প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আল কুরআনের প্রত্যেকটি তথ্য সত্য
এশতিয়াক মাহমুদ
ডাঃ মরিচ বুকাইলি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন ফেরাউনের মমি করা লাশের দিকে। রাত গভীর হয়েছে। কিন্তু তিনি হিসেব মেলাতে পারছেন না। এ কী করে সম্ভব! কী এমন রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে এর পেছনে! শত শত বছর ধরে মেডিকেল সায়েন্সকে একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি লাশ কীভাবে টিকে থাকল! লাশের দেহে পাওয়া গেছে লবণ, যা প্রমাণ করে এটিকে সমুদ্র থেকে তোলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কেন কার্যকর হলো না লাশের শরীরে!
বলছি প্যারিসের এক ল্যাবরেটরির কোনো এক মধ্যরাতের দৃশ্যপট নিয়ে। এই দৃশ্যপটটি যে সময় সংঘটিত হচ্ছিল, সে সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিত্রা। তিনি মিসর সরকারের কাছে অনুরোধ করেছিলেন তার দেশ ফেরাউনের মমিকে ফ্রান্সে নিতে চায়। উদ্দেশ্য মমিটি নিজেদের আয়ত্বের ভেতরে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করা। সে সময়কার মিসর সরকার ফ্রান্সের এই অনুরোধ বিবেচনা করে সায় দিলো তাতে। মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে ফেরাউনের মমি নিয়ে আকাশে ওড়া বিমানটির গন্তব্য প্যারিস। বিমান যথারীতি পৌঁছে গেল প্যারিস এয়ারপোর্টে। ফেরাউনের মমি করা লাশ বিমান থেকে অবতরণ করল অনেকটা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। এককালের দোর্দ- প্রতাপশালী মিশর শাসক বলে কথা! মমিকে স্বাগত জানাতে বিমান বন্দরে স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। সাথে উজির নাজির অমাত্যবর্গ। বিমানের সিঁড়ি দিয়ে ফেরাউনের মমি নামানো হচ্ছে। সবার মধ্যেই টান টান উত্তেজনা। সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীবর্গ এবং ফ্রান্সের সিনিয়র অফিসারগণ। কুর্নিশ করে ফেরাউনকে স্বাগত জানালেন তারা। জমকালো প্যারেডের মাধ্যমে রাজকীয়ভাবে বরণ করে নেওয়া হলো এককালের মিশর অধিপতি ফেরাউনের মমি করা লাশকে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফ্রান্সের প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের একটা বিশেষ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো মমি, যেখানে অপেক্ষমান ফ্রান্সের সবচেয়ে বড়ো সার্জনগণ।
তারা ফেরাউনের মমির ময়নাতদন্ত করে সেটা নিয়ে স্টাডি করবেন। এই মমির টিকে থাকার পেছনের গোপনীয়তা আবিষ্কার করাই তাদের লক্ষ্য। উদ্ঘাটন করবেন এর হাজার হাজার বছর ধরে অবিকল টিকে থাকার গভীর এবং জটিল রহস্য। এই গবেষক দলের প্রধান ডাঃ মরিস বুকাইলি। গবেষক দলের মধ্যে যারা থেরাপিস্ট ছিলেন, তারা চাচ্ছিলেন ক্ষত অংশগুলো ঠিক করে মমিটিকে পুনর্গঠন করবেন। কিন্তু ডাঃ মরিস বুকাইলির দৃষ্টি ছিল ভিন্ন দিকে। তিনি প্রথমেই ফেরাউনের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করতে চাচ্ছিলেন। এ নিয়েই ভাবতে শুরু করলেন তিনি। অবশেষে দীর্ঘ গবেষণার একপর্যায়ে মৃত্যুরহস্য স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর কাছে। পানিতে ডুবেই যে ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হলেন তিনি। কিন্তু লাশটি টিকে থাকল কীভাবে, সেই রহস্যের কোনো কুল-কিনারা করতে পারলেন না। ব্যাকটেরিয়া এখানে অকার্যকর কেন? অতঃপর ডাঃ মরিচ বুকাইলি রিপোর্ট তৈরি করলেন এবং বললেন, ‘এটি এক নতুন আবিষ্কার, যা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য সহায়ক হতে পারে।’ এরমধ্যে তাঁর এক কলিগ জানালেন ফেরাউনের ডুবে যাওয়া এবং তার লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে মুসলিমদের ধর্মীয় পুস্তক আল কুরআনে বলা হয়েছে। কথাটা বিস্মিত করল ডাঃ মরিসকে। তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? এই মমি পাওয়া গেছে সবেমাত্র সেদিন; ১৮৮১ সালে, আর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে! আরবের লোকজন প্রাচীন মিসরীয়দের মমি করার পদ্ধতি জানতোই না। আমরাই তো এটা জানলাম মাত্র কয়েক দশক আগে! 'ডাঃ মরিস বুকাইলি সেই রাতে ফেরাউনের লাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘসময় বসে রইলেন। গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন তাঁর কলিগের কথাটি। বাড়তে থাকল তাঁর কৌতূহল। এ বিষয়ে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত তথ্যগুলোর খোঁজ নিতে লাগলেন। তিনি দেখলেন বাইবেলে ফেরাউন কর্তৃক মুসা আলাইহিস সালামের পিছু নেওয়ার কথা বলা হলেও শেষমেষ ফেরাউনের লাশের কী হয়েছিল, সে সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। তিনি ভেবে পেলেন না আরবের মরুভূমির এক নিরক্ষর মানুষের আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এমন একটি তথ্য তাহলে কী করে জানবার কথা! এ তো অবিশ্বাস্য! নাছোড়বান্দা ডাঃ বুকাইলি। তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন প্রশ্নগুলোর উত্তর জানবার জন্য। তিনি এ-ও বুঝতে পারলেন এসব প্রশ্নের উত্তর হুবহু পেতে হলে তাঁকে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করতে হবে। সেগুলোতে উপস্থাপিত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে তাঁকে। সে রাতে নির্ঘুম রাত কাটালেন তিনি। এরপর তাওরাত (তোরাহ্) সংগ্রহ করলেন। দেখলেন তাওরাতে লেখা রয়েছে, ‘পানি এলো এবং ফেরাউনের সৈন্য ও তাদের যানবাহনগুলোকে ঢেকে দিলো। যারা সমুদ্রে ঢুকল, তাদের কেউই বাঁচতে পারল না।’ কিন্তু ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছুই বলা নেই তাওরাতে। তাহলে ইসলামের নবি মুহাম্মাদ এই তথ্য কী করে জানলেন!
এ পর্যায়ে ডাঃ মরিস কোনো একটি মুসলিম দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। উদ্দেশ্য সেখানকার প্রখ্যাত অটোপসি বিশেষজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের সাক্ষাৎকার নেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে তাঁর সমগ্র গবেষণার ফলাফল অবহিত করলেন এবং এ বিষয়ে কুরআনের কোনো বক্তব্য সত্যিই রয়েছে কি না জানতে চাইলেন। তখন মুসলিম বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পবিত্র কুরআন খুললেন এবং সংশ্লিষ্ট আয়াতটি ডাঃ মরিসকে পড়ে শোনালেন। আয়াতটি এমন, ‘সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি সংরক্ষণ করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল।’ [সূরা ইউনুস : ৯২]
কুরআনের এই আয়াতটি শোনার পর সত্যি সত্যিই হতভম্ব হয়ে পড়লেন ডাঃ মরিচ বুকাইলি। সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হলো এই গ্রন্থটি মানুষের রচিত হওয়া কোনোভাবেও বাস্তবসম্মত নয়। আরবের মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে শত শত বছর আগে মিশরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার এমন বিবরণ দেওয়া একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব। কুরআনের এই অভিনব সত্য দর্শনে সেই মুহূর্তেই তিনি জোর গলায় চিৎকার দিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি ইসলামে বিশ্বাস করি, আমি এই কুরআনে বিশ্বাস করি।’ এ ঘটনার পর ফ্রান্সে ফিরে গেলেন ডাঃ মরিস বুকাইলি। কিন্তু তখন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। বিশ্বাসের হিরণ্ণময় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। পরবর্তী ১০ বছর পেশাগত ডাক্তারী প্রাকটিস বন্ধ রাখলেন এবং গভীর সাধনার মধ্য দিয়ে শিখে ফেললেন আরবি ভাষা। এরপর সমগ্র কুরআন আদ্যোপান্ত গবেষণা করলেন তিনি। সবকিছুই বিস্মিত করছিল তাঁকে। সেই অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে লিখে ফেললেন পৃথিবীবিখ্যাত বই, ‘ইরনষব ছঁৎধহ ্ ঝপরবহপব.’ এই বই পৃথিবীর অন্তত ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটির একটি উক্তি হলো, ‘ঞযব ছঁৎধহ ফড়বং হড়ঃ পড়হঃধরহ ধ ংরহমষব ংঃধঃবসবহঃ ঃযধঃ রং ধংংধরষধনষব ভৎড়স ধ সড়ফবৎহ ংপরবহঃরভরপ ঢ়ড়রহঃ ড়ভ ারব'ি. অর্থাৎ কুরআনে এমন একটি তথ্যও নেই, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।