প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
বিশে^র ১১০টি দেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনের (সামিট ফর ডেমোক্রেসি) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘সারা বিশে^ই সংকটের মুখে রয়েছে গণতন্ত্র। বহু দেশে গণতন্ত্রের বিপরীত রাজনীতি শুরু হয়েছে। তাই যেসব দেশে এখনো গণতন্ত্র আছে, তাদের উচিত গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং অন্যদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা’। অনুমান করি, গণতন্ত্রের জন্য মার্কিন মুলুকের এই উদ্বেগ শুধুমাত্র মানুষকে রক্ষা করার জন্য, গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষকে বোকা বানানোর জন্য নিশ্চয় নয়।
একটি দেশ বা তাঁর শাসনব্যবস্থা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন, রাজতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক, সামরিক বা ধর্মতান্ত্রিক। কোন সন্দেহ নেই, বর্তমান পৃথিবীতে সরকার বা শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। কারণ এই তন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণের এবং শাসক বেছে নেয়ার একটা সুযোগ আছে। কিন্তু এই ‘সুযোগ’ নির্ভর করছে গণতন্ত্রকে কিভাবে প্রয়োগ বা চর্চা করা হচ্ছে তার উপর। প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্রের এই প্রয়োগ বা চর্চা কি শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজন করেই করতে হবে?
সর্বকালেই রাজনীতির উঠোনে সবচেয়ে ব্যবহৃত এবং একই সাথে দুর্বোধ্য শব্দ হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। গ্রিক ‘ডেমস’ অর্থাৎ জনগণ, আর ‘ক্র্যাসি’ বা তন্ত্র-এ দুই শব্দ নিয়ে গণতন্ত্রের উদ্ভব। এটা রাজনীতি সচেতন সবাই জানেন। তাহলে গণতন্ত্রের অর্থ দাঁড়াচ্ছে-জনগণ পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। এককথায় বলা যায় ‘জনগণতন্ত্র’। প্রাচীন এথেন্সে প্রায় ৪০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সরকারের রূপ হিসাবে গণতন্ত্র এবং সংবিধানের ধারণা (এবং নামের) উৎপত্তি হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে গণতন্ত্রের শিকড় অনেক গভীরে।
বর্তমানে আমরা বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের যে প্রয়োগ বা চর্চা দেখি, তা কালের বিবর্তনে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। কোন সন্দেহ নেই যে এই বিবর্তন শাসকগোষ্ঠী তাদের সুবিধামতো করে নিয়েছেন। যেমন, আমাদের দেশে এখন গণতন্ত্র বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে-নির্বাচন, নির্বাচনী পোস্টার এবং চায়ের কাপ! চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটা তত্ত্ব আছে, একটি এন্টিবায়োটিক অপ্রয়োজনে, বা প্রয়োজনেই দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে তা মানবদেহে কার্যকারিতা হারায়। এত সময় ধরে সরকার বা শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু আমাদের কখনই মনে হয়নি যে এটার এখন ‘আর.ডি.’ (রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট) করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশের কথাই যদি ধরি, গ্রামে বাস করা একজন নাগরিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিয়ে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচন করেন, একজন সদস্য (মেম্বার) নির্বাচন করেন এবং একজন মহিলা সদস্য নির্বাচন করেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যানকে ভোট দেন, একজন ভাইস-চেয়ারম্যানকে ভোট দেন এবং একজন মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যানকে ভোট দেন। আবার জেলা পরিষদ নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যান পান, একজন সদস্য পান এবং একজন মহিলা সদস্য পান। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্যকে ভোট দেন। যেহেতু সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, সেহেতু সরকার প্রধানও পরোক্ষভাবে তাঁর জনপ্রতিনিধি। আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের কতজন জনপ্রতিনিধি থাকেন?
মার্কেটিং-এ একটি বিষয় পড়ানো হয়, ‘পণ্যের জীবনচক্র’। সেখানে একটা কথা আছে, ‘প্রতিটি পণ্য তার উদ্ভাবন থেকে শুরু করে এর বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রমের মধ্যে দিয়ে এক পর্যায়ে তা পতন বা সমাপ্তি পর্যায়ে এসে পৌঁছায়।’ পণ্যের মতো যে কোন তত্ত্ব বা ধারণারও পতন বা সমাপ্তি ঘটতে পারে। আমাদের সৌরজগতে কতগুলো গ্রহ আছে, তা নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত অনেক তত্ত্ব বা ধারণা পেয়েছি। এমনকি গ্রহের সংজ্ঞাও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে। বিগত একশত বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞান, পেডাগজি, জলজ ও খনিজসম্পদের ব্যবহার, মহাকাশ বিজ্ঞান বা পরিবেশ বিদ্যার তত্ত্ব ও ধারণার পরিবর্তন হয়েছে কতটা? সমাজ কিংবা পরিবার নিয়ে আমাদের চিরায়ত সংজ্ঞার কি কোন পরিবর্তন বা পরিমার্জন হয়নি? অথচ শত বছর পেরিয়ে এখনও আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, মানুষ ভোটে দাঁড়াবে এবং আমরা তাঁদের ভোট দেব-এটাই গণতন্ত্র!
আর গণপ্রজাতন্ত্র হলেই যে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই; সেখানেও ছদ্মবেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন জারি থাকতে পারে। আমেরিকার গণতন্ত্রের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। গত বছরের মার্কিন নির্বাচন ২০২০ ছিল কঠোর সমালোচনা ও প্রশ্নবিদ্ধে ঘেরা। যেখানে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো ক্ষমতার বসার জন্য তার অনুসারীদের প্রতি ব্যাপক চাপও প্রয়োগ করেছিলেন। গণতন্ত্র এবং একনায়কত্বের এমনি পাশাপাশি অবস্থান আমরা দেখব গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডে, ইউরোপে, রাশিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশে। সারকথা, ‘আর.ডি.’ না করার কারণে গণতন্ত্র এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই কার্যকর হচ্ছে না, এন্টিবায়োটিকের মতো!
গণতন্ত্রের রূপরেখার পরিবর্তন বা ট্রান্সফরমেশনের প্রশ্ন আসলেই একটা কথা অহরহ শোনা যায়-গণতন্ত্রের থেকে ভালো শাসনব্যবস্থা হচ্ছে ‘আরো ভালো গণতন্ত্র’। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সরকার ও রাজনীতির কোন শিক্ষার্থীকে গণতন্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি হয়তো উত্তর খুঁজবেন পশ্চিমের কোনো স্কলার বা রাজনীতিবিদের কাছে। হয়তো জ্যাঁ জ্যাক রুশো কিংবা আব্রাহাম লিংকনের উদ্ধৃতি দিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সরকার বা রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছ থেকেও এই ‘আরও ভালো গনতন্ত্র’ এর পরিষ্কার কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্বে আমরা ব্যালট পেপারে সিল দিতাম, এখন ইভিএম ব্যবহার করছি-আরও ভালো গণতন্ত্র বলতে কি এটাই বোঝাচ্ছি?
জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি, সরকার বা সোজা কথায় বললে ‘শাসক’ পছন্দ করবেন, এই ধ্যান-ধারণা সাম্প্রতিক সময়ে অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। ‘একটা গোষ্ঠী আমাকে সমর্থন করছে এবং ভবিষ্যতেও সমর্থন করার সম্ভাবনা আছে, এমন একটা গোষ্ঠীকে মাত্রাতিরিক্ত সুবিধাদি না দিয়ে প্রয়োজনে (নীতি ও নৈতিকতার খাতিরে) তাদের বিরুদ্ধেই আমি কঠোর হব’; অথবা ‘আমার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে আমার বর্তমান মেয়াদের মাত্রাতিরিক্ত সুবিধাভোগীদের আমাকে আবারও ক্ষমতায় আনার জন্য ব্যবহার করবো না’-এগুলো আসলে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, যাদের পরিবার আছে, পরবর্তী বংশধরদের সুবিধা ভোগের সুযোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই কঠিন।
আমাদের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর থাকলেও নির্বাচন পরিচালনা করে মূলত মাঠ প্রশাসন। আরপিও ১৯৭২-এ সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসাবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জেলা প্রশাসককে রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়াটা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিধিত্ব আদেশে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে রিটার্নিং অফিসার মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিসাইডিং অফিসার, সহ-প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ দেন।
বিশে^র অনেক দেশেই আলাদা করে নির্বাচন কমিশন নেই; সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করে। আদতে যেসব দেশে নির্বাচন কমিশন আছে, সেখানেও নির্বাচন পরিচালনা করে সরকারই। আমাদের দেশেও নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই মূখ্য ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসিসহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচন কমিশন শুধু দাপ্তরিক কাজগুলো করেন। নির্বাচন পরিচালনার জন্য আনুসাঙ্গিক দ্রব্যাদি কেনা, বিতরণ করা, নির্বাচনের ফলাফল সংগ্রহ এবং সাংবাদিক সম্মেলন করা যাদের প্রধান কাজ।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অভিযোগ আছে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকার গঠন করে তখনও একই অবস্থা! বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পদ্ধতি চালু থাকলেও ক্ষমতা মূলত কেন্দ্রীভূত। পার্লামেন্টেও গণতন্ত্রের চর্চা সীমিত (দলের বাইরে ভোট দেয়া যায় না)। সেজন্যেই আমাদের দেশে নির্বাচন হচ্ছে একমাত্র ‘ঘটনা’! এবং আমাদের নির্বাচন কমিশন ঘটা করে, সারা বছরব্যাপী, নানা প্রকার নির্বাচন আয়োজন করে। আমাদের কাছে কি এখন মনে হচ্ছে না, এতো এতো নির্বাচন করাই এবং এতো এতো জনপ্রতিনিধি পাওয়াই হচ্ছে গণতন্ত্র!
বাস্তবিকতা হচ্ছে, গণতন্ত্র এখন নির্বাচন আয়োজনকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গণতন্ত্র নিয়ে যে উচ্চ আশাবাদ জেগেছিল সেটা এখন ফিকে। একনায়কতন্ত্র, স্বৈ^রশাসন, পরিবারতন্ত্র, ইত্যাদির উপসর্গ, লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো কম বেশি সব দেশেই প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সামিট ফর ডেমোক্রেসি-তে যুক্তরাষ্ট্র যতই উদ্বেগ প্রকাশ করুক না কেন, গণতন্ত্রের এই ফিকে হবার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ আমেরিকান নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখীনীতি। তারা নিজেদের জন্য প্রতিষ্ঠিত উন্নত গণতন্ত্রকে বাকি বিশ্বের কাছে রফতানি না করে সেটা একটা হাতিয়ার বানিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন গণতন্ত্রের নামে যা চলছে, তা আসলে ‘ইলেকটোরাল অটোক্রেসি’!
আমাদের দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সরকার ও রাজনীতি নিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। অনুমান করি, এদেশে, তাঁদের ছাড়া আর বাকি সব ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরাই রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন ও তত্ত্ব দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু যেহেতু বিষয়টা তাত্ত্বিক, তাই একাডেমিক পলিটিশিয়ানদের কাছে প্রত্যাশা, (আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সেই বহুল ব্যবহৃত সংজ্ঞার বাইরে চিন্তা করে) ‘আরও ভালো গনতন্ত্র’ এর সরূপ কেমন হতে পারে, এবং গণতন্ত্রের রূপরেখার পরিবর্তন বা ট্রান্সফরমেশনের প্রযোজন আছে কি’না—এই বিষয়ে আমাদের ধারণা দেবার চেষ্টা করবেন।
নজরুল ইসলাম : লেখক ও এমফিল গবেষক (শিক্ষা), স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।