প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
১২ নভেম্বর শুক্রবার ছিলো বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস ২০২১। সারা বিশ্বের মতো আমাদের বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো নিউমোনিয়া দিবস পালিত হয়েছিলো। সেটা ছিলো নভেম্বরের ২ তারিখ। পরবর্তীতে ২০১০ সাল থেকে তা প্রতি বছর পালিত হচ্ছে ১২ তারিখে। বিশেষ করে শীতের সময় আর দুই বছর করোনা মহামারি ভাইরাসের কারণে শিশু ও বয়স্কদের এ রোগের প্রকোপ বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষকে শ্বাসতন্ত্রের জটিল এ অসুখ থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে দিবসটির গুরুত্ব অনেক। প্রতি বছর পৃথিবীতে নিউমোনিয়ায় প্রায় ৪৫ কোটি লোক আক্রান্ত হয়। এতে মারা যায় প্রায় ৪০ লাখ রোগী। উন্নয়নশীল দেশে নিউমোনিয়ার ব্যাপকতা বেশি। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু ও বৃদ্ধরাই নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয় এবং শিশুরা বেশি মারা যায়। তুলনামূলকভাবে নারীদের চেয়ে পুরুষরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত জটিল একটি রোগ নিউমোনিয়া। ফুসফুসের প্যারেনকাইমা বা বায়ুথলিতে জীবাণু যেমনÑব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি সংক্রমণের ফলে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি এসব উপসর্গ দেখা দেয়, যা নিউমোনিয়া নামে পরিচিত। এটি ফুসফুসের অত্যন্ত প্রচলিত ও প্রাচীন একটি রোগ। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটস আড়াই হাজার বছর আগে এ রোগের বর্ণনা দিয়েছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে বয়সভেদে রোগ-জীবাণুতে কিছু পার্থক্য থাকে।
ক্রনিক ঠা-া লাগা, বুকে শ্লেষ্মা জমে থাকার সূত্র ধরেই পরতে হয় নিউমোনিয়ায়। বর্ষার পর হঠাৎ গরম তাতেই এ অসুখের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। ঠা-া লাগলেই যে সবার নিউমোনিয়া হবে তা কিন্তু নয়, তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, মূলত বয়স্ক ও শিশুরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ খুব জ্বর। ওষুধে জ্বর নামলেও আবার ওষুধের প্রভাব কাটলেই হু হু করে বেড়ে যায় জ্বর। ১০৩-১০৪ ডিগ্রি উঠতে পারে জ্বর। এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা ইত্যাদি তো থাকেই। অনেক সময় মাথা যন্ত্রণা, ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়া, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা এসবও নিউমোনিয়ার লক্ষণ। তবে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীকে ছুঁলেই নিউমোনিয়ার জীবাণু শরীরে ছড়ায় না। তবে আক্রান্তের কাশি বা হাঁচি থেকে তা ছড়াতে পারে। তবে সর্দি-জ্বরের সঙ্গে নিউমোনিয়ার বেশ কিছু তফাৎ থাকে। একটু লক্ষ্য রাখলেই তাই রোগ নির্ণয় করা সহজ। চিকিৎসকদের মতে, প্রাথমিকভাবে সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি দিয়ে এই রোগ শুরু হলেও দেখা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জ্বর, শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, কাশিও বাড়ছে। অনেক সময় জ্বরের ওষুধের কড়া ডোজে জ্বর নামলেও ফিরে ফিরে আসে তা। অবস্থা গুরুতর হলে কাশির সঙ্গে রক্তও উঠতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। একমাত্র চিকিৎসকই বুঝতে পারেন ব্যক্তি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কি না। তবু নিশ্চিত হতে কিছু পরীক্ষা করাতে হয়।
নিউমোনিয়ার লক্ষণ
জ্বর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার হয়ে থাকে। পাশাপাশি কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত নেয়া, শ্বাস গ্রহণের সময় বাঁশির মতো শব্দ হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্টবোধ বা কষ্টকর শ্বাস-প্রশ্বাস, বুকের খাঁচা দেবে যাওয়া, বুকে ব্যথা, খেতে না চাওয়া বা খেতে না পারা, শিশুর চঞ্চলতা কমে যাওয়া বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ও বমি করা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস খুব দ্রুত হয়। দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের মিনিটে ৬০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নিতে দেখা যায়। দুই মাস থেকে ১২ মাস বয়সী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মিনিটে ৫০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নেয় এবং এক বছরের বড় শিশু ৪০ বার বা তার চেয়ে বেশিবার শ্বাস নেয়। দ্রুত শ্বাসের সঙ্গে বুকের খাঁচা দেবে যায়। এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসককে দেখাতে হবে।
মনে রাখবেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মৃত্যুর কারণ কিন্তু দেরি করে চিকিৎসা শুরু করা। শীতকালে নিউমোনিয়া আক্রান্তের হার অনেক বেশি। তাই শীতকালে উপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি করবেন না। নিউমোনিয়া মারাত্মক রোগ হলেও এটা কিন্তু প্রতিরোধ করা যায়। শিশুদের ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমে। শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়াবেন না। যেসব শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ানো হয় তাদের এ রোগে আক্রান্তের হার অন্যদের চেয়ে চার গুণ বেশি। শিশু অপুষ্টি নিউমোনিয়া আক্রান্তের কারণ। তাই শিশু পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শীতকালে সুস্থ শিশুকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছে যেতে না দেয়া। হাঁচি-কাশি আক্রান্ত লোকের সামনে বাচ্চাদের যেতে না দেয়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। অর্থাৎ বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা। শিশুকে ভিড়ের মধ্যে অর্থাৎ বেশি লোক সমাগমের মধ্যে যেতে না দেয়া।
শিশুদের নিউমোনিয়া হওয়ার কারণ
নিউমোনিয়া বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে। যেমন ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক এবং পরজীবী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া অ্যাডেনোভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, শ্বাসযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাস এবং প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে হয়। আর বয়স অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থাৎ শ্বাসকষ্টের ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া, স্ট্রেপ্টোকোকাস নিউমোনিয়া এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া প্রায়শই ৫ থেকে ১৩ বছর বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায়। ব্যাক্টেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং যারা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তাদের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং কম মারাত্মক হয়।
লক্ষণ
শিশুদের মধ্যে লক্ষণগুলো কম সুনির্দিষ্ট হতে পারে এবং তারা বুকে সংক্রমণের স্পষ্ট লক্ষণ দেখাতে পারে না। শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হলো : ১. জ্বর। ২. শক্তির অভাব। ৩. দ্রুতগতিতে অগভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে জোরে জোরে শব্দ। ৪. খাওয়ানোতে অসুবিধা হওয়া ও ৫. ক্লান্তি বা ঝিমুনি ভাব।
প্রতিরোধ
শিশু বা বাচ্চাদের এ সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে ক) বাচ্চার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্তন্যপান করান খ) ঘরের পরিবেশ গরম এবং ভালো বায়ু চলাচল যাতে করে সে ব্যবস্থা করুন গ) সর্দি, ফ্লু বা অন্যান্য সংক্রমণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ এড়ান আর শিশুর তাপমাত্রা প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় কমপক্ষে একবার দেখে নিন। যদি তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি হয় তবে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
পরামর্শ
* আক্রান্ত রোগীকে ধূমপান থেকে দূরে রাখতেই হবে। সঙ্গে প্যাসিভ স্মোকিং থেকেও দূরে রাখতে হবে রোগীকে।
* দূরে রাখতে হবে যে কোন দূষণ থেকেও। ধোঁয়া, ধূলাবালি, মশা মারার কয়েল রোগীর ঘর থেকে বাদ দিতে হবে।
* পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন নিউমোনিয়া রোগীর জন্যে খারাপ। তাই প্রচুর পানি ও ফ্লুয়িড জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে রোগীকে।
* জ্বর কমানোর ওষুধ ঘন ঘন খাইয়ে জ্বর নামানোর চেষ্টা না করে বরং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন।
* রোগীকে ঠা-া আবহাওয়া থেকেও দূরে রাখতে হবে।
* অ্যাজমা থাকলে অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের নির্দেশ মতো ব্যবহারের বিধি-নিষেধ মানতে হবে।
* হার্ট ও লিভারের রোগে আক্রান্ত রোগী ও ডায়াবেটিকরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিউমোনিয়া প্রতিরোধক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিতে পারেন।
হোমিওপ্যাথিক বিধান
রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্যে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে ডাঃ হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে নিউমোনিয়া রোগসহ যে কোন জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগতভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে সম্ভব। আর নিউমোনিয়া রোগটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় খুব সহজেই সারানো যায়। নিউমোনিয়ার মূল লক্ষণ হলো ঘনঘন শ্বাস নেয়া এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে একশটি শিশু মারা গেলে দেখা যায় তার পঁচানব্বই জনেরই মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। সাথে জ্বর, কাশি, মাথা ব্যথা, বুকে ব্যথা, ভীষণ শীত বোধ করা ইত্যাদি থাকে। শিশুদের শ্বাস নিতে কষ্ট হলে প্রত্যেক পিতা-মাতাকে অবশ্যই বিষয়টিকে একটি ইমার্জেন্সি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য; প্রতিষ্ঠাতা,বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ই-মেইল : ফৎসধুবফ৬৮৯@মসধরষ.পড়স