প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
স্মৃতি-বিস্মৃতির চাঁদপুর
১৯৯৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল। সময়টা খুব একটা কম। শহরের অলিগলি, সামাজিক রীতি-নীতি, চাল-চলন বুঝতে বাকি নেই কিছুই। এ শহর একটি সামাজিক সম্প্রীতির শহর। একটা সময় ছিলো মানুষের চলনে-বলনে খুবই সরলতা প্রকাশ পেতো। ছিলো পরস্পর সহানুভূতি, সম্প্রীতিতে ভরপুর। ১৯৯৯ সাল পরবর্তী ২০০০ সালে প্রবেশের পরে অর্থাৎ মিলেনিয়াম ২০০০, মনে হলো যেনো একটি নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। মিলেনিয়াম ২০০০ স্বাগত জানাতে শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট সবকিছুই সাজানো হলো। অলিগলিতে লেখা হয়েছিলো ‘মিলেনিয়াম ২০০০’। এই মিলেনিয়াম ২০০০-এ মনে হলো যেনো কী একটা পরিবর্তন আসছে। প্রথমে মনে হয়েছিলো চিরাচরিতভাবে একটি বছরই কেবল অতিক্রম হচ্ছে। মিলেনিয়াম ২০০০-এর প্রভাবে সবকিছু এতোটাই বদলে যাবে যা কল্পনাতেও ছিলো না। বড় স্টেশন থেকে কালীবাড়ি আসতে রিকশা ভাড়া ছিলো ৬ টাকা, একজন গেলে তিন টাকা, দুজন গেলে ৬ টাকা। সে সময় একজন নিয়ে রিকশা ড্রাইভার আরেকজন যাত্রীর জন্যে অপেক্ষা করতো। তবে অনেকেই বড় স্টেশন থেকে কালীবাড়ি পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতো। যারা একটু আরামণ্ডআয়েশ খুঁজতো তারাই হয়তো রিকশায় যেতো। আর এখনকার মতো তখন ব্যাটারিচালিত মোটররিকশার এতো প্রচলন ছিলো না, রিকশা ড্রাইভাররা প্যাডেল চেপে যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করতো। ছোটরা বড়দের সম্মান করতো আর বড়রা ছোটদের স্নেহ করতেন।
|আরো খবর
শহরের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র বড় স্টেশন এক সময় গাজীর আস্তানা এখন বঙ্গবন্ধু পর্যটন কেন্দ্র। সেখানে মহামিলন হতো মানুষের। কারণ লঞ্চঘাট-রেল স্টেশন-স্টিমার ঘাট এসব সেখানে। তিনটি ঘাট একত্রে থাকায় ২৪ ঘণ্টাই ছিলো জমজমাট। পাশেই ছিলো চাঁদপুরের একমাত্র পাইকারি ইলিশ বিপণন কেন্দ্র বড় স্টেশন মাঝঘাট। কী ছিলো না বড় স্টেশন মোলহেড-কেন্দ্রিক! মানুষজন এপার থেকে ওপার যেতে কয়েকটি নৌকা ঘাট ব্যবহার করতেন। সারি সারি নৌকা থাকতো ঘাটে, নৌকার মাঝিরা তখন ৫০ পয়সা করে পুরাণবাজার থেকে নতুনবাজার খেয়া পারাপার করতেন। আর একমাত্র ব্যবসা কেন্দ্র পুরাণবাজার। ভোর হতেই শুরু হতো পুরাণবাজারে পণ্য বেচাকেনার প্রতিযোগিতা। অনেক প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন এই পুরাণবাজারে। তারা ব্যবসা ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির। কালের বিবর্তনের সে সমস্ত প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী এখন আর নেই।
পশ্চিমাঞ্চলের বহু নৌকা আসতো এখানে বিপণনের জন্যে। সারাদিন বিপণন করে তারা পণ্য নিয়ে আবার গন্তব্যে ফিরতেন। ইঞ্জিনচালিত নৌকার খুব একটা বাহুল্য ছিলো না। তখন পালতোলা নৌকা দেখা যেতো নদীতে। মাঝে মাঝে বিশালাকৃতির পালতোলা নৌকা পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিতো তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হতো।
শহরে বিনোদন কেন্দ্র ছিলো জেলা শিল্পকলা একাডেমী ও টাউন হল। জেলা শিল্পকলা একাডেমির এক সময় টিনের ছাউনি থাকলেও তখন শিল্প-সংস্কৃতির এতোটাই প্রাচুর্যতা ছিলো যে, মানুষ শিল্প-সংস্কৃতির ও সম্প্রীতি শহর হিসেবে চাঁদপুরকে জানতো। নানা সংগঠন তখন টাউন হল এবং শিল্পকলাতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। পুরাণবাজারে অনুপম মিলনায়তনে প্রায়ই মঞ্চনাটক হতো। সাংস্কৃতিক সংগঠনের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এখনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন। হাতেগোণা কিছু সংগঠন থাকলেও বর্তমানে নানারূপ সংগঠনের বাহুল্যতা রয়েছে।
খাবার-দাবারের প্রসিদ্ধ সেই ওয়ান মিনিট, হেভেন, সুইট হোম, ঢাকা হোটেল, আল-হেলাল হোটেল, চাঁদপুর হোটেল এখনো মনে হয় যেনো আগের মতোই আছে। তবে কলেজ গেটের সেই আনন্দ রেস্তোরাঁর সিঙারার স্বাদ মনে হয় এখনো মুখে লেগে আছে। কারণ কলেজের ক্লাস শেষে আনন্দ রেস্তোরাঁই ছিলো একমাত্র খাওয়া-দাওয়ার জায়গা।
সামাজিক সম্প্রীতি ও রাজনীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন চাঁদপুর শহর। বর্তমানে যেখানে চাঁদপুর টাওয়ার অবস্থিত সেখানে টিনের ছাউনি দিয়ে অনেকগুলো দোকান ছিলো। সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু দোকানপাট ছিলো, তার মধ্যে আইডিয়াল লাইব্রেরি ছিল আমার কাছে জনপ্রিয় একটি দোকান। কারণ এই আইডিয়াল লাইব্রেরির যিনি মালিক ছিলেন তিনি আমাকে নাতি হিসেবে জানতেন। সবসময় লাইব্রেরিতে গেলেই তিনি আমাকে বলতেন, নানা তোমার যে বই লাগবে নিয়ে যাও। আর এই নানার বই দিয়ে এই শিক্ষা জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আমার।
সদ্যনির্মিত রেলওয়ে হকার্স মার্কেট। মার্কেটে শুরু থেকে এতোটুকু ব্যাপ্তি থাকলেও পূর্বাংশে তেমন একটা দোকানপাট ছিলো না। সেখানে পাবলিক টয়লেট ছিলো। প্রাকৃতিক কর্ম ছাড়া সেখানে খুব একটা যাওয়া হতো না। তবে পশ্চিমাংশের দোকানগুলো তখনও জমজমাটি ছিলো। আমার আড্ডার স্থল ছিলো মাস্টার অডিও। কারণ এই মাস্টার অডিও সাথে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িত। মাস্টার অডিওর মাস্টার আমার বন্ধুর চাচা হওয়ায় তিনি আমাকে ভাতিজা হিসেবে জানতেন। যখনই কোনো নতুন গানের ক্যাসেট আসতো আমার বন্ধু মনির খান সেই ক্যাসেটটি আমাকে দিতেন। এছাড়াও সারাক্ষণ মাস্টার অডিওতে বসে বাছাইকৃত গানগুলো রেকর্ডিং করে নিজের সংগ্রহে রাখতাম। আজ বিলুপ্ত হয়েছে সেই মাস্টার অডিও। বেঁচে নেই মাস্টার অডিওর সেই মাস্টার। আর ওয়ান মিনিটের সেই প্রসিদ্ধ মিষ্টির স্বাদ যেনো এখনো আগের মতোই রয়েছে। এখনো একইভাবে ওয়ান মিনিটের মিষ্টি বিক্রি করা চলছেন আমাদের সম্পদ কাকা।
বর্তমানে রাস্তাঘাট হয়েছে আগের চেয়েও পরিপাটি। নেই সেই আগের টাউন হল। সেখানে হয়েছে বহুতলবিশিষ্ট টাউন হল মার্কেট। আর প্রাণের সেই শিল্পকলা এখন সেমিপাকা দালানের মধ্যেই। প্রাচীনতম সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র সাহিত্য একাডেমী এখনো স্বগৌরবে আগের মতোই। আর জোড়পুকুর পাড়টি এটি যেনো কোনো পরিবর্তনই হলো না। শহরে আগের মতো টিনের ঘর-বাড়ি না দেখা গেলেও দালান-কোঠার কোনো অংশেই কমতি নেই। আমার দেখা স্মৃতি বিজড়িত চাঁদপুর এভাবেই টিকে থাকবে বহুকাল। যেখানে থাকবে না কোনো হিংসা-প্রতিহিংসা। সম্প্রীতির এই বন্ধন অটুট থাকুক।
উজ্জ্বল হোসাইন : লেখক ও সংগঠক।