প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গেল কপ-২৮ সম্মেলন
বাংলাদেশকে কীভাবে বাঁচাবো মোরা
গেল কপ-২৮ সম্মেলন : নতুন তহবিলে আশা দেখছে বাংলাদেশ, বিশেষ করে এই সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠন চূড়ান্ত হওয়া। কারণ, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, তাপপ্রবাহসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে গেছে। এসব দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে এই তহবিল থেকে দ্রুত বরাদ্দ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দিতে পারে, সে ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি তুলেছে। আর বাংলাদেশ যাতে সেখান থেকে দ্রুত ও সহজে প্রকল্পের মাধ্যমে বরাদ্দ পায়, তা নিশ্চিত করতে বলেছে। আমার প্রশ্ন বাংলাদেশের রাষ্ট্রের কাছে, সেটা হলো--বাংলাদেশ যে বরাদ্দ প্রতিবার পেয়ে আসছে, সেই বরাদ্দের কত ভাগ দেশের মানুষের এবং দেশের পরিকাঠামোর কাজে কোথায়, কখন এবং কীভাবে ব্যয় হয়েছে? আমরা বরাদ্দ পাই, বরাদ্দ দিই কিন্তু ফলোআপ করি নে, জনগণের কাছে জবাবদিহি নেই, আমাদের জলবায়ুর অবনতি ছাড়া কোনো উন্নতি নেই। আমরা জলবায়ু দূষণে দূষিত এবং বিশ্ব সেরা, যার ফলে আমাদের কথায় দুর্গন্ধ, চলাচলে, পথেঘাটে দুর্গন্ধ, যানবাহনে দুর্গন্ধ, শরীরে দুর্গন্ধ, মনে দুর্গন্ধ, এমনকি মুখ থেকে খারাপ শ্বাসে দুর্গন্ধ। এসব অতি সাধারণ বিষয়, যা আমাদের চারপাশের লোকদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
> আপনি কি কখনও এমন অসুবিধায় পড়েছেন বা নিজেই অন্যের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছেন? তাহলে জেনে নিন, যখন কেউ গাড়িতে, বাড়িতে বা অফিসে কথা বলার সময় চুইংগাম অফার করে, ধরে নিবেন আপনার মুখের দুর্গন্ধ এর জন্যে দায়ী। মুখের দুর্গন্ধ সব সময়, সব জায়গায় বা সব পরিবেশে টের পাওয়া যায় না। কারণ কী জানেন? পুরো পরিবেশই তখন দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ। বায়ু দূষণ তার মধ্যে অন্যতম। দাঁতের সঙ্গে আঁতের একটি সম্পর্ক আছে। খারাপ মুখশুষ্কতা বা হ্যালিটোসিস হলো একটি সাধারণ সমস্যা, যা যে কোনো লোকের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এটি সাধারণভাবে একটি লজ্জাজনক অবস্থা এবং এটা আমাদের আত্মমূল্য ও সামাজিক পরিকল্পনাগুলোর উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শুধুমাত্র দাঁতের যত্ন না নেওয়ার একটি চিহ্ন নয়, বরং এটি কিছু খাদ্য পদার্থ এবং স্বাস্থ্য অবস্থার সাথেও সম্পর্কিত। অনেক মানুষ আছে যারা অতিরিক্ত কথা বলে, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করে না বা জিহ্বা পরিষ্কার করে না। এগুলো নিয়মিত করলে খারাপ মুখশুষ্কতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া আহার একটি ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, যারা নিয়মিত শাকসবজি খায় তাদের মধ্যে খারাপ মুখশুষ্কতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। অনেক পানি পান এবং নিয়মিত খাওয়া এটিতে সাহায্য করতে পারে।
> আপনি যদি আপনার দাঁত ভালো করে ব্রাশ করেন, জিহ্বা ব্রাশ করতে সচেতন হন, তবে সব ব্যাকটেরিয়া চলে যাবে না এবং মুখ ব্যাকটেরিয়ামুক্ত থাকা উচিতও নয়। এটি হলো মৌখিক অঞ্চলে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধি রাখা নিয়ে কথা। বেশ কিছু গবেষণা করার পর একটি বিষয় নিশ্চিত যে, মুখের দুর্গন্ধের জন্য ব্যাকটেরিয়া দায়ী। আমাদের শরীরে প্রোবাডেন্টে ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে। অসুস্থতাজনিত গন্ধটি স্থায়ীভাবে বিলীন করতে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, মুখে শুধুমাত্র সে ব্যাকটেরিয়ার যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তারপর দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে চেষ্টা করা, দুর্নীতি, অনীতি না করা। কারণ যত খারাপ কাজ করবেন দেখবেন দুশ্চিন্তার কারণে মুখে দুর্গন্ধ বেশি হবে। একটি ছোট শিশু বা কিশোরদের মুখে দেখবেন তেমন দুর্গন্ধ নেই। দেখা যায়, তারা ঠিকমতো দাঁত ব্রাশ করে না, কিন্তু আমি আপনি? যাইহোক, এতো গেল মুখের এবং মনের সমস্যার কারণ, কিন্তু কী অবস্থা বায়ু এবং পরিবেশ দূষণের?
> যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনও বদলেছে। সময়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে বহুগুণে। বেড়েছে সবকিছুর চাহিদাও। এ কথা সবারই জানা যে, মানুষের সব প্রয়োজন মেটানোর উৎস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকৃতি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের কারণে মানুষের চাহিদার আমূল পরিবর্তন হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর।
> কারখানায় প্রস্তুত হয় মানুষের নিত্যদিনের সামগ্রী। সেই কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন না করে সর্বত্রই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে মাটি এবং সাগরে। আবার সেই বর্জ্য পুড়িয়ে ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাসেও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন সুবিধার জন্যে যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে তা মাটির ক্ষতি করছে। এভাবে পরিবেশের প্রত্যেকটি উপাদান দূষিত হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে।
> এমতাবস্থায় গোটা বিশ্বের মানুষ কম-বেশি বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। সুইডেন অন্যান্য দেশের চেয়ে একটু বেশি সচেতন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, তার প্রমাণ গ্রেটা তুনবার্গ। কয়েক বছর ধরে সুইডেনের সব দোকানে প্লাস্টিক ব্যাগের দাম দুই ক্রোনার থেকে সাত ক্রোনার হয়েছে। কাগজের ব্যাগের দাম পলিথিনের তুলনায় কিছুটা কম।
> বাসা থেকে ব্যাগ না নিয়ে দোকানে গেলেই একটি ব্যাগের জন্যে ৭ ক্রোনার দিতে হয়। আজ ব্যাগ নিতে ভুলে গেছি। একটি ব্যাগ কিনতেই অল্প বয়সী ক্যাশিয়ার বললো, “পরিবেশের কথা ভাবো, আর কতদিন পৃথিবীর পরিবেশ ধ্বংস করবে?”
> বললাম আজ ব্যাগ আনতে ভুলে গেছি, সরি। সে বকবক করে এক গাদা শক্ত কথা শুনিয়ে দিল। এমনকি কোনো এক সময় বলে ফেললো, তোমরা যারা অন্যদেশ থেকে এসেছো, পরিবেশের ওপর তোমাদের কোনো রকম রেসপেক্ট নেই। এতক্ষণ মেজাজটা ঠিক ছিল, তবে শেষের কথাগুলো বলতেই একটু চটে গেলাম। দোকানে ভিড় কম। মেয়েটিকে একেক করে বলতে শুরু করলাম।
> এই মেয়ে শোনো, আমাদের বাড়িতে মা কাঠ দিয়ে রান্না করতেন ছোট বেলায়। সেই রান্না করতে যে কাঠ ব্যবহৃত হতো তার অবশিষ্ট যে কয়লা বা ছাই থাকতো, তা দিয়ে বাড়িতে কাজের লোক থালা-বাসন পরিষ্কার করেছে। কাঠের কয়লা, গাছের ডাল এসব দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেছি। কাপড় পরিষ্কার করতে ছাই ব্যবহার করতাম। হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি, গাড়ি বা মোটর চালিয়ে না। টিভি, কম্পিউটার, কেমিক্যাল জিনিসের ব্যবহার খুব কম করেছি। মাঠে গরু দিয়ে চাষ করেছি, কখনও মেশিন ব্যবহার করিনি। ভেবে দেখো, আমি আমার জীবনের কুড়িটি বছর কীভাবে কাটিয়েছি আর সেই সাথে ভেবে দেখো, তুমি তোমার জীবনের কুড়িটি বছর কীভাবে কাটিয়েছো? তোমার জন্মের শুরুতে তুমি ডায়াপার ব্যবহার করা থেকে শুরু করে সকল ধরনের বিলাসিতায় বড় হয়েছো। যার পেছনে জান কী পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার হয়েছে? এখন বলো, কে পরিবেশ নষ্ট করেছে, আমি না তুমি?
> আমার কথা চলাকালীন বেশ কিছু লোক জড় হয়ে শুনছে। পরে আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন সুইডিশ নিউজ পেপারে ঘটনাটি তুলে ধরি। তাদের অনুরোধ রাখতে সবে সুইডিশ ভাষায় লিখাটি শেষ করেছি। ভাবলাম বাংলাতেও বিষয়টি তুলে ধরি, তাই এ লেখা। উপরের ঘটনাটির পেছনে যে বিষয়টি জড়িত তা হলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
> সে আবার কী এবং উপরের ঘটনার সঙ্গে পৃথিবীর পরিবেশেরই বা কী সম্পর্ক? আসুন তাহলে জেনে নেই এ বিষয়ের ওপর কিছু তথ্য।
> পরিবেশের প্রতিটা উপাদানের সু-সমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। এই সু-সমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায়। যার কারণে পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়।
> পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর জন্য দায়ী। পরিবেশ দূষণের জন্যে বিশেষভাবে দায়ী কিছু মারাত্মক রাসায়নিক দ্রব্য, যেগুলোকে আমরা 'ডার্টি ডজন' বলি। খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পৃথিবীব্যাপী সব পরিবেশের সব ধরনের জীবজন্তুর ওপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটায় এই বিষাক্ত পদার্থগুলো। ত্রুটিপূর্ণ শিশুর জন্ম, ক্যান্সার উৎপাদন, ভ্রূণ বিকাশের নানাবিধ সমস্যার মূলেই দায়ী থাকে এই ডার্টি ডজন। পরিবেশের ভালো মন্দ মানুষের কৃতকর্মের ফল। দিন দিন পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। মানুষ নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতি পরিবেশকে বিনাশ করছে। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই যে নির্বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার সাজানো প্রকৃতির বিনাশ করছি, এতে চূড়ান্ত ভুক্তভোগী কে হচ্ছে?
> বিভিন্ন প্রাণীসহ মানুষ প্রকৃতির রোষানলে পড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। আমরা পরিবেশ দূষণ করছি হরদম। পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, শব্দ দূষণ, চারদিকে দূষণ আর দূষণ।
> শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে, পরিবেশ দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চরিত্রও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় মানুষ যেভাবে বাড়ছে, ভালো মানুষ সেভাবে বাড়ছে কি? মানুষ মানুষের ক্ষতি করছে। হত্যা, গুম, ধর্ষণ, দুর্নীতি, ঘুষ, অপসংস্কৃতি, মারামারি ইত্যাদি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মানুষ যেন অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যতসব অকল্যাণ, অন্যায় কর্ম সৃষ্টি হচ্ছে, সবগুলোর জন্যে দায়ী মানুষ। পরিবেশের দূষিত উপাদান আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সাগরের পানি দূষিত হওয়ায় বিপন্ন অনেক জলজ জীবন। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, মৌমাছির সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে। পরাগায়নের মাধ্যমে আমাদের বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে মৌমাছির বিকল্প নেই। তাদের এই দুরবস্থা আমাদের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি।
> আমরা যদি আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে আমরা বেশি দিন পৃথিবীতে টিকতে পারবো না। আমাদের কুণ্ডকর্মের কারণে আমরাই ধ্বংস হবো। পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরকেই নিতে হবে। জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা আরও কমবে। যেমন প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে এবং সেইসঙ্গে তার ব্যবহারও। নতুন প্রজন্ম বেশ ভাবতে শিখেছে, যদিও তারাই কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ নষ্টের জন্যে দায়ী, যা তারা সরাসরি বুঝতে পারছে না।
> পৃথিবীকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের অস্তিত্ব আরও অনেক বছরের জন্যে নিশ্চিত করতে পারবো। এখানে আমরা বলতে শুধু সুইডেনকে বুঝলে হবে কি? বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকারের কী করণীয় রয়েছে এবং কী প্লান হাতে নেয়া হয়েছে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে?
> প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ আজ মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। দুই পরিবেশকেই সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সচেতন এবং ভালো মানুষের কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের ভালো রাখার জন্যে চলুন প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করি, পরিবেশ সুরক্ষা করি।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ৎধযসধহ.সৎরফযধ@মসধরষ.পড়স