প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
দুনিয়ার জীবনের হাকিকত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) তিনি সাদাসিধে জীবন-যাপন করতে পছন্দ করতেন। কোনো প্রকার উচ্চাভিলাষ ও রং তামাশা করতে পছন্দ করতেন না। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘একদিন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে খেজুর পাতার বিছানা শুয়ে থাকতে দেখি। খেজুর পাতার বিছানার উপর আর কিছুই বিছানো ছিল না, তার মাথার নিচে একটি চামড়ার বালিশ ছিল। পায়ের দিক দিয়ে একটি উন্মুক্ত তলোয়ার আর মাথার পাশের্^ খাবারের একটি পোটলা। আমি তার মুবারক দেহে বিছানার দাগ দেখে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, তুমি কি কারণে কাঁদছ? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! রোম ও পারস্যের রাজা-বাদশাহরা দুনিয়ার কত শান শওকত নিয়ে থাকে, আর আপনি আল্লাহর রাসূল; উভয় জাহানের বাদশাহ হয়ে একটি খেজুরের পাতার বিছানায় শুয়ে আছেন। আমার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাদের জন্য দুনিয়া, আমাদের জন্য আখিরাত হওয়াতে তুমি কি সন্তুষ্ট নও।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৯১৩)।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দুনিয়ার সবকিছু তুলে ধরা হলো এবং তাকে দুনিয়াদারি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি দুনিয়াকে গ্রহণ না করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। দু’হাত দিয়ে দুনিয়াকে না করেন এবং দুনিয়ার প্রস্তাবকে প্রতিহত করে দুনিয়াকে পিছনে ফেলে দেন। তারপর তার সাহাবীদের কাছে দুনিয়াকে তুলে ধরা হলো এবং তাদের নিকটও দুনিয়া পেশ করা হলো। তাদের কেউ কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ অবলম্বন করল এবং দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করল; তবে তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আবার তাদের মধ্যে কতক আছে যাদের নিকট দুনিয়াকে পেশ করা হলে তারা বলে, হে দুনিয়া! তুমি বল, তোমার মধ্যে কি কি রয়েছে? তখন বলা হলো, হালাল, হারাম, মাকরূহ ও সংশয়যুক্ত বিষয়ের সমন্বয়েই দুনিয়া। তখন তারা বলল, দুনিয়া থেকে যা হালাল তা আমাদের দাও, এছাড়া অন্যগুলোতে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা দুনিয়ার হালাল বস্তুকে অবলম্বন করল আর হারাম, মাকরূহ ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করল। তারপর তাদের পরবর্তীদের জন্য দুনিয়াকে পেশ করা হলে, তারা বলল, দুনিয়ার হালাল বস্তুসমূহকে আমাদের জন্য রেখে যাও। তাদের জন্য হালাল বস্তুসমূহ তালাশ করে পাওয়া গেল না। তখন তারা মাকরূহ ও সংশয়যুক্ত বস্তুসমূহ তালাশ করলে, দুনিয়া তাদের জানিয়ে দিল, তা তো তোমাদের পূর্বের লোকেরা গ্রহণ করে ফেলছে। তখন তারা বলল, তাহলে তুমি আমাদেরকে তোমার হারাম বস্তুসমূহ দাও, তখন তাদের হারাম বস্তুসমূহ দেওয়া হলে তারা তা গ্রহণ করল। তারপর তাদের পরবর্তীরা দুনিয়া তালাশ করলে তাদের দুনিয়া জানিয়ে দেয় যে, দুনিয়া অত্যাচারীদের কবজায় চলে গেছে। তারা দুনিয়া বিষয়ে তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করছে। তখন তারা দুনিয়া হাসিলের জন্য অতি উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন কলা, কৌশল ও তাল-বাহানা অবলম্বন করে। তখন অবস্থা এত নাজুক হবে যে, কোনো অপরাধী হারাম বস্তুর দিক হাত বাড়ালে দেখতে পাবে, তার চেয়ে আরও অধিক খারাপ ও শক্তিশালী অপরাধী তার প্রতি তার পূর্বেই হাত বাড়িয়ে আছে। অথচ একটি কথা মনে রাখতে হবে, দুনিয়াতে আমরা সবাই মেহমান, আমাদের হাতে যেসব ধন-সম্পদ আছে, তা সবই আমাদের নিকট আমানত। যেমনটি আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘দুনিয়াতে সবাই মেহমান, আর তার ধন-সম্পদ হলো আমানত, মেহমান অবশ্যই বিদায় নেবে, আর আমানতকে প্রকৃত মালিকের নিকট আদায় করা হবে’।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ দুনিয়ার প্রতি কখনোই লোভী ছিলেন না। তারা ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও তার শিক্ষা-দীক্ষার অগ্রপথিক। তাই তারাও ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো দুনিয়া বিমুখ এবং আখিরাত অভিমুখী। সাহাবীগণ কখনো ভোগ-বিলাসের জীবন যাপন করেন নি। তারাও সাদাসিদা জীবন-যাপন করতেন। তারা ছিলেন কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির আদর্শ। সাহাবীগণ সবসময় আখিরাতকে দুনিয়ার জীবনের ওপর প্রাধান্য দিতেন।
খলিফাতুল মুসলিমীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু অনেক ভালো ভালো ও সু-স্বাদু খাওয়ার খাওয়া এবং পানীয় পান করা হতে বিরত থাকতেন এবং অভিজাত ও দামী খাওয়া ও পানীয় থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। আর তিনি বলতেন, আমি আশঙ্কা করি আমি যেন তাদের মো না হই, যাদের বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘আর যেদিন কাফিরদেরকে জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে (তাদেরকে বলা হবে) ‘তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনে তোমাদের সুখ সামগ্রীগুলো নিঃশেষ করেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ। তোমরা যেহেতু অন্যায়ভাবে জমিনে অহংকার করতে এবং তোমরা যেহেতু নাফরমানী করতে, সেহেতু তার প্রতিফলস্বরূপ আজ তোমাদেরকে অপমানজনক আযাব প্রদান করা হবে’। [সূরা আহকাফ, আয়াত: ২০]
আবু মিজলায বলেন, কতক সম্প্রদায় এমন আছে, যারা দুনিয়ার অনেক কল্যাণ যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, তা তারা হারাবে, তখন তাদের বলা হবে, ‘তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনে তোমাদের সুখ সামগ্রীগুলো নিঃশেষ করেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ।’ [সূরা আহকাফ, আয়াত: ২০]
দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বতের কারণে সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। মারামারি কাটাকাটি ইত্যাদির মুল কারণ, হলো দুনিয়ার মহব্বত। বর্তমান সমাজে আমরা দেখতে পাই ভাই ভাইয়ে সাথে, পিতা পুত্রের সাথে এবং পাড়া প্রতিবেশীর সাথে দুনিয়াকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই আছে। অনেক সময় তা শুধু ঝগড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা হত্যা জেল-যুলুম ইত্যাদিতে রূপ নেয়। মোটকথা দুনিয়ার মহব্বত হলো সব গুনাহ পাপাচার ও অপরাধের মূল।
দুনিয়ার মহব্বত মানুষকে গুনাহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য করে। তারা দুনিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে হালাল হারাম ন্যায় অন্যায় কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করে না। যেখানেই দুনিয়া লাভ দেখে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ ইবন হারেস ইবন নওফল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘মানুষ সব সময় দুনিয়ার অনুসন্ধানে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে’। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৯৫)
মুয়াজ ইবন জাবাল থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে ইয়ামনের দিকে পাঠান, তখন তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা ভোগ-বিলাস ও অপচয় করা হতে সতর্ক থাক। কারণ, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বান্দারা কখনোই ভোগ-বিলাস ও অপচয় করেন না’ (আহমদ, হাদীস নং ৬১৬০০।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘এই হচ্ছে আখিরাতের নিবাস, যা আমরা তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা জমিনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।’ [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৩]
কা‘ব ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দু’টি ক্ষুধার্ত বাঘকে কোনো ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া, ছাগলের পালের জন্য ততটা ক্ষতিকর নয়, যতটা ক্ষতিকর হয় একজন মানুষের দীনের জন্য, যখন তার মধ্যে ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও ক্ষমতার লোভ থাকে’। ;(তিরমিযী, হাদীস নং ২৩৭২। ইমাম তিরমিযি হাদীসটিকে সহীহ ও হাসান বলেন আখ্যায়িত করেন।)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চিহ্নত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘বৃদ্ধ মানুষের অন্তর দু’টি জিনিসের মহব্বতে যুবক। দুনিয়ার মহব্বত ও ধন-সম্পদের মহব্বত’। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৪৬)
অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আদম সন্তান বুড়ো হয়, তবে তার দু’টি জিনিস জোয়ান হতে থাকে। এক. ধন-সম্পদের লোভ, দুই. দুনিয়ার জীবনের লোভ’।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যদি আদম সন্তানের ধন-সম্পদের দু’টি উপত্যকা থাকে, তখন সে আরও একটি উপত্যকা তালাশ করবে। আর আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কোনো কিছু দ্বারাই পুরো করা যাবে না। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করবেন যাকে তিনি ক্ষমা করার ইচ্ছা করেন’।
বর্তমানকে প্রাধান্য দেওয়া প্রতীক্ষিত ভবিষ্যতের ওপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী।’ [সূরা আল-আ‘লা, আয়াত: ১৭]
দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বত থাকার কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। দুনিয়া মানুষের জন্য অনিবার্য ও জরুরি, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, এ দুনিয়াই হবে একজন মানুষের শেষ প্রান্তর ও জীবনের সবকিছু। দুনিয়া হলো একজন মানুষের জন্য আখিরাতের ক্ষেত ও সেতুবন্ধন স্বরূপ। একজন মানুষের শেষ প্রান্তর ও গন্তব্য হলো, আখিরাতের জীবন ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন। দুনিয়াতে তার যাবতীয় কাজ ও আমল হবে তার আসল গন্তব্য ও শেষ ঠিকানার জন্য। দুনিয়া তার আসল গন্তব্য বা শেষ ঠিকানা নয়। এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের দুনিয়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হতে বা ঝুঁকে পড়তে নিষেধ করেন এবং দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা যাতে ধোঁকায় না পড়ি এ জন্য তিনি আমাদের সতর্ক করেন। দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়াতে নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তা চাই নগদে হোক অথবা পরবর্তীতে হোক।
দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের চাবিকাঠি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘দুনিয়াতে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতির চাবি হলো, আশাকে খাট করা বা অধিক আশা করা হতে বিরত থাকা। আর যাবতীয় সব কল্যাণের চাবি হলো, আখিরাতের আকাঙ্ক্ষা করা ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি বেশি বেশি ধাবিত হওয়া। আর সমস্ত অনিষ্টের চাবি হলো, দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বত ও লম্বা আশা। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে আমরা অনেকেই আছি এমন যারা কোনো জিনিসে কল্যাণ আর কোনো জিনিসে অকল্যাণ তা আমরা ভালোভাবে জানি না। অথচ এ বিষয়সমূহের ইলম হলো অত্যন্ত উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণ ও অকল্যাণের চাবি কি তা জানা অনেক বড় ইলম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তা জানা ও তার ওপর আমল করার তাওফীক দেন না। আল্লাহ যাদের চান কেবল তাদের কল্যাণ দেন। আর যাদের তিনি চান না তাদের চেয়ে হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ হতে পারে না। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভালো ও খারাপ সবকিছুর জন্য চাবি ও দরজা নির্ধারণ করে রেখেছেন। একজন মানুষ তা দিয়ে তার নিকট প্রবেশ করেন (হাদীউল আরওয়াহ ৪৭)
দুনিয়ার মহব্বত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে কুফুরী করা ও তার নাফরমানীর কারণ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মানুষ ঈমানদার অবস্থায় সকাল উদযাপন করে, আর বিকালে সে কাফির আবার ঈমানের অবস্থায় বিকাল অতিবাহিত করে কিন্তু সকালে সে ঈমান হারা হয়ে যায়। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের জন্য সে তার দীনকে বিক্রি করে দেয়’।(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৮)।শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, ‘একজন কাফির সেও কুফুরীর ক্ষতি সম্পর্কে জানে, কিন্তু দুনিয়ার মহব্বত তাকে কুফরের ওপর উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফুরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর কুফুরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছে, তাদের ওপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফুরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত। এটা এজন্য যে, তারা আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে পছন্দ করেছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফির কাওমকে হিদায়াত করেন না। এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহ, শ্রবণ সমূহ ও দৃষ্টিসমূহের ওপর আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই হচ্ছে গাফেল। সন্দেহ নেই, তারাই আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত’। [সূরা নাহাল, আয়াত: ১০৬ -১০৯]
আখিরাতের শাস্তির পূর্বে দুনিয়াতেই শাস্তির সম্মুখীন হওয়া। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘দুনিয়ার মহব্বতকারী তার দুনিয়া দ্বারা সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক শাস্তি ভোগ করবে। সে তার জীবনের তিনটি স্তরে সর্বাধিক বেশি আযাবের সম্মুখীন হবে। দুনিয়াতে তার শাস্তি হলো, ধন-সম্পদ অর্জন করার জন্য চেষ্টা করা ও এর জন্য দুনিয়াদারদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা ইত্যাদির কষ্ট। আর আলমে বরযখেও সে অধিক কষ্ট পাবে। সেখানে সে দুনিয়া হারানোর কষ্টে ও বেদনা অনুভব করবে এবং আফসোস করতে থাকবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, তার মধ্যে ও তার সম্পদের মাঝে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ ঘটেছে আর কখনোই তার সাথে এবং তার সম্পদের সাথে দেখা হবে না এবং দুনিয়ার বিনিময়ে এখানে আর কোনো বন্ধু সে পাবে না যা তার সমপর্যায়ের হবে, তখন তার কষ্টের আর অন্ত থাকবে না। আর লোকটি কবরেও অনেক আযাবের অধিকারী হবে। ধন-সম্পদ হারানো চিন্তা, আফসোস, পেরেশানি তার আত্মায় এমনভাবে আঘাত করতে থাকবে যেমনটি সাপ, বিচ্ছু ও পোকাণ্ডমাকড় তার দেহে আঘাত করতে থাকে’।
তিনি আরও বলেন, ‘দুনিয়াদারকে কবরে শাস্তি দেওয়া হবে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে সাক্ষাতের দিন তথা কিয়ামতের দিনও অধিক শাস্তি দেওয়া হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘অতএব, তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে তাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তানাদি, আল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের আযাব দিতে চান দুনিয়ার জীবনে এবং তাদের জান বের হবে কাফির অবস্থায়।’ [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫৫]
কোন কোনো মনীষী বলেন, ‘তাদের ধন-সম্পদ একত্র করার কারণে শাস্তি দেওয়া হবে। আর তাদের অবস্থা এমন হবে ধন-সম্পদের মহব্বতে তাদের জান যাওয়ার উপক্রম হবে। শুধুমাত্র সম্পদের মহব্বতে দুনিয়াতে তারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হক আদায়ে অস্বীকার করেছিল’। (উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৯।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকিরে অন্তর স্বাদণ্ডআস্বাদন না করা শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, ‘অন্তরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকিরের জন্য। এ কারণেই সিরিয়ার পূর্বসূরি জ্ঞানীদের থেকে একজন জ্ঞানী (আমার জানা মতে তার নাম সুলাইমান আল খাওয়ায রহ.) তিনি বলেন, যিকির অন্তরের জন্য দেহের জন্য খাদ্যের মতো। দেহ যখন অসুস্থ হয়, তখন সে যেমন খাওয়ারের মজা পায় না অনুরূপভাবে যে অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত থাকে সে অন্তর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকিরের মজা পায় না’। (মাজমুয়ুল ফাতওয়া ৯/৩১৬)
আবি ইমরান আল মিসরী বলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দাউদ আলাইহিস সালামের নিকট ওহী প্রেরণ করে বলেন, হে দাউদ তুমি আমার ও তোমারা মাঝে এমন কোনো আলিমকে নির্বাচন করো না যার অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত জায়গা করে আছে। যেসব আলিমদের অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত গেঁথে আছে তারা আমার বান্দার জন্য পথের কাটা। আমি তাদের সর্বনিকৃষ্ট যে শাস্তি দেব, তা হলো, তাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আমার সাথে মোনাজাতের স্বাদ চিনিয়ে নেব’। (হাদীসে খাইসামাহ ১৬৬।
দুনিয়ার মহব্বত মানুষকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকির থেকে বিরত রাখে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘দুনিয়ার মহব্বত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকির ও তার ভালোবাসা থেকে মানুষকে বিরত রাখে। আর যার ধন-সম্পদ তাকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকির থেকে বিরত রাখে, সে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। মানবাত্মা যখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকির হতে গাফেল হয়, তখন শয়তান তাতে স্থান করে নেয় এবং সে যেদিক ইচ্ছা করে তাকে সেদিক নিয়ে যায়’। (উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৬)।
আল্লামা ইবনুল জাওজী রহ. বলেন, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি দুনিয়া প্রত্যেক তৃষ্ণার্তের জন্য নিরেট পরিচ্ছন্ন হয়, প্রতিটি অনুসন্ধানকারীর জন্য সহজলভ্য এবং দুনিয়া আমাদের জন্য স্থায়ী হয়; কোনো ছিনতাইকারী চিনিয়ে না নেয়, তাহলেও দুনিয়া থেকে বিমুখ হওয়া ফরয ও ওয়াজিব। কারণ, দুনিয়া মানুষকে আল্লাহ হতে বিরত রাখে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়। আর যে নি‘আমত নি‘আমতদাতা থেকে বিরত রাখে তাকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। অন্যথায় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। (তাজকিরাতুল ওয়াজ ৭১)।
একজন দুনিয়াদারের জন্য দুনিয়াই হলো, তার শেষ গন্তব্য আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘যখন কোনো বান্দা দুনিয়াকে মহব্বত করে, তখন দুনিয়াই তার লক্ষ্য হয়ে থাকে; সে দুনিয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই বুঝতে রাজি হয় না। তার কাছে আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেসব আমলকে আখিরাত লাভ ও দুনিয়ার কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করছে, সেসব আমলগুলোকে সে দুনিয়া উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে বিষয়টি পাল্টে যায় আর অর্ন্তনিহিত হিকমত উলটপালট হয়ে যায়। মোটকথা, এখানে দু’টি বিষয় আছে, এক- মাধ্যমকে লক্ষ্য বানিয়ে নেওয়া, দুই- আখিরাতের আমল দ্বারা দুনিয়া উপার্জন করা। আর এ হলো সর্বনিকৃষ্ট উলটপালট এবং মানবাত্মার জন্য সবচেয়ে জঘন্য ও মারাত্মক পরিণতি। এ ধরনের লোকের ক্ষেত্রে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী হুবহু প্রযোজ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করে, আমি সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল পুরোপুরি দিয়ে দিই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেওয়া হবে না। এরাই তারা, আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই এবং তারা সেখানে যা করে তা বরবাদ হয়ে যাবে আর তারা যা করত, তা সম্পূর্ণ বাতিল’। [সূরা হুদ, আয়াত: ১৫, ১৬] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমরা তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিই এবং আখিরাতে তার জন্য কোনো অংশই থাকবে না’। [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২০]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দিই, যা আমরা চাই, যার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়। আর যে আখিরাত চায় এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মুমিন অবস্থায়, তাদের চেষ্টা হবে পুরস্কারযোগ্য’। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১৮-১৯]
এখানে তিনটি আয়াত আছে একটি আয়াত অপর আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য এবং আয়াত তিনটির অর্থ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি ও আখিরাতের কল্যাণকে বাদ দিয়ে, দুনিয়া ও দুনিয়া সৌন্দর্য কামনা করে, তার ভাগে তাই মিলবে সে যা চায়; সে আর কোনো কিছু পাবে না। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে একাধিক বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো আয়াতের ব্যাখ্যা করে এবং আয়াতের অর্থকে সমর্থন করে’। (উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৬)।
পেটের পূজা করা ও আত্মার মৃত্যু হওয়া আল্লামা ইবনুল যাওজী রহ. বলেন, “দুনিয়ার মহব্বতকারীর দৃষ্টান্ত যদিও সে ইবাদত বন্দেগীতে খুব কষ্ট করে থাকে, ধান ছিটানোর মতো একজন উঠায় অপরজন রাখে। ফলে তা আর তার জায়গা থেকে সরে না, কমও হয় না আবার বেশিও হয় না। অনুরূপভাবে যার অন্তর দুনিয়ার মহব্বতে মশগুল, আর তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল, বাহ্যিক দিক দিয়ে সে আজীবন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভে পরিশ্রম করে যাচ্ছে, আর অন্তরের দিক দিয়ে সে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে দূরে সরছে। তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন নাই। সে তা জায়গাই অবস্থান করছে, জায়গা থেকে সরতে পারছ না।
দুনিয়ার মহব্বত মানবাত্মার জন্য একটি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ব্যাধি । এ ব্যাধির চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরী। আর মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা আছে। চিকিৎসা ছাড়া কোনো রোগ নেই। চাই দৈহিক রোগ হোক অথবা আত্মার রোগ। দৈহিক রোগের চেয়ে আত্মার রোগ মানুষের জন্য আরও অধিক ক্ষতিকর ও মারাত্মক। মানুষ দুনিয়াতে দৈহিক রোগকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে, আত্মার রোগকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। যার ফলে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অশান্তির সৃষ্টি হয়। মানবাত্মার ব্যাধি একজন মানুষের জীবনকে বিষণ্ণ করে তুলে। সুতরাং মানবাত্মায় যেসব সংক্রামক ও ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় তার চিকিৎসা কি তা জানা ও তদনুযায়ী চিকিৎসা করা ফরয। দুনিয়া মহব্বত এটি মানবাত্মার একটি ক্ষতিকর ও মারাত্মক ব্যাধি। অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ও জর্জরিত।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “ইসহাক ইবন হানী রহ. তার মাসায়েলের আলোচনায় বলেন, “একদিন আবু আব্দুল্লাহ রহ. হাসান রহ. এর কথা নকল করে বলেন, একদিন আমি তার ঘর থেকে বের হই: তখন হাসান রহ. বলেন, তোমরা দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে কর। আল্লাহর শপথ করে বলছি! তুমি দুনিয়াকে একবারেই তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট পাবে, যখন তুমি তাকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট বলে জানবে। হাসান রহ. আরও বলেন, আমি পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে থাকলাম নাকি পূর্ব প্রান্তে তাতে আমি কোনো পরওয়া করি না। আমাকে আবু আব্দুল্লাহ রহ. বলেছেন, হে ইসহাক! আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট দুনিয়া কতই না নিকৃষ্ট!(উদ্দাতুস-সাবেরীন ১৮৫
দুনিয়া খুব দ্রুত ধ্বংস আর আখিরাত অতি নিকটে এ বিষয়ে চিন্তা করা আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “যে দুনিয়া প্রেমিক ও দুনিয়ার মহব্বতকারী দুনিয়াকে আখিরাতের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে, সে দুনিয়াতে সবচেয়ে নির্বোধ, বোকা ও জ্ঞানহীন। কারণ, সে বাস্তবতার ওপর নিছক ধারণাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আর নিদ্রাকে প্রাধান্য দিয়েছে জাগ্রত থাকার ওপর। দুনিয়াতে সে ক্ষণস্থায়ী ছায়া যা একটু পর থাকবে না, তাকে বেঁচে নিয়েছে, চিরস্থায়ী নিয়ামত যার কোনো শেষ বা পরিণতি নেই তার বিপরীতে। আর সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী জীবনকে স্থায়ী জীবনের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে। চিরস্থায়ী হায়াত, উন্নত জীবন ব্যবস্থাকে ক্ষণস্থায়ী, পথনিন্দ্রা ও স্বপ্নের বিনিময় বিক্রি করে দিয়েছে। কোনো জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক এ কাজ করতে পারে না এবং এ ধরনের ধোঁকায় পড়তে পারে না। তাদের দৃষ্টান্ত হলো, একজন লোক অপরিচিত লোক কোনো সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট আসল, তখন তারা তার সামনে খাওয়া, দাওয়া পেশ করলে, সে খেয়ে একটি তাঁবুর ছায়াতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর তারা যখন তাঁবুটি খুলে ফেলল, তখন লোকটি আক্রান্ত হলে ঘুম থেকে উঠে বলল, “যদি কোনো মানুষের নিকট তার বড় চাওয়া পাওয়া দুনিয়াই হয়ে থাকে। তাহলে মনে রাখতে হবে সে অবশ্যই একটি ধোঁকার রশিকে মজবুত করে ধরে আছে। এ ছাড়া আর কিছুই না”।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, “হে মুহাম্মাদ তুমি মানুষকে জানিয়ে দাও, দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবন, যে জীবনের সৌন্দর্য ও নি‘আমত অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে, তা থেকে তোমাদের কি আমি চিরন্তন ও উত্তম জীবন সম্পর্কে সংবাদ দেব? তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ বিষয়ে বলেন, “বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়েও উত্তম বস্তুর সংবাদ দিব? যারা তাকওয়া অর্জন করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর পবিত্র স্ত্রীগণ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি’। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, “আর তোমরা স্বল্প মূল্যে আল্লাহর অঙ্গীকার বিক্রি করো না। আল্লাহর কাছে যা আছে, তোমাদের জন্যই তাই উত্তম যদি তোমরা জানতে”। [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৯৫]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, “তোমাদের নিকট যা আছে তা ফুরিয়ে যায়। আর আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। আর যারা সবর করেছে, তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমরা তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিব”। [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৯৬]
অল্পে তুষ্টি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, “প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে।” [সূরা আত-তাকাসুর, আয়াত: ১]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তির জীবনে আখিরাত অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অন্তরকে অভাব মুক্ত করে দেন। তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সম্পদকে সহজ করে দেন। আর দুনিয়া তার নিকট অপমান অপদস্থ হয়ে আসতে থাকে। আর যে ব্যক্তির জীবনে দুনিয়া অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দরিদ্রতা ও অভাব তার চোখের সামনে তুলে ধরেন এবং তার ওপর বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দেন। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ভাগ্যে যতটুকু দুনিয়া লিপিবদ্ধ করেছেন, তার বাহিরে সে দুনিয়া হাসিল করতে পারবে না’। (তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৬৫)
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, হাসান রহ. আরও বলেন, ‘হ আদম সন্তান! তুমি তোমার অন্তরকে দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করো না। যদি তাই কর, তবে তুমি খুব খারাপ বস্তুর সাথে তোমার অন্তরকে সম্পৃক্ত করলে। তুমি তার সাথে সম্পর্কের রশি কেটে দাও, দরজাসমূহ বন্ধ করে দাও। হে আদম সন্তান! তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যতটুকু তোমাকে তোমার আসল গন্তব্যে পৌঁছাবে’। (উদ্দাতুস-সাবেরীন)।
আাল্লাহ আমাদেরকে বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুক। -আমিন।
লেখক : মুফতী মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক, ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর,চাঁদপুর।