প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
মেহেরপুরের বর্তমান মুজিবনগর ও তৎকালীন বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ নেয় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বা প্রবাসী সরকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেখানে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিসৌধসহ স্মৃতি কমপ্লেক্স। এর পাশেই রয়েছে চুয়াডাঙ্গার আট কবর সমাধিসৌধ।
বৈশাখের মাঝামাঝি। গরম পড়ছে বেশ। ওই গরমের মধ্যেই এক দুপুরে হাজির হই মেহেরপুরের মুজিবনগর আমবাগানে। বাগানের প্রায় সব গাছেই থোকায় থোকায় আম ঝুলে আছে। বৈশাখের মাঝামাঝি হওয়ায় আমের রঙ তখনও সবুজ। হাত বাড়ালে কিছু গাছের আম ধরাও যায়। তবে আম খাওয়ার উদ্দেশ্যে বাগানে প্রবেশ করিনি, বাগানটি দেখাই মূল উদ্দেশ্য। কারণ এ বাগানেই গঠিত হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকার।
আমবাগান ঘেরা তৎকালে এ গ্রামের নাম ছিলো বৈদ্যনাথতলা। পরবর্তী সময়ে এ গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে মুজিবনগর। সেজন্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বা প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবেও পরিচিত। এ আমবাগানে একাত্তরের ১০ এপ্রিল ওই সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল ওই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তান কারাগারে থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মকা- বাংলাদেশ ভূখ-ের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিলো বলে এ সরকার প্রবাসী মুজিবনগর সরকার হিসেবেও খ্যাত। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। নবগঠিত সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
আমবাগানের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। এ স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর, ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা ধাপ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের সামনে দেখা হলো সুভাষ মল্লিকের সঙ্গে। তিনি এখানে আসা দর্শনার্থীদের তৎকালীন সরকার গঠনের ইতিহাস বর্ণনা করেন। কারণ সেদিনের সরকার গঠনের সঙ্গী তিনিও। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। সেই অভিজ্ঞতাই তিনি দর্শনার্থীদের শোনান আপন তাগিদে। সুভাষ মল্লিক জানান, বিশাল এ আমবাগানে আগে দুই হাজার ২০০ আমগাছ ছিল। এখন আছে এক হাজার ১১৬টি।
কিছুক্ষণ স্মৃতিসৌধের বেদিতে বসি। তারপর আসি স্মৃতিসৌধের পাশেই গড়ে তোলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সে। এটাও আমবাগানের পাশে। বিশাল এ কমপ্লেক্সের অন্যতম আকর্ষণ বাংলাদেশের মানচিত্র। ওপর থেকে চারপাশ ঘুরে এ মানচিত্র দেখার ব্যবস্থা আছে। ভাস্কর্য ও স্থাপনার মাধ্যমে মানচিত্রের ওপর উপস্থাপন করা হয়েছে কোথায় কোথায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার নমুনা, শরণার্থীদের নমুনা, নদ-নদী ও সেতুর নমুনা ইত্যাদি।
মানচিত্রের পাশাপাশি এ কমপ্লেক্সে আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, অস্থায়ী সরকার গঠন, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন নমুনা ভাস্কর্য। এসব দেখে একনজরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জানা যায়। কিছুক্ষণ কমপ্লেক্সে ও আমবাগানের আশপাশ ঘুরে আসি চুয়াডাঙ্গার জগন্নাথপুরের আট কবর। মুক্তিযুদ্ধে আট শহীদের সমাধিকে ঘিরেই আট কবর কমপ্লেক্স। চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে এ সমাধিস্থল। ০.৬৬ একর জমির ওপর ১৯৯৮ সালে এ আট কবর কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হয়। সমাধি ছাড়াও এখানে আছে উন্মুক্ত মঞ্চ ও একটি দোতলা ভবন। এ ভবনের দেয়ালজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসের ২০০টি আলোকচিত্র। এ ছাড়া কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে এ কমপ্লেক্সে আবাসিক সুবিধাও পেতে পারেন। এখানে একটি গ্রন্থাগারও আছে।
আট শহীদ হলেন-শহীদ রওশন আলম, শহীদ রবিউল ইসলাম, শহীদ কিয়ামুদ্দিন, শহীদ খালিদ সাইফুদ্দিন আহমেদ তারেক, শহীদ হাসান জামান, শহীদ আফাজ উদ্দীন, শহীদ আবুল কাশেম ও শহীদ আলাউল ইসলাম খোকন। এই আট শহীদের বন্ধু ও সহযোদ্ধা এবং জাতীয় সংসদের বর্তমান হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন)। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনিই এ আট শহীদের কবর ও তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তার প্রচেষ্টায় আট কবর এখন আধুনিকভাবে সংরক্ষিত। এটি এখন এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিত।
সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন) বলেন, ওরা সবাই (শহীদ বন্ধুরা) আমাকে মিয়াভাই বলে ডাকতো। ওরা বলতো ‘মিয়াভাই আপনি যেদিক যাবেন, আমরাও সেদিক যাবো। আপনি যা করতে বলবেন, আমরা তাই করবো। ওরা দেশের জন্য ঠিকই অনেক কিছু করেছে, কিন্তু আমি ওদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তাই ওদের স্মৃতি রক্ষার্থে ও আগামী প্রজন্মের কাছে ওদের পরিচিতি তুলে ধরতেই অটকবরকে কমপ্লেক্স হিসেবে গড়ে তুলেছি। আর এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও ওদের ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
সেদিনের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন) বলেন, একাত্তরের ৩ আগস্ট কমান্ডার হাফিজুর রহমান জোয়ার্দ্দারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার জপুর ক্যাম্পে অবস্থান নেন। চার আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্পে কুবাদ খাঁ নামের এক পাকিস্তানি দালালকে ধরে আনেন। পাঁচ আগস্ট সকালে কুবাদ খাঁর দুজন লোক ক্যাম্পে এসে গুজব খবর দেয়-রাজাকাররা গ্রামের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। খবর শুনে কমান্ডার হাসানের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছুটে যান জপুর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বাগোয়ান গ্রামে। তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। তখন নাটুদা ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্যরা ইউকাটিং অ্যাম্বুস করে মুক্তিযোদ্ধাদের আটকে ফেলে। ফলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধেই শহীদ হন আট মুক্তিযোদ্ধা। পরে স্থানীয় জগন্নাথপুর গ্রামের মানুষ শহীদ ওই যোদ্ধাদের দুটি গর্তে গণকবর দেন। মুক্তিযুদ্ধের এ সমাধিসৌধটিই স্থানীয়দের কাছে জগন্নাথপুরের আট কবর হিসেবে পরিচিত।