প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২২, ০০:০০
নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে জাঁকিয়ে তোলে। অনেক কাল আগের এ প্রবাদ এখনও যে সমকালীন আবেদনে সজীব তা প্রমাণ করতে খুব বেশি দূর যেতে লাগে না। ঊনিশশো কুড়ি সালের মার্চের সতর তারিখের আগে অনেক শেখ মুজিবের জন্ম হয়ে থাকতে পারে। ইতিহাস তাদের মনে রাখেনি। কিন্তু শেখ লুৎফর আর শেখ সায়েরার কোলে যে মুজিবের আগমন, ইতিহাস তাকেই আজও সমকালীন করে রেখেছে ঘাতকের হাতে মর্মান্তিক মৃত্যু আর ঘাতকের গডফাদার কর্তৃক নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। বাইগার আর মধুমতীর ¯েœহে সিক্ত মুজিব কেবল গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতী ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়াতেই আবদ্ধ থাকেননি, তিনি নিভৃত পল্লি ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বজুড়ে, সমুদ্রসীমা থেকে সুনীল অন্তরীক্ষে। নানার দেয়া নিজের নামকে মুজিবই জাঁকিয়ে তুলেছেন আপন কর্মে ও মহিমায় এবং মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পরও আজ হয়েছেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু। তাঁকে গর্ভে ধারণের বদৌলতেই টুঙ্গিপাড়া হয়েছে অজপাড়াগাঁ থেকে বিশ্বগ্রাম।
একজন বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা নন, একজন বঙ্গবন্ধু কেবল বিংশ শতকের নেতা নন, একজন বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বস্তরের মানুষের বিশ্বজনীন নেতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বশীল মন যেমন টুঙ্গিপাড়ার বাল্যবন্ধু মালেকের জন্যে কেঁদে উঠেছে, তেমনি কেঁদে উঠেছে ফিলিস্তিনের বঞ্চিত মানুষের জন্যে। কোন বর্ণবাদ থেকে নয়, কোন সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে নয়, বাহাত্তরে বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণের যে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিলো তা ছিলো কেবল ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতাকামী মানুষদের প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশ্য নিবেদন। তিনি যেমন স্থানীয় ‘দাওয়াল’ শ্রমজীবী-পেশাজীবীদের অধিকার নিয়ে সরকারের ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে বাক-বিত-ায় লিপ্ত হতে পারেন তেমনি তিনি আজমীরের পবিত্র দরগায় গান পরিবেশনকারী কাওয়ালদের প্রতিও প্রদর্শন করেন সহমর্মিতা। তিনি উর্দু গান না বুঝলেও সুরের অমৃতে হৃদয়ের সংবেদন অনুভব করে তাদেরও কিঞ্চিৎ অর্থ ইনাম দিয়ে আসেন, যদিও নিজের পকেটে ভাড়ার টাকার সঙ্কট তাঁর মাথায় ছিলো না তখন। মুজিব কখনোই নিজেকে বাঙালি মুসলমান পরিচয়ে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি বিশ্বজনীনতা চেয়েছেন বলেই যেখানে গিয়েছেন সেখানের সংস্কৃতি ও মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন। তিনি মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত কিংবা তার পূর্ববর্তী জামাল আব্দুল নাসেরের কাছে যেমন বন্ধু ছিলেন, বন্ধু ছিলেন যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর কাছে, তেমনি চীনের মাদাম সান-ইয়াৎ সেন-এর কাছেও ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন। তিনি গণতন্ত্রের দেশ ভারতে যেমন মহানায়ক হয়ে ছিলেন, তেমনি সমাজতন্ত্রের দেশ কিউবার ফিদেলের কাছে ছিলেন হিমালয়ের চেয়েও বিস্ময়ের। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ আর নিজের অবকাশ যাপনের ছুটি বাতিল করে বৃটিশ রীতিনীতি ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির দরজা খুলে তাকে এগিয়ে দেয়া প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথের কাছে শেখ মুজিব ছিলেন সমীহ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের অপর নাম। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে সমাজতন্ত্রের প্রথম শহিদ শেখ মুজিব ঊনিশশো বাহাত্তরের ঊনত্রিশে ফেব্রুয়ারি হতে পাঁচ মার্চে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণকালে সেদিন প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তাছাড়া ক্রেমলিনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ব্রেজনেভ (যিনি পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন) এবং প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের পাঠানো মাঝারি আকৃতির এক বিমানের যাত্রী হয়ে রাশিয়া ভ্রমণকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে মৈত্রীর মূর্ত প্রতীক। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে চঞ্চল সময় কাটানো বঙ্গবন্ধু জাপানীদের কাছে ছিলেন উন্নয়নের সমার্থক অনতিক্রম্য ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না, ছিলেন না মেকি অসাধারণত্বের কিংখাবে মোড়ানো জনগণ হতে দূরে থাকা রাষ্ট্রনায়ক। তিনি ছিলেন জনতার হৃদয়ের রাজা, ছিলেন যাদুকর এক মহান মানুষ। বঙ্গবন্ধু একজন আন্তর্জাতিক নেতা ছিলেন বলেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে। তিনি একদিকে যেমন ওআইসিতে যোগ দিয়েছেন তেমনি অন্যদিকে চীনের সমাজতন্ত্রের উত্তম পরিণামকে তাঁর দেশে দ্বিতীয় বিপ্লবের বীজ হিসেবে রোপণ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যে মধ্যপ্রাচ্য তাঁকে ইসলামিক রিপাবলিক করার নির্দেশ দিতে চেয়েছিলো তিনি তাদের মুখে ঝামা ঘষে বাঙালির বাংলাদেশ বলবৎ রেখেছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কখনোই কারো পকেটে না ঢুকে, কারো বশংবদ না হয়ে নিজেই নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছেন। তাঁর এই বিশ্বজনীনতা ফুটে ওঠে তাঁর সরকারের গৃহীত পররাষ্ট্র নীতিতে, যেখানে কারো সাথে বৈরিতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুতা নিয়েই তিনি পথ চলতে চেয়েছেন। তাঁর এ বন্ধুতার উষ্ণ পরশ যারা পেয়েছেন তারাই অনুধাবন করতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের বিশালতা। ঊনিশশো তিয়াত্তরের সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তাঁর দূরদর্শী প্রজ্ঞায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বিশ্বের শোষিত আর নির্যাতিতকে তাঁর মতো করে বুকে টেনে নিতে আর কেউ পারেনি, পারবেও না। তিনি এতটাই বিশ্বজনীন ছিলেন যে, সেই জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে মাত্র ছয়জনের জন্যে স্বাগত তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিলো যাদের মধ্যে মাত্র দুইজন জীবিত ছিলেন। একজন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং আর একজন ছিলেন যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো।
তাঁর রাজনীতি যেমন দুখি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর রাজনীতি ছিলো, তেমনি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ ছিলো তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে। এ কারণেই তিনি যুদ্ধোত্তর পাকিস্তানে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ওআইসি সম্মেলনে যেতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর চিন্তায় ছিলো বুদ্ধের সেই মহান বাণী, ‘শত্রুতার দ্বারা শত্রুতার উপশম হয় না।’ তাই যে ভুট্টো তাঁকে মেরে কবর দেয়ার জন্যে জেলে মাটি খুঁড়ে রেখেছিলো, সে ভুট্টোকে টেবিলে নিয়ে তিনি ওআইসি সম্মেলন করেছেন, তবে দেশের মানুষের সম্মান অক্ষুণœ রেখেছেন সর্বাবস্থায়। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা নিয়ে স্থলমাইন অপসারণ করলেও আঞ্চলিক রাজনীতির মোকাবেলায় কখনো পরাশক্তির দ্বারস্থ হননি। অথচ আজ মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তি ডেকে এনে আঞ্চলিক শান্তি ও ঐক্য ধূলিসাৎ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কোনো দেশকে আপন করে নিতে কাউকে দূরে ঠেলে দেননি। তিনি কারো দাবার গুটি যেমন হননি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, তেমনি নিজেই নিজের দূরদর্শী প্রজ্ঞায় হয়েছেন বিশ্বনেতা। ঊনিশশো তিয়াত্তরে কানাডায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ্ভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। অটোয়াতে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো সভাপতি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যই হয়ে ওঠে সবার আগ্রহের মহার্ঘ। বিশ্বশান্তির গুরুত্ব বোঝাতে পরাশক্তিদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছোট দেশগুলোর ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘হোয়েন দ্য এলিফ্যান্ট প্লেসেস গ্রাস সাফার্স।’ বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের সবাই দারুণ প্রশংসা করেছিলো। ঊনিশশো বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি ছয় তারিখে ভারত সফরকালে বিশ লাখ মানুষের মহা সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এতো মিল কেনো? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ মিল হলো বিশ্বশান্তির মিল। এই বিশ্ব শান্তি পরিষদই ঊনিশশো চুয়াত্তরের তেইশ মে তারিখে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি রক্ষায় অবদান রাখার জন্যে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। পদক প্রদানকালে রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুতে সীমাবদ্ধ নেই, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধু। প্রায় ছেচল্লিশ বছর আগে যে কথা বলা হয়েছিলো বিশ্ব শান্তি পদক দানকালে, আজ সেই ঘোষণাকেই প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বজনীনতার স্বীকৃতি দিলো জাতিসংঘ। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে মুজিববর্ষ পালন করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবছরকে স্মরণীয় করে রেখেছে এই সংগঠনটি। বঙ্গবন্ধুর লিখিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অনূদিত রূপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আজ বিস্তৃত হয়ে গেছেন সারা বিশ্বে। ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পর্তুগীজ ভাষায় অনূদিত হয়ে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি যেমন স্থাপিত হয়েছে ক্যাঙ্গারুদের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়, তেমনি তুরস্কেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নামে সরণি হয়েছে ভারতের কেলকাতায়। রাজধানী দিল্লিতেও হয়েছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। আমেরিকার শিকাগোতে হয়েছে শেখ মুজিব ওয়ে।
বিদেশি সাংবাদিকদের কাছেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন আদরণীয়। মার্কিন সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক অ্যানি লোপা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার সাক্ষাতের স্মৃতি নিয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের সাথে তার ঘরোয়া পরিবেশে সাক্ষাৎকালে মুজিব নিজেই চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে। তার একবারও মনে হয়নি অনেক বড় একজন নেতার সামনে তিনি বসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন অসাধারণ মনের পরিচয় পাওয়া তার ভাষ্যে সত্যিই কঠিন। অ্যানি লোপা তার সাংবাদিক জীবনে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন, বহু নেতানেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতো এমন সহজ-সরল মানুষের দেখা আর পাননি।
বিদেশি কবিরা-লেখকরাও বসে ছিলেন না বঙ্গবন্ধু বিষয়ে। পশ্চিম বাংলার বাঙালি লেখকরা যেমন কবিতা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেমনি গানও লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্যে। ভারতীয় মণিপুরি লেখক এলাংবম নীলকান্ত সিংহ (‘শেখ মুজিব স্মরণে’) হতে শুরু করে মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন (‘দি চার্টার্ড অ্যান্ড দ্য ডেমড’), সালমান রুশদী (‘মিডনাইট বিলড্রেম’ এবং ‘শেইম’), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (‘পূর্ব পশ্চিম’), জাপানি কবি মাৎসুও , গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি অ্যান ওয়ালশ, জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়ান কবি ইভিকা পিচেস্কি ও ব্রিটিশ কবি টেড হিউজসহ আরো অনেক বিদেশি কবি ও লেখকদের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানী পাঞ্জাবী কবি আহমেদ সালিম লাহোর ডিস্ট্রিক্ট জেলে আটক থাকা অবস্থায় ‘সিরাজউদ্দৌল্লাহ ধোলা’ কবিতাটি লিখে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ কবিতায় তিনি সিরাজউদ্দৌল্লাহ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে ফুটিয়ে তোলেন। ভারতীয় উর্দু কবি কাইফি আজমী ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় প্রসঙ্গক্রমে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন।
দেশের গ-ি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ডাকটিকেটের মাধ্যমেও বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রাজিলে, অস্ট্রেলিয়ায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পার্সোনালাইজড ডাকটিকেটের বিশেষ নিয়মে ডাক বিভাগ হতে ডাক টিকেট প্রকাশ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেমন বিশ্বের মানুষেরা আগ্রহ দেখিয়েছেন শ্রদ্ধায়, তেমনি বঙ্গবন্ধু নিজেও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি তাঁর অধ্যয়নের অভ্যাসের মাধ্যমে তাঁর পাঠবিশ্বকে বিস্তৃত করে বিশ্বজনীনতায় নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন। তিনি আলবেরুণির ‘ভারততত্ত্ব’, এমিলি জোলার ‘তেরেসা রেকুইন’, বার্ট্রা- রাসেলের ফিলসফি হতে শুরু করে নিয়মিত রিডার্স ডাইজেস্ট-এর পাঠ গ্রহণ করতেন। অ্যালান ক্যাম্পবেল জনসনের লেখা ‘মিশন উইথ মাউন্ট ব্যাটেন’ গ্রন্থটি তাঁর নখদর্পণে ছিলো বলা যায়। জ্ঞান চর্চা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে মুজিব নিজেকে সর্বদাই বিশ্বজনীন রাখার চেষ্টা করেছেন। তিনি ঊনিশশো বায়ান্ন সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শান্তি সম্মেলনে চীন সফরে গিয়ে তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত এবং রাশিয়ার লেখক অ্যাসিমভ-এর দেখা পান। তাঁদের লেখার সাথে বঙ্গবন্ধু যে পূর্ব পরিচিত ছিলেন তা তাঁর লেখার উচ্ছ্বাস থেকেই জানতে পারি। এমনকি তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত কমিউনিস্ট মতাদর্শী হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় কোপানলে পড়ে জেল খেটে শেষে রাশিয়ার রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন এ তথ্যও বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন। উপরোক্ত তথ্যের সমন্বয় হতে একথা আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন বিশ্বকে নখদর্পণে রাখতেন সর্বদা, তেমনি তিনিও বিশ্বের নেতা-কবি-সাংবাদিকদের নিকট অত্যন্ত প্রিয় ও মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধু যেমন হয়েছেন তাঁর ভক্তদের কাছে তেমনি তাঁর সাত মার্চের মহাভাষণ মেমরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারের অংশ হয়ে সারাবিশ্বের মানুষের গবেষণার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই মহাভাষণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু আরো অধিক পরিমাণে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছেন মৃত্যুপরবর্তী জীবনেও।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বজনীনতা বিস্তৃতভাবে ফুটে ওঠে ঊনিশশো তিয়াত্তর সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর যখন বঙ্গবন্ধু মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল এক মেডিকেল টিম পাঠালেন আর সাথে একদল মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদর্শী প্রজ্ঞায় আরবের দেশগুলোর সাথে যেমন একদিকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার সুযোগ নিলেন, তেমনি জানিয়ে দিলেন সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষুদ্র দেশ হলেও বাংলাদেশের হৃদয় মহৎ ও নেতৃত্বশীল। কিউবায় পাঠানো মেডিকেল টিমের পরে আরবে বড় মেডিকেল টিম পাঠানো মানেই বঙ্গবন্ধু ল্যাটিন আমেরিকা ও মরুর দেশে নিজের রাজনৈতিক দেশের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরলেন। বঙ্গবন্ধুর সমুদয় এ কর্মকা- তাঁর আন্তর্জাতিকতাকে আরো বেশি আলোয় নিয়ে আসে। পাকিস্তানের শালিমার গার্ডেনে যেমন বঙ্গবন্ধু না পৌঁছা অব্দি ওআইসি সম্মেলন শুরু হলো না, তেমনি বোম্বে বিমানবন্দরে রাত দুপুরে তাঁর জন্যে মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের কেবিনেট লাখ লাখ জনতাসহ দাঁড়িয়ে থাকাটা তাঁর অবিসংবাদিত জনপ্রিয়তার কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু কতটুকু আন্তর্জাতিক ছিলেন তা আজও বুঝা যায় কিছু কিছু ঘটনায় হাহাকারে। স্পেন হতে স্বাধীনতা চেয়ে ক্যাটালানদের আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতিহীন অঙ্কুরে যখন বিনষ্ট হয়ে গেলো তখনই বিশ্বের জনগণ আফসোস করে উঠেছে, ক্যাটালানদের একজন শেখ মুজিব নেই বলে। তেমনি রোহিঙ্গাদের পরিণতি ও ভোগান্তি হতে আমরা বুঝতে পারি, কেবলমাত্র জাদুকরি রাজনীতিক শেখ মুজিবই পারতেন হ্যামিলনের বংশী বাদকের মতো তাদের স্বভূমের অধিকার ফিরিয়ে এনে দিতে। কিংবা প্যালেস্টাইনীদের নিজভূমে আজ পরবাসী হওয়ার বেদনা দূর করতে পারতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জানতেন, কীভাবে জনতার বেদনা ও পাওয়া-না পাওয়ার ধারাপাতকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি দিতে হয়। বিশ্বজনীন এ জাদুকরি নেতার প্রতি শ্রদ্ধায় আকুল হওয়া এক অধ্যাপক ড. নাচুল দানিলচুক, যিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে বাংলা ভাষার অধ্যাপক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্যে দোভাষীরূপে কাজ করেছিলেন। তিনি ঊনিশশো তিয়াত্তর সালের ঊনত্রিশে ফেব্রুয়ারি তারিখে জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসের বিমান বন্দরে যখন বাংলা ভাষায় কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে, তখন বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ বিহ্বল থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। এই জড়িয়ে ধরাটাই বলে দেয়, বঙ্গবন্ধুর বুক ছিল বিশ্বজনীন মমতার এক উদার ক্ষেত্র। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বকে বুকে আগলে রাখার সেই মহান ছবিই আমাদের আগামীর পথ দেখায় অনেক দূরের গন্তব্যে পৌঁছার।
তথ্যঋণ :
১. ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-শেখ মুজিবুর রহমান
২. ‘আমার দেখা নয়াচীন’-শেখ মুজিবুর রহমান
পীযূষ কান্তি বড়–য়া : কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক।