প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
শৈশবের ঈদ উৎসব
তুহিনা আক্তার সাথী
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে হাসি, আনন্দ, উল্লাস আর প্রীতির বন্ধন। হইহই, রইরই রবে আকাশে, বাতাসে আনন্দ বিলিয়ে দেয়াই হলো শৈশবের ঈদ। মুসলমানদের জন্যে বছরে ঈদুল ফিতর অর্থাৎ রোজার ঈদ, ঈদুল আযহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ নামে দুটি ঈদ আসে। এই দিনে হিংসা, বিদ্বেষ, অহমিকা ভুলে কোলাকুলির মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রতির বন্ধন তৈরি হয়। সাধ্যমতো নতুন পোশাক, হরেক রকমের খাবার-দাবারে ভরে থাকে প্রতিটি পরিবার। শৈশবের ঈদ হলো সব থেকে বেশি আনন্দের মুহূর্ত। যে আনন্দ কিছুতেই হৃদয় হতে মুছে ফেলা যায় না। আনন্দের স্মৃতিগুলো সারাজীবন অমলিন হয়ে গেঁথে থাকে হৃদয়ে।
শিশুদের জীবনে ঈদ যতোটা খুশি বয়ে আনে, পরিণত বয়সে সেই আনন্দ অনেকটাই কম। তখন প্রতিটি মানুষ দায়িত্বের বোঝা বহনে ব্যস্ত থাকে। শিশুদের জীবনে ঈদের আনন্দ খুবই গুরুপূর্ণ। ঈদের আনন্দকে শিশুরা আলাদা ভাগে উপভোগ করে। ঈদের চাঁদ দেখা, মেহেদী পরা, বাজি ফাটানো, নতুন জামা পরা, সেমাই খাওয়া, সেলামি আদায় করা, ঈদগাহে যাওয়া, কোলাকুলি করা, খেলনা কেনা, বন্ধুদের সাথে খেলা, আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া ইত্যাদি।
রমজান মাসজুড়ে শিশুরা ঈদের অপেক্ষা করে থাকে। কোন্দিন রোজা শেষ হবে, তবেই তো ঈদের দিন আসবে। ঈদকার্ডে অথবা সাদা কাগজে রঙিন কলম দিয়ে ‘ঈদ মোবারক’ লিখে বন্ধুদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। অনেকে তো বন্ধুকে লিখে পাঠায়, ‘ঝড়, বৃষ্টি, মেঘের দিন, আসবে তুমি ঈদের দিন। বন্ধু তুমি বড়ই প্রিয়, ঈদ আনন্দের শুভেচ্ছা নিও’। অনেকে বাবা-মায়ের সাথে ঈদের পোশাক কিনতে বাজারে যায়। দোকানে ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দ মতো পোশাক কিনে আনন্দের সীমা থাকে না। বাড়ি ফিরে পোশাক কেনার কথা সকলকে বললেও পোশাক কাউকে দেখানো হয় না, ঈদ শেষ হয়ে যাবে বলে। ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত স্বযত্নে লুকিয়ে রাখা হয় ঈদের নতুন জামা। চাঁদরাতে বাড়ির সকল বাচ্চারা মিলে উঠোনে, রাস্তায় কিংবা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখে ঈদ আনন্দে মেতে ওঠে। রেডিও, টিভিতে গান বাজে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সকলে মিলে সমবিত কণ্ঠে বারবার গান গেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। উঠোনে বসে হাতে বিভিন্ন রকমের ডিজাইন করে মেহেদীর আলপনা আঁকে, ঈদের সাজ পোশাকের গল্প করে। বাড়ন্ত বাচ্চারা বাজি ফাটিয়ে আনন্দ করে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বাবা, দাদা, নানা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে ঈদের পোশাক উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে।
গরিব শিশুদের ক্ষেত্রে ও ঈদের আনন্দের কমতি নেই। কখনো তারা আগের বছরের জামা পরিষ্কার করে পরিধান করে, কখনো বুনিয়াদি পরিবার থেকে পাওয়া যাকাতের পোশাক, সেমাই, এবং ফিতরার সামান্য অর্থ দিয়েই ঈদের আনন্দ উপভোগ করে। হতদরিদ্র পরিবারের বাবা-মাও সারাবছর কষ্ট করার পর ঈদের দিনে সামর্থ্য অনুযায়ী বাচ্চার জন্যে পোশাক ও ভালো খাবার কিনতে চেষ্টা করেন।
ঈদের দিন ভোর বেলাতেই সকল বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে পরে। সকাল সকাল সাবান মেখে গোসল করে নতুন পোশাক পরে, চলে আসে বড়দের কাছে। সকলকে সালাম করে আদায় করে নেয় ঈদ সেলামি। তারপর সকলে মিলে আলাদাভাবে গুনে দেখে কার কত টাকা হলো, কে কি খেলনা কিনবে। যার সেলামির টাকা যতো বেশি, তার উল্লাস ততো বেশি। তারপর সেমাই খাওয়ার পালা। সেখানেও থাকে সীমাহীন আনন্দ। কেউ লাল সেমাই খাবে, কেউ খাবে হলুদ, আবার কারো পছন্দ সাদা। বাবা, চাচা কিংবা বড় ভাইয়ের হাত ধরে যাওয়া হয় ঈদগাহ ময়দানে। নতুনরূপে সাজানো হয় ঈদগাহ ময়দান, সে যেনো অন্যরকম আনন্দের অনুভূতি। নামাজ শেষে সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি করে। মেয়ে শিশুরা ঈদের ময়দান থেকে চুরি, মালা, ফিতা, নেইলপলিস, পুতুল, খেলার ছোট হাঁড়ি-পাতিল কিনে নেয়। ছেলে শিশুরা কিনে বাঁশি, বেলুন, বল, লাটিম, নাটাই, ঘুড়ি ইত্যাদি। অনেক শিশু মিষ্টি, মিঠাই, সন্দেশ ও অন্যান্য খাবার কিনে থাকে। অনেকে বাবার সাথে হোটেলে বসে ঈদের তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের খাবার খায়। বাঁশি বাজিয়ে, বেলুন ফুলিয়ে নেচে নেচে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফেরার সেকি আনন্দ, যা কেবল শৈশবেই পূরণ হয়।
খাবার ও খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরে শিশুরা আনন্দে মেতে থাকে। সকলের খেলনা সকলকে দেখানো হয়। শুরু হয় নতুন খেলনা দিয়ে খেলাধুলা। মায়ের হাতে রান্না করা পোলাও, মাংস ও অন্যান্য তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে চলে যায় বন্ধুদের সাথে বেড়াতে। অনেক শিশু বড়দের সাথে আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যায়। অনেকে মিলে আবার বন্ধুদের বাড়িতেও বেড়াতে আসে। বন্ধুদের একসাথে খাওয়া, খেলা, ঈদের মেলায় ঘুরার আনন্দ অমলিন স্মৃতি হয়ে গেঁথে থাকে মনে। চাইলেও জীবনের পরবর্তী সময়ে সেই আনন্দ ফিরিয়ে আনা যায় না।
ঈদুল ফিতরের আনন্দ কাটানোর পর থেকে আবার শিশুরা ঈদুল আযহার অপেক্ষা করতে থাকে। ঈদুল আযহায় পশু কোরবানি নিয়ে শিশুদের মধ্যে উৎসর্গ করার অনুভূতি তৈরি হয়। কোন কোন শিশু সাহসের সাথে দাঁড়িয়ে পশু কোরবানি করা দেখে, আবার কেউ ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। অনেক বাচ্চারা হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে নিজেদের কোরবানির গোশত নিতে বড়দের সাথে আসে। অত্যন্ত উৎসাহের সাথে শিশুরা এ কাজটি করে থাকে। গরিব শিশুরা পলিথিন হাতে বুনিয়াদি বাড়িতে গোশতের জন্যে অপেক্ষা করে। সবশেষে সামান্য একটু পেলেই তারা খুশিমনে বাড়িতে নিয়ে রান্না পর্যন্ত খাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে। আলু দিয়ে রান্না করা সামান্য গোশত দিয়ে ভাত খেতে পেরে, তাদের আনন্দের সীমা থাকে না।
শহরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঈদের আনন্দ গ্রামের বাচ্চাদের থেকে ভিন্ন। শহরের বেশির ভাগ মানুষ একক পরিবারে বসবাস করে। তাই সকলে মিলে মিশে একসাথে ঈদ উদ্যাপন করার আনন্দ তারা পায়নি। যাদের গ্রামে আসার সুযোগ থাকে তারা সকলের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে উপভোগ করতে পারে। যদিও শহরের বাচ্চারা বড়দের সাথে শিশু পার্কে, জাদুঘরে ও আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যায়। গ্রামে এবং শহরের বাচ্চারা নিজেদের মতো করে আনন্দের সাথে ঈদের খুশি উপভোগ করে।
ধনী, গরিব সকল মুসলিম শিশুদের জীবনে ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল হাসি, আনন্দ আর প্রাণখোলা ভালোবাসা। উঁচুনিটু সকল বিভেদ ভুলে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক প্রতিটি শিশুর জীবন। যে কোনো পরিস্থিতিতে শৈশবের ঈদ এতোটাই খুশির হোক, যাতে পরবর্তী জীবনে এসে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের শৈশব জীবনের ঈদের উজ্জ্বল স্মৃতিগুলো বলে, চোখের জলে ও হাসি আসে অনায়াসে। শিশুদের জীবনে সেই আনন্দ বয়ে আনার দায়িত্ব থাকে পরিবারের বড়দের উপর। সামান্য সময় দেয়ার মাধ্যমে পরিবারের দায়িত্বশীলরা শিশুদের জীবনে এনে দিতে পারে অপরিসীম খুশির বন্যা। প্রতিটি শিশুর শৈশব হোক ঈদের মতো হাসি, খুশি, প্রীতি, আনন্দ আর ভালোবাসায় ভরপুর।