প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
বই আলোচনা
মেঘচেরা আলোয় ‘রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা’
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
মাঝে মাঝে মেঘে ঢেকে যায় রবি। তবে তা সাময়িক। পবন-প্রবাহ একসময় সে মেঘ সরিয়ে রবিরশ্মির প্রখরতাকে মুক্ত করে আনে ঠিকই। এরকমই কালের ধুলোর মেঘে ঢাকা পড়েছিলো চাঁদপুরে আসা রবীন্দ্রনাথ। চাঁদের জ্যোৎস্না মেঘনার জলে লুকিয়ে রূপোলী ইলিশ হয়ে ওঠা চাঁদপুরে রবীন্দ্রনাথের যে চরণধূলি এখনও স্মৃতির রাজপথে ঘুরে বেড়ায় তাতে কালের ধূসর পর্দার অন্তরাল তৈরি করেছে বিস্মৃতি। সেই বিস্মৃতিকে প্রগতির পবন-প্রলয়ে মুক্তির দিশা দিয়ে মলাটবদ্ধ গ্রন্থে রূপ দিয়েছেন লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান।
বাঙালির গর্ব কবি শঙ্খ ঘোষ ও সানজীদা খাতুন---রবীন্দ্রনাথে আপ্রাণ নিবেদিত এ দুই মহৎ প্রাণকে উৎসর্গ করা বইটি দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত। ১২৫ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে চাঁদপুর পৌরসভা, চাঁদপুরের প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশে এ বইটি প্রথম প্রয়াস। এজন্যে পৌর মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েলকে ধন্যবাদ জানাই।
কথা ছিলো গ্রন্থটির ভূমিকা লিখবেন কবি শঙ্খ ঘোষ কিন্তু তাঁর প্রয়াণে আমরা ভাগ্যাহত হয়ে রইলাম। ৯৬ পৃষ্ঠার কলেবরে প্রকাশিত বইটিতে কিছু বিরল চিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে, যা সংগ্রহে লেখকের বিপুল শ্রম ব্যয়িত হয়েছে। এ বইটি রবীন্দ্র গবেষক ও চাঁদপুর বিষয়ে আগ্রহীদের জন্যে অমূল্য সংযোজন।
গবেষণালব্ধ গ্রন্থের নিবিড় পাঠ শেষে আমাদের জানা হয়ে যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঊনিশশো ছাব্বিশ সালে আগরতলা চারদিন সফর শেষে ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ট্রেনযোগে পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ও নাতনী নন্দিনীসহ চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনে এসে পৌঁছান। পরদিন সাতাশ ফেব্রুয়ারি তারিখে নৌপথে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বেশকিছু সময় চাঁদপুরে অতিবাহিত করেন এবং শহরের নামজাদা আইনজীবী ভগবান চন্দ্র মজুমদারের বাসায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন ও জলখাবার গ্রহণ করেন। তিনি অধুনা বিলুপ্ত নীরদ পার্কে (যা বর্তমানে নিউমার্কেট হিসেবে দৃশ্যমান) গণসংবর্ধনা গ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করেন। দুঃখের বিষয়, তাঁর সেই বক্তব্যের কোনো রেকর্ড কোথাও সংরক্ষিত নেই। রবীন্দ্রনাথ আগরতলা হতে চাঁদপুর আসার পথে ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে’ গানখানি রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চাঁদপুরের কালীমোহন ঘোষের সুসম্পর্ক ছিলো। সে সম্পর্ক এতো নিবিড় ছিলো যে, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শান্তিনিকেতনে কালীমোহনকে কর্মে নিয়োজিত করে নিজের বই বিক্রিলব্ধ কুড়ি টাকা করে মাসিক সম্মানীর ব্যবস্থা করেন এবং এলাকাবাসী ও শান্তিনিকেতনবাসীদের মনে তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে কালীমোহন সম্পর্কে উচ্চ ধারণা খোদাই করে দেন। কালীমোহনের মাধ্যমে তিনি পল্লি সমবায় ও শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক কর্ম সম্পন্ন করান। কালীমোহনের ছয় পুত্রের দুজন তথা শান্তি ও সাগরকে তিনি রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে শান্তিনিকেতনে পাঠান। শান্তিদেব ও সাগরময়ের স্মৃতিকথায় গুরুদেব মূর্ত হয়ে উঠেছেন আমাদের সামনে।
চাঁদপুরের মানুষের সাথে রবীন্দ্রনাথের ছিলো আত্মিক যোগাযোগ। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসেছেন ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন। ‘সওগাত’ নামটিকে পছন্দ করে রবীন্দ্রনাথ বিনা সম্মানীতে ‘পথের সাথী’ কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন শুভ কামনায়। চাঁদপুরের বেশ কয়েকজনের নামকরণ বা বলতে গেলে পুনঃনামকরণও রবীন্দ্রনাথই করেছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্র-তত্ত্বাচার্য শান্তিদেব ঘোষ উল্লেখযোগ্য। পিতৃদত্ত নাম শান্তিময় রবীন্দ্র-আল্পনায় ফুটে উঠল শান্তিদেব নামে। তেমনি চিত্রশিল্পী নিভাননীও পরিচিত হয়ে গেলেন চিত্রনিভারূপে। তাঁর আঁকা ডিজাইনের মাঝখানের ফাঁকা অংশে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কবিগুরু লিখেন, ‘যখন ছিলেম অন্ধ/সুখের মেলায় বেলা গেছে/পাই নি তো আনন্দ।...’ এ আমাদের পরম পাওয়া। চাঁদপুরের মেয়ে আল্পনাশিল্পী সুকুমারী দেবী এবং চাঁদপুরের পুরাণবাজারে বেড়ে ওঠা যাযাবরখ্যাত বিনয় মুখোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথের দর্শন এবং স্নেহে ধন্য হয়েছেন।
চাঁদপুরের গান্ধী নামে খ্যাত হরদয়াল নাগের মহাত্মা গান্ধী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেয়া বিবৃতিতে সন্তোষ প্রকাশ এবং চাঁদপুর হতে কলকাতা যেতে রবীন্দ্র-বাহন চাঁদপুর মেল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উক্তি---ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয় সংযুক্ত করে গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান বইটিকে সর্বাঙ্গীণতায় সমৃদ্ধ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সেই সূত্রে এতে আরো স্থান পেয়েছে চাঁদপুরের বাবুরহাটে জন্ম নেয়া কবি অবণীমোহন চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থসমূহের রবীন্দ্রাশীষ লাভের সংবাদ এবং সাংবাদিকরূপে যাযাবর কর্তৃক রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার গ্রহণের অমূল্য তথ্য। সন্নিবেশিত হয়েছে চাঁদপুরে কবিগুরুর তিয়াত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে কবির পাঠানো ‘যাবার সময় হলো বিহঙ্গের...’ কবিতাখানি যা ‘চাঁদপুর ইউনিয়ন ইনস্টিট্যুটে প্রেরিত হয়েছিলো।
আইয়ুব আল আমিনের নান্দনিক প্রচ্ছদে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা’ গ্রন্থটি সহায়ক গ্রন্থসারণি ও পরিশিষ্টে সমৃদ্ধ। লেখক এতে নির্ঘণ্ট জুড়ে দিয়ে আগ্রহীদের আয়াস হ্রাস করেছেন। তবে প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে যুক্ত গ্রন্থসূত্র এবং আকরগ্রন্থের তালিকায় পুনরাবৃত্তির ভার যুক্ত হয়েছে, যা পরিণামে অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তিদেব ঘোষকে লিখিত গুরুদেবের চিঠির ছবির সংযুক্তি কিংবা নীরদপার্কের ছবি সংযুক্ত হলে আরো ভালো হতো। রবীন্দ্রনাথকে জলযোগে আপ্যায়নকারী ভগবান চন্দ্র মজুমদারের বাড়ির অবস্থানটি সুনিশ্চিত করাটা জরুরি ছিলো। গ্রন্থের আলোকে পৌরসভার পক্ষ থেকে বর্তমান নিউমার্কেট (যা সাবেক নীরদ পার্ক) এলাকায় একটি রবীন্দ্র আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণের প্রয়াস যেনো অচিরেই আমাদের পিপাসা মেটায়-সেই প্রতীক্ষায় রইলাম। তরুণ গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের ‘রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা’ গ্রন্থটি অন্য তরুণদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করবে-এ আশায় আমরা স্বপ্ন বুনি নিরন্তর।
গ্রন্থের নাম : রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা
লেখক : মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন
প্রকাশক : মেয়র, চাঁদপুর পৌরসভা, চাঁদপুর
মূল্য : ২৫০ টাকা।