে সড়কে বের হতে না পারে সেজন্যে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব বলে মনে বিশেষজ্ঞ মহল। ব্যস্ততম সড়কগুলোতে পরিবহনের জন্যে লেন নির্ধারণ করে দিতে হবে। সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। সড়কের পাশে যত্রতত্র দোকানপাট নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, হাট-বাজার, স্থাপনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবহন খাতে মালিক এবং সুবিধাভোগী পরিবহন শ্রমিক নেতাদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ সড়ক সংস্কার এবং ট্রাফিক আইন ও সড়ক আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও রেশরেশি বন্ধে কঠোর আইন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সড়কের মৃত্যুপুরি রোধে সড়কের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা। বর্তমান ও আগামীর বাংলাদেশ হবে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু সেই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়