প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
যে যুগে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে বাঙালি মুসলমানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করতো, সেই অন্ধকার যুগে বেগম রোকেয়া পর্দার অন্তরালে থেকেই নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী হন এবং মুসলমান মেয়েদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পথ সুগম করেন। উনিশ শতকের শেষদিকে সময়টা ছিলো যুগপৎ হিন্দু ও মুসলমান নারীদের জন্যে অন্ধকার যুগ। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের কঠোর পর্দা মেনে চলতে হতো। বিনা প্রয়োজনে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া ছিলো নিষিদ্ধ। তাদের লেখাপড়া করার তেমন সুযোগ ছিলো না, কেবল ঘরের কাজকর্ম শেখানো হতো। তারা নিজ গৃহে বা স্থানীয় মক্তবে আরবি, ফারসি শিখতো। হিন্দু নারীরাও ছিলো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের শৃঙ্খলা থেকে নারীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন যে কয়েকজন নারী, তাদের মাঝে প্রথমসারির একজন হলেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহীয়সী বেগম রোকেয়া। বহুমাত্রিকতায় অনন্য বেগম রোকেয়া একাধারে দার্শনিক, লেখক, সমাজ সংস্কারক, নারীশিক্ষায় পথিকৃৎ, নারীমুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। বিশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে আবির্ভূত বহুমুখী রোকেয়া সারা জীবন নারীমুক্তি ও অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক বেগম রোকেয়া আজীবন কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন কিন্তু প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেননি।
বাঙালি মুসলিম সমাজে রোকেয়াই সর্বপ্রথম শিক্ষা বিস্তারকে নারী মুক্তি ও প্রগতির বৃহত্তর অভিযাত্রার সঙ্গে যুক্ত করেন। তার সমাজ ভাবনা মূলত নারীমুক্তি ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা ও অবিচার তারই বিরুদ্ধে ছিলো রোকেয়ার আপসহীন সংগ্রাম। আর এ সামাজিক উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে তিনি শিক্ষাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষা বিস্তারই এসব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ।’ শিক্ষা বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন, যা নারীদের মধ্যে তাদের আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগাবে।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। তখন চলছিলো নারীশিক্ষা, নারী-অধিকারের প্রতিকূলের সময়। আর দশজন মুসলমান মেয়ের মতো বেগম রোকেয়াও মুসলিম পারিবারিক নিয়মে বেড়ে উঠছিলেন। পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। ছয় ভাই বোনের মাঝে রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়।
একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি রোকেয়া। বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্য বেগম রোকেয়ার আগ্রহ ছিলো প্রবল। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন ইংরেজ শিক্ষয়ত্রীর নিকট তিনি কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্যে তাও বন্ধ করে দিতে হয়। তবু রোকেয়া দমে যাননি। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ও বড় বোন করিমন নেছার হাতে শৈশবকালে বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের আধুনিক মনস্ক ছিলেন। বেগম রোকেয়াকে লেখাপড়ায় উৎসাহ, প্রেরণা ও সহযোগিতা করেন। লেখাপড়ায় তার আগ্রহ দেখে বড় বোন করিমুন্নেসা এবং বড় ভাই ইব্রাহিম সাহেবের সহযোগিতায় তিনি বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন।
১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহার রাজ্যের ভাগলপুরের অধিবাসী বিপত্মীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। রোকেয়ার প্রকৃত নাম ‘রোকেয়া খাতুন’ এবং বৈবাহিকসূত্রে নাম ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন, প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত মানুষ। তার সাহচর্যে এসেই রোকেয়ার লেখাপড়ার উন্মেষ ঘটে। স্বামীর কাছ থেকে তিনি ইংরেজি ও উর্দু শিক্ষা লাভ করেন। সমাজ মনস্ক রোকেয়ার স্বামী সব সময় নারীশিক্ষার কথা বলতেন। নারীদের শিক্ষার উন্নতির জন্য তিনি স্ত্রীকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন এবং স্ত্রী রোকেয়াকে তার সম্পত্তির ট্রাস্টি করে যান। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন।
বেগম রোকেয়ার দাম্পত্যজীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, ৩ মে ১৯০৯ সাখাওয়াত হোসেন ইন্তেকাল করেন। স্বামীর মৃত্যু তার জীবনে সাময়িক বিপর্যয় ঘটালেও অকালবৈধব্য তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইতোপূর্বে তাদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়। অসীম মনোবল সম্পন্ন এই নারী শোককে শক্তিতে পরিণত করে নারীশিক্ষার বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তার স্বামীর ভাগলপুরে একটি মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ছিলো। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরের তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আবদুল মালেকের সরকারি বাসভবন ‘গোলকুঠি’তে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’-এর যাত্রা শুরু। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ আরও নানা প্রতিকূলতার কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে ১৩ নম্বর ওয়ালীউল্লাহ লেনের ভাড়াবাড়িতে নতুন করে চালু করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস্ স্কুল’।
নারী সমাজের মুক্তির জন্যে এ ধরনের শিক্ষা ভাবনা থেকেই তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার সমাজ ভাবনার কেন্দ্রে ছিল নারীর অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠা করা। এসব ক্ষেত্রে তার কিছু ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানও যথেষ্ট প্রগতিশীল পুরুষশাসিত সমাজ নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি প্রধান উপায় ভেবেছেন অর্থনৈতিক মুক্তি বা স্বাবলম্বনকে। সমাজ প্রগতির ক্ষেত্রে এ ধরনের চিন্তা সমসাময়িককালে সাহসিকতার পরিচয় তুলে ধরে। সমাজ প্রগতি ভাবনার ক্ষেত্রে বেগেম রোকেয়া ছিলেন মুক্তিবাদ ও মুক্তদৃষ্টির অধিকারী। প্রথমদিকে কেবল অবাঙালি ছাত্রীরাই পড়তো সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে। রোকেয়ার অনুপ্রেরণায় ক্রমশ বাঙালি মেয়েরাও এগিয়ে আসে পড়াশোনার জন্যে। ছাত্রীদের পর্দার ভিতর দিয়েই ঘোড়ার গাড়িতে করে স্কুলে আনা-নেয়া করা হতো। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে তফসিরসহ কুরআন পাঠ থেকে আরম্ভ করে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হোম নার্সিং, ফার্স্ট এইড, রান্না, সেলাই, শরীরচর্চা, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ই শিক্ষা দেয়া হতো।
নারীশিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করার কাজে লেগে গেলেন। মেয়েদের মা, বাবা ও অভিভাবকদের অনুরোধ জানালেন। মেয়েরা কঠোর পর্দা মেনে চলতো বলে তিনি পর্দাঘেরা গাড়ির ব্যবস্থা করেন। ধীরে ধীরে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। পরে ১৯১৭ সালে মধ্য ইংরেজি গার্লস্ স্কুল এবং ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস্ স্কুলে উন্নীত হয়। সমকালীন রাজনীতির প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে তার লেখায়। মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং শাণিত লেখনীর মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ শতকের একজন বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সে যুগের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরোজিনী নাইডু, তদানীন্তন বড়লাট পতœী লেডী চেমসফোর্ড, লেডী কারমাইকেল, ভূপালের বেগম সুলতান জাহান প্রমুখ মহিলা বেগম রোকেয়ার সাহিত্য ও সামাজিক কর্মকা-ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং তার কাজের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।
যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্পর্কে বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থে লিখেছেন-‘রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। গভীর রাত্রিতে সকলে ঘুমাইলে চুপি চুপি বিছানা ছাড়িয়া বালিকা মোমবাতির আলোকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে ইংরাজী ও বাংলায় পাঠ গ্রহণ করিতেন। পদে পদে গঞ্জনা সহিয়াও এভাবে দিনের পর দিন তাহার শিক্ষার দ্রুত উন্নতি হইতে লাগিল। কতখানি আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকিলে মানুষ শিক্ষার জন্য এরূপ কঠোর সাধনা করিতে পারে তাহা ভাবিবার বিষয়।’
১৯১৯ সালে বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় স্থাপিত হয় ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’। সেখানে নারীদের সেলাই, রান্না, সন্তান প্রতিপালনসহ বিভিন্ন বিষয়ে শেখানো হতো। বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকা-ে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।
‘মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে’-বেগম রোকেয়া।
বেগম রোকেয়ার সেই সংগ্রামী দিনগুলো থেকে এখন পর্যন্ত নারী এগিয়ে এসেছে অনেক দূর। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে নারী নির্যাতন আর নির্যাতনের বলি কিন্তু কমছে না। নারী শিক্ষায় এগিয়ে গেলেও কর্মক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার। তার ওপর নারীর ক্ষেত্রে আইনও যেন দুর্বল। দেশের সম্মানিত বা দলীয় ব্যক্তিরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে না থেকে যখন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কোন অপরাধকে প্রশ্রয় দেয় তখন মনে হয় না সেই সমাজে বসবাস করছি, যে সমাজ নিয়ে সেই বঙ্গ নারী স্বপ্ন দেখেছিলেন।
নারী সমাজের প্রতিপক্ষ নয়, নারী এই পৃথিবীর ঠিক অর্ধেক আকাশ আর নারীর জন্য হবে মুক্ত পৃথিবী। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।