প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
পৃথিবীবাসী যখন অশান্তি ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির চরম মুহূর্ত অতিক্রম করছিল তখনই পৃথিবীতে শুভাগমন করেছিলেন (৫৭০ খ্রিস্টাব্দে) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহামানব ও শান্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)। মহান আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছিলেন অশান্ত ও অস্থির এই পৃথিবীতে ন্যায়-ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব দিয়ে। ইরশাদ হচ্ছে, 'আমি তোমাকে গোটা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।' (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান দয়িত্ব পালনে তিনি তার গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
ফুজ্জারের যুদ্ধের পরে কিশোর মুহাম্মদ (সাঃ) নিপীড়িত ও নিগৃহিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে 'হিলফুল ফুজুল' গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মক্কার সম্ভ্রান্ত যুবকেরা মুহাম্মাদ (সাঃ) এ নেতৃত্বে যে কোন যুলুম অত্যাচার প্রতিরোধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হন। নবুয়াত প্রাপ্তির পরেও তিনি এ ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলতেন, 'আমি আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে এমন চুক্তিতে যোগদান করেছিলাম, যার বিনিময়ে লাল উটও আমার পছন্দ নয়। আজও এ ধরণের কোন চুক্তি সম্পাদনে আমাকে ডাকা হলে আমি অবশ্যই তাতে শরিক হবো।' (বায়হাকি : ১২৮৫৯)।
নবী কারিম (সাঃ) যখন ৩৫ বছরের টগবগে যুবক কোরাইশগণ তখন কাবাঘরের পুনঃনির্মাণ শুরু করে। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ প্রতিস্থাপন নিয়ে দেখা দেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশঙ্কা। প্রত্যেকগোত্রই হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে স্থাপন করা নিয়ে তুমুল বিবাদে জড়িয়ে পরল। ঐ সময় কুরাইশদের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইবনে মুগিরা এ দ্বন্দ নিরসন কল্পে একটি প্রস্তাব পেশ করে বললেন, 'হে কোরাইশগণ! এই পবিত্র মসজিদের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবে, তাকেই তোমরা এই বিবাদ মিমাংসার দায়িত্ব দাও।' সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। অতঃপর দেখা গেল, ঐ দরজা দিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বপ্রথম প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, এতো আমাদের পরম বিশ্বস্ত মুহাম্মদ! আমরা সবাই তার যে কোন সিদ্ধান্ত মানতে প্রস্তুত। যুবক মুহাম্মদ (সাঃ) তার প্রখর মেধা ও প্রজ্ঞা খাটিয়ে একটি চাদর আনতে বলেন। তিনি নিজ হাতে চাদরের ওপর পাথরটিকে রেখে চার গোত্র প্রধানকে সেটি বহন করে যথাস্থানে নিয়ে স্থাপন করে দিলেন। আর এভাবেই তিনি চরম উত্তেজনাপূর্ণ যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৯৭)
হিজরতের ছয় বছর পরে ওমরা পালনের জন্য ১৪০০ শত সাহাবাদের নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হোদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কোরাইশরা তাঁদের গতি রোধ করে। মুশরিকরা যে কোন মূল্যে মুসলমানদেরকে মক্কায় প্রবেশে করতে বাধা দিতে তৎপর হয়ে উঠল। মুশরিকদের এই অন্যায় আস্ফালনের চুড়ান্ত জবাব দিতে মুসলমানগণ রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুমতির অপেক্ষায় ছিলেন। মুসলমানরা খোদায়ী মদদে কুফরী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারণ ইতোমধ্যেই বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা যে ছিল মুসলমানদের! তারা কোনভাবেই নতজানু হবার পাত্র নয়। এক অদম্য মনবল নিয়ে রাসূলের হুকুমের অপেক্ষা করছিলেন তারা। কিন্তু আল্লাহর রসুলুল্লাহ (সাঃ) শান্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাহাবাদের প্রতিরোধ আকাঙ্ক্ষা ও প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও মুশরিকদের সাথে এক অসম চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। যার ধারাগুলি ছিল (১) উভয় পক্ষ আগামী ১০ বছরের জন্য কোন যুদ্ধে জড়াবে না। (২) এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই ফিরে যেতে হবে (৩) আগামী বছর মুসলমানরা ওমরা করতে এসে তিনদিনের বেশি অবস্থান করতে পারবে না। আর আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র বহন করতে পারবে না। (৪) কোরাইশদের কোন লোক যদি তাদের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া পালিয়ে মদিনায় চলে এলে মুসলমানরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। (৫) কোন মুসলমান ইসলাম ছেড়ে মক্কায় চলে এলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।
প্রত্যক্ষ্য দৃষ্টিতে চুক্তির শর্তগুলো মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও রসুলুল্লাহ (সাঃ) 'যুদ্ধ নয় শান্তি' এই নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, মুসলমানরা একটি শান্তিকামী দল। তারা জোর-জবরদস্তি ও নৈরাজ্যে বিশ্বাস করে না। তাছাড়া এই চুক্তির মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। এই চুক্তির মাধ্যমেই মূলতঃ কুরাইশগণ মুসলমানদের কুটনৈতিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যা ছিল মুসলমানদের জন্য এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক বিজয়।