প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
করোনার কারণে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত বছরের সেপ্টেম্বরে খুলেছিলো। কিন্তু লেখাপড়ায় গতি আসতে আসতেই ওমিক্রনের তা-ব আবার শুরু হলো। সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সরকার সম্প্রতি দুই সপ্তাহের জন্যে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। করোনাকালীন বিগত সময়টিতে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার কোনো বিকল্প ছিলো না। অভিভাবকগণ তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন/ডিভাইস তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার ছলে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক ছেলেমেয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে তা আমরা অনেকেই অবলোকন করিনি। যদিও শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে ছোট শিশুরা করোনার অনেক আগে থেকেই মোবাইল স্ক্রিনে ডিজিটাল গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ডিভাইসপ্রীতি মাদকের চেয়েও ভয়াবহ। যদিও কম্পিউটার ও মোবাইলফোন-নির্ভর ইন্টারনেট প্রযুক্তি বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার এবং এর তাৎক্ষণিক উপকারিতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। করোনাকালে যখন ঘরের বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো, তখন অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়া, ই-বুক পড়া, অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করা, ফলাফল জানা ইত্যাদি সহজেই করা গেছে, এখনো হচ্ছে। বলা চলে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে স্মার্টফোনের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। সব মিলিয়ে মানুষের যাপিত জীবনের অতিপ্রয়োজনীয় একটি অংশ হয়ে গেছে এই স্মার্টফোন।
এতদসত্ত্বেও এই স্মার্টফোনের অপব্যবহার মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেমসে আসক্তি শিক্ষার্থীদের বিকাশে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, দেখা দিয়েছে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ‘স্ক্রিন অ্যাডিকশন’ষ গবেষণায় প্রতীয়মান যে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। ফলে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ফেস-টুফেস ইন্টার-অ্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তাই স্মর্টফোন এবং কম্পিউটারে গেম খেলার নেশাকে মানসিক রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে যাচ্ছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা আইসিডিতে এটিকে গেমিং ডিজঅর্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের কিছু দেশে গেমিং আসক্তিকে ইতিমধ্যে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিটি পরিবারই আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের আচার আচরণ নিয়ে। কোন অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যায়, বাচ্চারা আনন্দ করার চেয়ে ব্যস্ত থাকে মোবাইল নিয়ে। টিকটকের অমুক ভাই তমুক ভাই হয় তাদের আলোচনা বিষয়। দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। স্কুল-কলেজ পাড়া মহল্লায় সেভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠান হয় না আজকাল। বইয়ের আলোচ্য সূচীর বাইরেও যে বৈচিত্র্যময় একটা জগৎ আছে, করোনাকালে তার চর্চা নেই বললেই চলে।
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘক্ষণ টিভির পর্দা, মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাবলেটের মতো ছোট স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব গেম নিয়ে সমাজতত্ত্ববিদ, মনোরোগ চিকিৎসক এবং সাইবার বিশেষজ্ঞগণের চিন্তার কোন অন্ত নেই। কারণ এ ধরনের ভাইরাস গেম হিংসাত্মক আচরণকে প্রশ্রয় দেয়। এমনকি গেমের নিয়ম মানতে গিয়ে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। পাবজির মতো গেম খেলায় শিশুমনে কিরূপ প্রভাব পড়ছে তা কারো অজানা নয়। আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির তিন মনোবিজ্ঞানীর পরিচালিত তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডের এক হাজার ৩২৩ জন ছেলে-মেয়ের ওপর সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব ছেলে-মেয়ে দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি টিভি বা ভিডিও গেম দেখে, তারা গড় হারের দেড় গুণ থেকে দুই গুণের বেশি মনঃসংযোগ সমস্যায় পড়ে। শিশু মনোবিজ্ঞানী ডগলাস জেনটাইলের মতে, ভিডিও গেমগুলোতে দ্রুত দৃশ্য বদল, আলো, শব্দ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের সর্বক্ষণ পরির্বতন ও কম্পন এমনভাবে হয়ে থাকে যে শিশুদের মনে ও মস্তিষ্কে তা স্থায়ী হয়ে যায়। এই অবস্থায় শিশুরা যখন ক্লাসরুমে যায় তখন সেখানে এ ধরনের কিছু না পেয়ে শিক্ষকের নিরস পাঠদানের প্রতি মনঃসংযোগ থাকে না। এভাবে একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অচেনা জগতে হারিয়ে গিয়ে বন্ধুত্বের নামে ভুল পথে চলছে, ডুবে থাকছে দিন-রাত।
ইংল্যান্ডে শিশু বিশেষজ্ঞ স্যালি পেইন তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন ডিজিটাল ট্যাব এবং স্মার্ট ফোন ব্যবহারের অবাধ সুযোগ পেয়ে শিশুদের মধ্যে পেন বা পেন্সিল ধরার এবং তা ব্যবহারের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। একসময় শিশুরা দেখতো তার বাবা-মা পেন দিয়ে বাজারের ফর্দ লিখতেন, এখন তারা দেখে বাবা-মা মোবাইল ফোনে টেক্সট করছে। ২০১৬ সালের অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যেসব ছাত্ররা হাতে লেকচার নোটস লেখেন, তারা পরে সেগুলো অনেক ভালো মনে রাখতে পারে এবং তাদের ধারণা অনেক পরিচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু কম্পিউটার বা ট্যাবে যারা নোটস নেন, তারা অনেক লিখতে পারলেও মনে রাখতে পারে না। ডিজিটাল আসক্তিতে শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবেও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে বিষন্নতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধপ্রবণতা, উদ্বেগ, একাকী থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধত্ব, ভালো কথার নেগেটিভ রিঅ্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উন্মাদনা, কল্পনাশক্তি হ্রাস, স্কুলে যেতে ইচ্ছা না করা, পড়াশোনায় অমনোযোগী, চোখের সমস্যা, ঘুম কম, অতিরিক্ত ওজন ও আত্মকেন্দ্রিক হওয়া ইত্যাদি লক্ষণীয়। স্কুল কলেজগামী ছেলে-মেয়েরা আজকাল যে ধরনের চলাফেরা করে তা সমাজের জন্য যে কল্যাণকর নয় তার প্রমাণ কিশোর গ্যাং, টিকটক কর্মকা-। কয়েক বছর আগেও তরুণদের অপরাধের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি ছিল ‘ইভটিজিং’। এখন আলোচিত শব্দ ‘টিকটক’, দায়ী ওই মোবাইল।
এদিকে ব্যস্ত জীবনের দোহাই দিয়ে বাবা-মা সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারে না। সন্তানরা পরিবার, আত্মীয় পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককভাবে বড় হয়। তাদের সঙ্গী হয় মোবাইল আর ইন্টারনেটের জগৎ। কিন্তু পরিবারের পারস্পরিক বন্ধনের দূরত্ব কোন দিন যন্ত্র দিয়ে ঘুচানো যায় না। সন্তান যখন বিপথে যায় তখন মনে হয়, তার হাতে আদর ভালোবাসার নামে দামী মোবাইল তুলে দিয়ে কতটা ভুল করেছে। তাই সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সাথে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। অনলাইনে সহজলভ্য নানা গল্পের বই পড়ে শোনানো যেতে পারে। অক্ষর চেনা, অংক শেখা, রঙ চেনা—এ ধরনের অনেক শিক্ষণীয় ভিডিও পাওয়া যায় অনলাইনে, এতে শিশুর সময়ও ভালো কাটবে। তাদের হাতে দেয়া ডিভাইসের অ্যাপস, গেইমস এবং অন্যান্য বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখে নেয়া উচিৎ। তাদের কচি মনের জন্য সেগুলো সঠিক এবং শিক্ষনীয় কিনা এবং সর্বোপরি বয়সের উপযোগী কিনা, এসব দেখার দায়িত্ব কিন্তু বাবা-মায়ের। ‘মিনা-রাজু’ ‘সিসিমপুর’, ‘মাই হর্স স্টোরিজ গেম’, ‘হিপহপ’, ‘ব্যালে’ বা ‘জ্যাজ’, ‘ডান্স স্কুল স্টোরিজ’, ‘আইস স্কেটিং’ বা ‘প্রিটি ব্যালেরিনা’, ‘চিয়ারলিডার ডান্স অব চ্যাম্পিয়নশিপ’ ইত্যাদি শিশুতোষ ভিডিওগুলো করোনাকালে শিশুশিক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে আসছে। এগুলো সহ বিভিন্ন সহপাঠ কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং বিনোদনমূলক বই পড়ায় তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা, যা পড়া হলো তা নিয়ে গল্প করতে হবে। এছাড়া ছবি আঁকা, নাচ-গান, গল্প-কবিতা আবৃত্তি, ধর্মকর্মের কাজ, এমনকি বাবা-মার সাথে ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, রান্নাবান্নায়, ছাদে-বারান্দায় বাগান পরিচর্যায়, হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি কাজে সম্পৃক্ত করালে ডিজিটাল ডিভাইসের আসক্তি অনেকটা কমে যাবে।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।