প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আমিও কি পেনশন পাবো?
কিছুদিন আগে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি অবসরে গেলেন। নানা তথ্যের মধ্যে একটি তথ্য বেশ ভাবনার খোরাক হয়ে পড়ে, সেটা ছিলো অবসর ভাতা সহ তাঁকে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। ছোটবেলায় বাব-মা থেকে শুরু করে পারিপার্শ্বিকতা বা নিজ থেকে আমাদের সবার মধ্যে জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী, আমি কী হতে চাই---এ ধরনের চিন্তা কিন্তু মাথায় ঢোকানো হয় বা নিজ থেকে ঢুকে যায়।
|আরো খবর
আমি জানিনে কারো মাথায় কখনও এ ধরনের চিন্তার জন্ম নেয় কিনা! যেমন, আমি চোর, গুন্ডা, বদমাশ, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ বা খুনি হতে চাই। এ ধরনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে জীবন শুরু করেছে এমন ঘটনা শুনিনি, তবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, বৈজ্ঞানিক, ক্রীড়াবিদ, শিল্পপতি এমনকি রাজনীতিবিদ ইত্যাদি হতে চায় অনেকেই--এসব শুনেছি। ছোটবেলার সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে সাধনা এবং কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে সাফল্য পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।
আমরা সরল মনের অধিকারী, সেই সুবাদে সেবা দেওয়া এবং সেবা নেওয়া আমাদের মানবতা এবং নৈতিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যতক্ষণ মানবতা এবং নৈতিকতা সঠিকভাবে কাজ করে, ততক্ষণ আমরা সমাজের সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলি। কিন্তু যখনই মানবতা এবং নৈতিকতার অবনতি দেখা দেয়, তখনই শুরু হয় সমস্যার।
সমাজের একটি গ্রুপ আছে তারা রীতিমতো ছাত্রজীবন থেকেই প্রকাশ্যে সমাজসেবক হিসেবে কাজ করে। বাবার হোটেলে শুয়ে বসে খায় আর গরিবের জন্যে এটা সেটা করে। তারা সেই থেকেই গরীবের ভাগ্য পরিবর্তনে দৃঢ়বদ্ধ। শেষে রাজনীতিতে যোগদান করে গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে। লক্ষ্য করেছেন কিনা জানিনে! তবে আমি বেশ ক্লোজলি লক্ষ্য করেছি। আমি এ পর্যন্ত বিশেষ করে বাংলাদেশে গরিবের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হতে দেখিনি। তবে রাজনীতিবিদদের বিশাল পরিবর্তন দেখেছি। কী করতে চেয়েছিল আর কী হয়ে গেল! ঘটনাটি কি ভাববার বিষয় নয়?
মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিশ্চয় আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মেহনতি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারপরও আমি তাঁকে উদাহরণস্বরূপ আমার এ লেখায় রাখতে চাই, যাতে করে অন্য কেউ মাইন্ড না করে।
আমি আজ আলোচনা করবো পেনশন বা অবসর ভাতার উপর।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোটামুটি বাকি জীবনের পুরো সময়টিতে একটি নিম্নমানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পেনশনে গেলেন। কিন্তু অভাগা জাতির কথা, আমাদের কী হবে?
আমি বা আমার মতো যারা দিনমজুরি, কৃষক থেকে শুরু করে দিনভিখারি এবং যারা দূরপরবাসি, আজীবন বিদেশে কাজ করছে, একদিন তারও তো কর্মজীবন শেষ হবে, তাদের জন্যেও কি সীমিত পেনশনের ব্যবস্থা করা হবে বা হচ্ছে? বিষয়টি জানতে ইচ্ছে হয়েছে। বাংলাদেশ তো অনেক উন্নতির শিখরে এখন, তাহলে আছে কি একটি সঠিক এবং নির্ধারিত পরিকাঠামো প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্যে? যেদিন আমি কর্মে বিরতি পাবো সেদিন আমার জন্যেও কি মহামান্য রাষ্ট্রপতির মতো একটি ন্যূনতম পেনশন থাকবে?
জীবনের সবটুকু সময়ই যদি অভাব অনটনের মধ্য দিয়েই গেলো, তাহলে যারা কথা দিয়েছিল আমার মতো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে, আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করবে, তারা ধনী হয়ে গেলো, আমরা সেই গরীবই রয়ে গেলাম! অন্যদিকে সেইসব গণ ও জনদরদী ধনীরা তাদের কর্মজীবন শেষে পেনশন নিয়ে ঘরে গেল, আর আমরা সেই রাস্তায় থেকে গেলাম!
প্রিয় সংসদ ভবন, তুমি সুন্দর পরিকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছো। তোমার মধ্যে বসে না এসব কাজ করার কথা? কিন্তু তুমিও কি সেই আমার মতো অচল, অধম, অপর! তোমার ভেতরে বসে সেই সকল দেশদরদী যারা বলেছিল আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করবে, জীবনের নিরাপত্তার অবলম্বন হিসেবে কাজ করবে! কিন্তু কেন সেটা করা হচ্ছে না?
সরকারি চাকুরিজীবীরা পেনশনের সুবিধা পেলেও যারা বেসরকারি চাকরি করেন, তারা এমন সুবিধা পান কিনা জানিনে। নানা রকম সঙ্কটের মধ্য দিয়েই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের দিনযাপন করতে হয়। উল্লেখ্য, পেনশনের অর্থ পাওয়ার জন্যেও যদি তাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়, তা হবে দুঃখজনক। চাকুরি ছাড়ার পর সময়মতো পেনশনের অর্থ না পাওয়ায় কোনো কোনো শিক্ষককে অর্ধাহারে-অনাহারেও দিন কাটাতে হয়। আমরা জানি, বৃদ্ধ বয়সে সবারই কম-বেশি নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। অর্থাভাবে ওষুধ ক্রয়ে সমস্যা হলে সংশ্লিষ্টদের কতোটা বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয় তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুত সন্তানের পড়ালেখার খরচসহ প্রতিদিনই বিভিন্ন খাতে দরকার প্রচুর অর্থ। অবসর জীবনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের যাতে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, সে জন্যে পেনশন বিষয়ক সমস্যার সমাধানে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।
এছাড়া যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তারাও কর্মজীবন শেষে আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এর ফলে যে সামাজিক বৈষম্য তৈরি হয় তা নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে শুনেছি, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হবে সেটা আগে ভাগেই বলে রাখি।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা বিবেচনায় এনে এ কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। আপাতত চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্যে চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি চালু করা হবে শুনেছি। সেগুলো হলো প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা জারি করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ।
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিকই এ ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারেন এবং ৬০ বছর বয়স থেকে তারা আজীবন পেনশন পাবেন। শুরুর দিকে চিন্তা না থাকলেও পরে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদেরও পেনশন কর্মসূচির আওতায় রাখার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
গ্লোবাল পেনশন ইনডেক্সে বিশ্বের ৪৪টি দেশের তালিকা করা হয়েছে। এ তালিকায় যেমন আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইসরায়েল, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যের নাম রয়েছে। এখন থেকে বাংলাদেশের নামও এর মধ্যে থাকবে। সঞ্চয়মুখী ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ার অভিপ্রায়ে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি প্রশংসার দাবি রাখে। আশা করি এটা শুধু তালিকাযুক্ত হয়ে থেমে যাবে না, এটা কাজেও প্রমাণিত হবে। কারণ সরকারি চাকুরি থেকে অবসরে যাওয়া মানুষ পেনশন তুলতে গিয়ে যে ভোগান্তির শিকার হন, তা আমলে নিলে আলোচ্য কর্মসূচিতে সবার অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। যে কারণে কর্মসূচির পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। সাধারণ জনগণের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে পেনশন উত্তোলনের ব্যবস্থা যদি করা যায়, তাহলে এ কর্মসূচি জনপ্রিয়তা পাবে সেটা আশা করি।
এ কর্মসূচি সার্থক হলে দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা আরো জোরদার হবে। এজন্যে পেনশন কর্মসূচির সফল উদাহরণ তৈরি করা প্রয়োজন। আমি এ কর্মসূচির সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করি, একই সাথে মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছি। আশা করি তিনি বিষয়টি মানবতা ও নৈতিকতার দিক দিয়ে বিবেচনা করবেন সে প্রত্যাশাও করি।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]