প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
দুই ভুবনে দুই বাসিন্দা
হাসান আলী
ছোট বেলা থেকে দেখেছি দাদা-দাদী আলাদা বিছানায় ঘুমাতেন। আমাদের চৌচালা টিনের ঘরের সামনের দিকে এক পাশের খাটে দাদা আরেক পাশের খাটে দাদী। দাদার পাশের খাটে একটা কাঠের সিন্দুক ছিল। সিন্দুকে দাদা টাকা পয়সা ছাড়া গুড় মুড়ি, নাড়ু পিঠা, ফলমূল রাখতেন। দাদা খেতে ভালো বাসতেন। আমরা তার কাছ গেলে আমাদেরকেও তার খাবারের ভাগ দিতেন। দাদা যে ধরনের খাবার পছন্দ করতেন দাদী সেসব খাবার খেতেন না। দাদী শাক-সবজি-মাছ-ডাল দিয়ে অল্প একটু খেতেন
|আরো খবর
দাদা বাজার থেকে ফিরলে আমরা ছুটে যেতাম। তিনি আমাদের জন্য লাঠি লজেন্স, তালের বড়া, জিলাপি, রান্না করা বুট, আখ, আঙুর, কমলা নিয়ে আসতেন। ছোটরা সবাই দাদাকে ঘিরে থাকতাম। তিনি আমাদের হাতে হাতে খাবার দিয়ে বাকিটুকু সিন্দুকে রাখতেন। বাজার থেকে আনা পান, চুন, খয়ের, সাদা পাতা দাদীকে দেবার জন্য আমাদের হাতে দিতেন। দাদীর পান খাবার নেশা ছিল। প্রায় সারাদিনই মুখে পান থাকতো। মাঝে মধ্যে হাসতে হাসতে দাদা বলতেন, বাড়িতে জাবর কাটা এক বুড়ি আছে তার নাম কী? আমরা চেঁচিয়ে বলতাম জুলেখা। তিনি কার মেয়ে? আমরা বলতাম, বাদশার মেয়ে। মা-চাচী লাঠি নিয়ে তাড়া করলে আমরা পালিয়ে যেতাম। দাদার ছিল বিড়ির নেশা। দিনে দুই প্যাকেট স্টার বিড়ি খেতেন। দাদা ও দাদীর ঝগড়া ছিল মা, চাচী, জেঠীমার এক ধরনের বিনোদন। তারা মুখে আঁচল গুঁজে ঝগড়া শুনতেন। বেশির ভাগ ঝগড়া শুরু হতো সন্ধ্যাবেলা থেকে। যেমন, দাদা একটা বিড়ি ধরালেন। অমনি দাদী বলতে শুরু করলেন শুরু হয়ে গেছে মুখে আগুন দেয়া। ধোঁয়ার গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এই হারাম শুয়োর কেন যে খায়! কী মজা যে পায় তা আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। বাবা কেন যে আমাকে এমন একটা বদ লোকের হাতে সঁপে দিয়েছেন!! জীবন টা আমার অঙ্গার হয়ে গেছে। দাদীর এমন ফিরিস্তি দাদা শুনেন বলে মনে হয় না। কিছু সময় পর দাদা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। তখন হয়তো দাদী ছেচনিতে এক মনে পান ছেঁচছেন। নাক ডাকার আওয়াজে বিরক্ত হয়ে দাদী গলায় আওয়াজ তুলে বলেন, বাঁশি টা একটু থামান! দাদা হয়তো জেগে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, এতো জোরে চিল্লাস কেন? বাড়িতে কি ডাকাত পড়ছে, নাকি শ্বশুর বাড়ির কেউ এসেছে? দাদী কণ্ঠ স্বর আরেকটু চড়িয়ে বলেন, আপনার বেয়াই বেয়াইন বাঁশির ডাক শুনে চলে এসেছে। এখনো আমার বাপ-ভাইদের ছাড়া আপনার চলে না। একেকদিন একেক রকমের ঝগড়া করে তাদের দিন কাটে।
শৈশব কৈশোর পার করে যৌবনের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ থাকা মেয়ে বুবলি একদিন একটা প্রেমপত্র পাঠালো। অতঃপর দুজনেই গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রেম করতে লাগলাম। রিক্সা করে কোথাও যাওয়া আসার সময় বইখাতা আড়াল করে বুবলিকে চুমু দিতাম। একদিন বুবলিদের বাড়ি থেকে সংবাদ এলো, বুবলির বিয়ে ঠিক হয়েছে এক আর্মি অফিসারের সাথে। বিয়ে ঠেকাতে আমরা দুজন কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেললাম এবং আজিমপুরে সাবলেট নিলাম। দুটো কম্বল দিয়ে আমাদের সংসার শুরু হলো। দুজনে মিলে কঠিন এক সংগ্রামে লিপ্ত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়ে আমার চাকরি হলো ব্যাংকে আর বুবলির হলো বিসিএস প্রশাসনে। চার ছেলে-মেয়ের বাবা হলাম। প্রথমে দুটি মেয়ে পরে দুটি জমজ ছেলে। ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা শেষে বাসা থেকে উড়াল দিল। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে বিয়ের আটচল্লিশ বছর পার হয়ে গেল। অনেক কষ্টে উত্তরার বাড়িতে আমি আর বুবলি। অবসরের পর বুবলি নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করে।
বুবলির সাথে আমার আচার আচরণে, চলন বলনে, জীবন যাপনে, কথা বার্তায়, দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য গুলি প্রতিনিয়ত সামনে আসতে লাগলো। যৌবনে এসব পার্থক্য নজরে আসেনি তা নয়। ভেবেছিলাম সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যায় নি বরং বড় হয়ে গেছে। আমার পছন্দের কাজ হলো গান শোনা, নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখা আর মাঝে মধ্যে ফেসবুকিং করা। বুবলির মন্তব্য হলো, মাথায় ঘিলু কম থাকা লোকদের এসব পছন্দ। স্ত্রীর বিরক্তি এড়াতে মেয়ের রেখে যাওয়া বেড রুমে গান শোনা আর সিনেমা দেখা শুরু করলাম। নানা ঘটনার একপর্যায়ে সেটাই আমার বেড রুম হয়ে গেল। সারাজীবন আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের যথা সম্ভব এড়িয়ে চলেছি, কারণ আমার সময় ছিলো না। আজ আমার সময় আছে, কিন্তু অন্যদের নেই। এমনিতেই সামাজিক কর্মকাণ্ডে আমার কোনোদিনই কোনোরকম আগ্রহ ছিল না। ফলে নতুন নতুন লোকজনের সাথে তেমন কোনো পরিচয় হয়নি। বিকেলে হাঁটতে গিয়ে দু’চারজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু সম্পর্ক জমে উঠেনি। ফেসবুকে সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন পোস্ট পড়ে সামাজিক সচেতনতা বেড়েছে। কমবয়সী কয়েকজন নারীর কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পেয়ে উৎসাহিত হলাম। তারা যখন টাকা-পয়সা ধার চাইলো তখন আবার নিরুৎসাহিত হলাম। কালেভদ্রে বুবলির সাথে ডাইনিং টেবিলে দেখা হয়, কিন্তু একসাথে খাওয়া হয় না। অথচ একই থালে খাবার খেয়েছি বছরের পর বছর।
মাঝে মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বুবলির সাথে পুরানো দিনের ভালোবাসার স্মৃতি রোমন্থন করি। বুবলির উত্তর, ভালোবাসা তো পাটাপুতা না যে চিরদিন একসাথে থাকবে! বয়সের সাথে ভালোবাসার ধরণ পাল্টে যায়, যেমন করোনার ধরণ পাল্টায়! এখন হয়তো ডেল্টা ভেরিয়েন্ট শক্তিশালী। আবার হয়তো আরো শক্তিশালী কোনো ভেরিয়েন্ট এসে যাবে। ভালোবাসা তো প্রথম শারীরিক স্তর থেকে শুরু হয়। তুমি বুড়ো হয়েছো কিন্তু এখনো শারীরিক স্তর অতিক্রম করতে পারো নি। বয়সের সাথে সাথে মানুষের চিন্তার চাহিদার বিস্তর পরিবর্তন ঘটতে থাকে। নতুন নতুন পরিবর্তনগুলো তুমি ধরতে পারছো না কিংবা বুঝতে পারছো না। পারিবারিক এবং সামাজিক কারণে তোমার সাথে একই ঘরে বসত করি। অপেক্ষা করছি সম্পর্কের প্রাকৃতিক অবসানের জন্য। মানুষ আমাদের সুখী ভাবে। আমরাও সুখী হবার ভান করি। আমরা পুরানো জীবন যাপনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার কথা বলি, কিন্তু ভেঙ্গে ফেলার সাহস করি না।
আমার চোখের সামনে ভেসে আসে শৈশবে দাদা-দাদীর ঝগড়া। চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠে।