রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

পোস্টমাস্টার : ধ্রুপদী সুরে আত্মার গান
অনলাইন ডেস্ক

গল্প! আমি গল্পের কথা ভাবলেই জীবন চলে আসে। জীবনের বাইরে গল্পের অবস্থান নয়। গল্পের ভেতরও জীবন জরুরি।

আমার গল্পাঙ্কনের জীবনে অনেক কথাচিত্রীর রং-তুলির অপূর্ব চিত্রণ দেখেছি। তাদের চিত্রিত ভাব ও ভাবনা আমাকে ভাবিয়েছে, আন্দোলিত করেছে। বুঝেছি, ব্যক্তিসত্তার বহুবর্ণিল চূর্ণনে আত্মজ্ঞান, আত্মবোধ কিংবা আত্মোপলব্ধির পরিপূর্ণ প্রকাশ-ক্ষমতার অপূর্ব ব্যবহারে গল্পের শরীর দাঁড় করানো সম্ভব।

অন্তর্দৃষ্টি আর অন্তর্দর্শনের অধিকারী না হলে সার্থক গল্পকার হওয়া যায় না। কারণ ছোটগল্পের পরিধি সীমিত, এতে ভাবের বিস্তার সহজসাধ্য কাজ নয়। মানুষের অন্তর্লীন মন অপার রহস্যে আবৃত। সেই রহস্যময় কুটিরের হদিস জানতে হয়। মনস্তাত্ত্বিক পরিচয়ের সাথে সাথে মনের অতলান্তের আশ্রয় আর প্রশ্রয়ের তাড়না অনুভব করার শক্তি অর্জন করতে হয়। গল্পে জীবনবাস্তবতা যেমন থাকতে হয়, তেমনি নাটকীয়তা, রোমা, নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনাও থাকতে হয়।

গল্পকার হবো এ রকম কোনো ইচ্ছে কিংবা তাড়না আমার ভেতরে কখনোই কাজ করেনি। সার্থক গল্পকার কখনোই হতে পারব না এটাও বুঝতে পারি, স্বীকার করি। তবুও আমি গল্পের পথে হাঁটছি। গল্পের প্রয়োজনে গল্পের পেছনে ছুটছি। মানুষের গল্প প্রয়োজন, জীবনের গল্প প্রয়োজন।

গল্প আমার মধ্যে ভালোলাগাবোধ জাগিয়ে তুলল। এমনটা কেন হলো? সাহিত্যচর্চার অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে সবসময় আকর্ষিত করে। সেই রবীন্দ্রনাথের গল্প-জীবন আমাকে প্রচ- ভাবিয়েছে। গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে প্রাপ্তি দিয়েছে। বুঝতে পেরেছি রবীন্দ্রনাথই বাংলা গল্পের প্রাণপুরুষ। রবীন্দ্র-ভাবনার বৈচিত্র্য অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে গল্পের সৌন্দর্য। বরীন্দ্র-গল্পচেতনায় একটা বড় অংশ জুড়ে আছে মানুষ ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গ মেলবন্ধন। তার তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ও জীবন-ঘনিষ্ঠ ভাবনায় নানাভাবে ফুটে উঠেছে মানবজীবনের বৈচিত্র্যময় অধ্যায়।

তবে রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ আমাকে অন্য এক ঘোরের মধ্যে নিয়ে গেছে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প আমার গল্প-ভাবনাকে কিভাবে উসকে দিয়েছিল সেই কথা আজ বলব। তার আগে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।

‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি মায়ার গল্প। কামজ প্রেমহীন দুটি নরনারীর কাছে আসার গল্প, কাছে থাকার গল্প এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার গল্পও। অনাথিনী এক বালিকার বিশ্বাসের, ভালোবাসার, অবলম্বনের গল্প। তেমনি পোস্টমাস্টারের পক্ষ থেকে আত্মোপলব্ধির, বাস্তবতার গল্প। দুজনের ক্ষণিক সুখস্পর্শের গল্পও।

রতনের পক্ষ থেকে অবলম্বনটা প্রয়োজনের হলেও আবেদনটা ছিল হৃদয়ের। রতন পোস্টমাস্টারকে আপন ভাবতে পেরেছিল, আপন করে নিয়েছিল। গল্পের ভেতরে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাই

‘ঘরের এক কোণে একটি ক্ষীণ শিখা প্রদীপ জ্বালিয়ে পোস্টমাস্টার ডাকিতেন ‘রতন।’ রতন দ্বারে বসে এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করে থাকত কিন্তু এক ডাকেই ঘরে আসত না; বলত, “কি গো বাবু, কেন ডাকছ।”’

রতনের ভেতর অন্তরের টান থাকা সত্ত্বেও সঙ্কোচ ছিল। এরকম বালিকা-সুলভ আচরণের মাঝেই রতনের মনে সুখ লুকিয়ে ছিল। একটা ডাকের শব্দ, একটু আহ্বানই রতনকে জাগিয়ে রাখত। রতনের পৃথিবীতে আনন্দ খেলা করত।

অথচ পোস্টমাস্টার রতনকে আপন করে নিয়েছিল দায়িত্বের খাতিরে কিংবা অনাথিনীর প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে। সঙ্গীহীন জীবনে সঙ্গ পাওয়ার মানসে। গল্প থেকে দেখা যাক

‘আপিসের কাঠের চৌকির উপর বসিয়া পোস্টমাস্টারও নিজের ঘরের কথা পাড়িতেন। ছোটভাই, মা এবং দিদির কথা, প্রবাসে একলা ঘরে বসিয়া যাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিত তাহাদের কথা। যে-সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনোমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিত বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসংগত মনে হইত না।’

আগেই বলেছি, পোস্টমাস্টারের আচরণ যতটা না হৃদয়ের, তারচেয়ে বেশি ছিল নিঃসঙ্গ মনে সঙ্গ পাবার আকাক্সক্ষা। সেই সঙ্গ থেকে ¯েœহের জন্ম হয়। তখন দয়ার থেকে দায়িত্ব বড় হয়ে ওঠে। তাই তো একদিন দেখি, রতনের উদ্দেশ্যে পোস্টমাস্টার বলছে, “তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব।”

এদিকে পোস্টমাস্টারের অর্থাৎ মনিবের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হোক কিংবা দায়িত্বানুভূতির আচরণে মুগ্ধ হয়ে হোক, রতন অন্তর দিয়ে এ ভালোলাগাটুকু গ্রহণ করেছিল এবং পোস্টমাস্টারের মুখে তার পরিবারের কথা শুনে পোস্টমাস্টারের পরিবারকে নিজের পরিবার বলে, একান্ত আপনার লোক বলে ভাবতে পেরেছিল। পোস্টমাস্টারের ছোট ভাইকে নিজের দাদা, দিদিকে দিদি এবং মাকে নিজের মা বলে ভেবেছিল।

গল্প থেকে পড়া যাক, ‘অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথনকালে তাহার ঘরের লোকদিগকে মা দিদি দাদা বলিয়া চির-পরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমনকি, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল।’

রতনের জগৎ হয়ে উঠেছিল পোস্টমাস্টারকে ঘিরে। অথচ একদিন হঠাৎ করে রতনের ডাক কমে আসতে দেখে বালিকাহৃদয় ব্যথিত হয়েছিল। রতন ডাক শোনার জন্য দ্বারের নিকট অপেক্ষা করে থাকত। একদিন, অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে যখন ফিরে যাবার উপক্রম, তখন শুনতে পেল

“রতন।”

রতন তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে বলল, “দাদাবাবু, ঘুমাচ্ছিলে?”

পোস্টমাস্টার কাতরস্বরে বললেন, “শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না, দেখ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।”’

রতন দেখে দাদাবাবুর রোগকাতর শরীর। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে বালিকা রতন আর বালিকা রইল না। সেই মুহূর্তে সে জননীর পদ অধিকার করে বসল। বৈদ্য ডেকে আনলো। যথাসময়ে বটিকা খাওয়ালো। সারারাত্রি শিয়রে জেগে রইল। আপনি পথ্য বেঁধে দিল এবং শতবার করে জিজ্ঞেস করল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”

একদিন ক্ষীণ শরীর নিয়ে পোস্টমাস্টার রোগশয্যা ত্যাগ করে উঠল এবং স্থির সিদ্ধান্ত নিলো, আর নয়, এখান থেকে বদলি নিয়ে চলে যাবে। পোস্টমাস্টার একদিন সন্ধ্যা বেলায় রতনকে ডাকলেন। রতন ঠিক আগের মতোই উদ্বেলিত হৃদয়ে গৃহে প্রবেশ করে বলল’ “দাদাবাবু, আমাকে ডাকছিলে?”

পোস্টমাস্টার বললেন, “রতন, কালই আমি চলে যাচ্ছি।

রতন-কোথায় যাচ্ছ দাদাবাবু।

পোস্টমাস্টার-বাড়ি যাচ্ছি।

রতন-আবার কবে আসবে।

পোস্টমাস্টার-আর আসব না। ”

রতন তখন কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে পারে নি। স্বজন হারানোর ব্যথা এবং অবলম্বনহীন ভাবনা নিয়ে রতন ভাবনার গভীরে ডুবে ছিল। ভাবতে ভাবতে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পোস্টমাস্টারকে বলেই ফেলল, “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে।”

পোস্টমাস্টর হেসে বললেন, “সে কী করে হবে?”

পোস্টমাস্টারের পক্ষ থেকে অনাত্মীয় এক অনাথিনীকে এভাবে বলাই যায়। এভাবে সরাসরি একটা আবদার নাকচ করাতে রতনের মনে কতটুকু কষ্ট জমা হতে পারে কিংবা আপনজন বিয়োগে ছোট মন কতটা ভেঙে পড়তে পারে তা পোস্টমাস্টারের উপলব্ধিতে আসে নি। তাই হেসে বলতে পেরেছিল, “সে কী করে হবে?” কী কী কারণে বালিকা রতনকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব তা বিস্তারিত বলার প্রয়োজনীয়তাটুকু অনুভব করে নি।

কিন্তু সেই হাসি যে একটা বালিকাহৃদয়ের রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে তার খবর কে রাখে! সমস্ত রাতের স্বপ্নে ও জাগরণে পোস্টমাস্টারের হাস্যধ্বনির কণ্ঠস্বর ওর কানে বেজেছিল, ‘সে কী করে হবে?’

রতনও প্রচ- অভিমানী। গল্প থেকে দেখে নেওয়া যাক পোস্টমাস্টারের প্রতি অভিমানে রতন কী রকম নারীসুলভ আচরণ করেছিল।

পোস্টমাস্টার একদিন বললেন, ‘রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাকে বলে দিয়ে যাব, তিনি তোকে আমারই মতন যতœ করবেন; আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।’

রতন বলেছিল, ‘তোমাদের কাউকে কিছু বলতে হবে না। আমি থাকতে চাই নে।’

বালিকাহৃদয় যে অভিমানে কখনো কখনো পূর্ণ নারী হয়ে উঠে তা রতনের অদ্ভুত আচরণ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়। যে রতন প্রভুর অনেক তিরস্কার নীরবে সহ্য করেছে। তাহলে নরম কথা, পরম আশ্বাসের কথা সহ্য করতে পারল না কেন? এ রকম অভিমান আপনজনের সাথেই মানুষ করে। আপনজনের প্রতি অভিমান ছাড়া পরম আশ্বাসের মুহূর্তে এ কথা কি কেউ বলতে পারে?

বিদায় মুহূর্তেও রতন আর পোস্টমাস্টারের আপন আপন চিত্র খুব সুন্দর ফুটে ওঠে গল্পে।

যাবার বেলায় পোস্টমাস্টারের হৃদয়ও একবার নড়ে উঠেছিল। অনাথ রতনের করুণ মুখচ্ছবি কল্পনায় বেশে উঠলে মনে হয়েছিল ফিরিয়া যায়, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত অনাথিনী রতনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। কিন্তু যখনই নদীকূলের শ্মশান চোখে পড়ল, তখনই তার মনে তত্ত্বের উদয় হলো, বিচ্ছেদকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হলো।

গল্প থেকে, ‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী, পৃথিবীতে কে কাহার।’

কিন্তু রতনের মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হয় নি। ওর মনে ছিল ভালোবাসা, প্রেম, মায়া। এ-সম্পর্কের সৌন্দর্যে রতন এতটাই মিশেছিল যে, ওর মনে হচ্ছিল দাদাবাবু নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। বন্ধনের মায়া ছেড়ে কিছুতেই দূরে থাকতে পারবে না।

পোস্টমাস্টার আর রতনের সম্পর্ক ছিল প্রভু আর ভৃত্যের। এ সম্পর্কে রতনরা যতটা মায়ার অধিকারী হয় কিংবা যেভাবে ভালোবাসা ঢেলে আপন করে নিতে পারে, পোস্টমাস্টার চরিত্রের প্রভুরা সেভাবে ভালোবাসতে পারে না। তারা দায়িত্ব পালন করতে পারে কিংবা দায়িত্ব-কর্তব্যের পথে সমাজের একজন সচেতন ব্যক্তির পরিচয় দিতে পারে। এ দায়িত্ববোধে যোগ্য পাওনা হয়তো মিটিয়ে দিতে পারে, কিন্তু পূর্ণতা দিতে পারে না।

‘পোস্টমাস্টার’ গল্প পড়ার পরও ছোটগল্প অনেক পড়েছি। অনেক গল্প মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে, ভাবনাকে উসকে দিয়েছে, ব্যথায় মনে পূর্ণ বিষাদ কিংবা আনন্দ-প্রাপ্তিতে মন উৎফুল্ল হয়েছে। তারপরও, সবকিছু ছাপিয়ে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প আমার গল্প লেখার জীবনকে ত্বরান্বিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে।

আজও পোস্টমাস্টার গল্পের সুর ও কথা আমাকে প্রাণিত করে, আন্দোলিত করে, ধ্রুপদী সুরে দেহের ভেতর জন্ম দেয় অলৌকিক গান।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়