প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
‘সময়’ মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অন্যতম নিয়ামত। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তের সাথে জড়িয়ে আছে সময়। এটি মহান আল্লাহ তা’আলার এমন একটা সৃষ্টি যা সবার জন্য সত্য; সকল সৃষ্ট বস্তুর নির্দিষ্ট সময় বা আয়ু রয়েছে। সারা বিশ্বজগৎ একদিন শেষ হয়ে যাবে; এর জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া আছে। সৃষ্টির শুরু হতে কিয়ামত পর্যন্ত কোন সময়, কোন ঘটনা ঘটবে সব কিছু মহান আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘কিতাবুম মারকুম অর্থাৎ এটা লিপিবদ্ধ কিতাব।’ (সূরা মুতাফফিফিন : ৯) প্রত্যেক মানুষ দুনিয়াতে আগমন করেছে নির্দিষ্ট কিছু সময় নিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ের পর কোন প্রাণী বা সৃষ্টির বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্ কাউকেও অবকাশ দিবেন না।’ (সূরা মুনাফিকুন : ১১)
এখন প্রশ্ন হলো, সময় কী? উত্তরে বলা যায় : যা এইমাত্র অতীত হলো-তাই সময়। এখন যে মুহূর্ত আমরা অতিক্রম করছি- সেটাই সময়। কিছুক্ষণ পরে যেখানে আমরা প্রবেশ করব- সেটাই সময়। এটি সর্বাবস্থায় চলমান। সময় নামের অক্টোপাস থেকে কে, কখন, কবে মুক্তি পেয়েছে বলুন? আল্লাহ তা’আলা সময়কে সৃষ্টির মাঝে এমনভাবে স্থাপন করেছেন; যাতে মানুষ সময়ের গুরুত্ব দিতে শিখে। সফল তারাই, যারা এই সময়কে ঠিকঠাক উপলব্দি করতে পারেন। বিশেষত মু’মিন জীবনে সময় মানেই নিজের মুক্তি ও পুরুষ্কার নিশ্চিত করে নেওয়ার মওকা। কারণ, দুনিয়ার জীবনের এ নির্দিষ্ট ও স্বল্প সময়ের উপর নির্ভর করছে, পরবর্তী অনন্তকালের জীবনের পরিণতি। তাই একজন মু’মিনের মালিকানায় থাকা সবচেয়ে দামি, মূল্যবান ও সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ এই সময়। অন্য সম্পদ হারিয়ে গেলে আবার ক্রয় করা যায়; কিন্তু সময় নামক এ সম্পদ হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। হাসান বসরি (রহ.) বলেন- ‘হে আদম সন্তান! তুমি মুষ্টিমেয় কিছু দিনের সমষ্টি মাত্র। এক এক করে দিন যখন চলে যায়, তখন তোমার জীবনের একটা করে অংশ চলে যায়।’ (হিলইয়াতুল আওলিয়া) আল্লামা ইউসূফ আল কারযাবি বলেন, ‘সময় একটি ধারালো তরবারি। যদি তুমি তাকে আটকাতে না পার, তাহলে সে তোমাকে কেটে ফেলবে।’ (আল ওয়াকতু ফি হায়াতিল মুসলিম) এজন্য একজন মু’মিন সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করবেন।
সময়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, ‘সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত! তবে তারা নয় যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সূরা আসর : ১-৩) এমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল কারীমে সূরা ফজর (দিনের প্রারম্ভ), সূরা লাইল (রাত), সূরা দোহা (সকাল), সূরা ফালাক (প্রভাত) ইত্যাদি নাযিল করে সময় সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘অধিকাংশ মানুষ দু’টি নেয়ামত সম্পর্কে গাফেল তা হলো: সুস্থতা ও অবসর। ’ (সহীহ বুখারী-৫৯৩৩) সময়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের মধ্যেও সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; আর এটা অবশ্য কর্তব্য কাজের অন্তর্ভুক্ত। নির্দিষ্ট ইবাদত গুলো সময়ের আগে করাও জায়েজ নয় আবার পরে করারও সুযোগ নেই। আল্লাহ তা’আলা এর দ্বারা আমাদেরকে বুঝিয়েছেন, কোনো কোনো কাজ তার নির্দিষ্ট সময়ের আগেও কবুল হবে না, পরেও না। যেমন সালাত সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মু’মিনদের ওপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। ’ (সূরা নিসা: ১০৩) সাওম সম্পর্কে বলেন, ‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি (রমাজান) পাবে, সে এ মাসে রোজা রাখবে। ’ (সূরা বাকারা:১৮৫) হজ্জ সম্পর্কে বলেন, ‘হজ্জে কয়েকটি মাস আছে সুবিদিত। ’ (সূরা বাকারা: ১৯৭) জাকাত সম্পর্কে বলেন, ‘এর (উশর) অংশ ফসল সংগ্রহের দিন পরিশোধ করে দাও। ’ (সূরা আনআম: ১৪১) এজন্য কল্যাণ লাভ ও সফল হতে হলে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কাজে মনোনিবেশ করতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ কাজকে গুরুত্বহীন কাজের উপর প্রাধান্য দিতে হবে, উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কাজ করতে হবে এবং মর্যাদাময় সময়ে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উমর (রাঃ)কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘শোনো! দিনে আল্লাহর কিছু কাজ রয়েছে, যা রাতে কবুল হবে না, আর রাতে কিছু কাজ রয়েছে, যা দিনে কবুল হবে না। ’ (আল ওয়াকতু ফি হায়াতিল মুসলিম) তাইতো মুসলিম স্কলারগণ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে দিনের সময় ওজনের ‘দাঁড়িপাল্লা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা জুমাকে সপ্তাহের, রমজানকে বছরের এবং হজ্জকে জীবনের দাঁড়িপাল্লা গণ্য করতেন। তারা চাইতেন- মানুষ দিনের কাজ দিনে শেষ করুক, সপ্তাহের কাজ সপ্তাহে, মাসের কাজ মাসে এভাবে পুরো জীবনকে কাজে লাগাবে। কারণ, সময় কারো জন্য বসে থাকে না, ফিরেও আসে না। হাসান বসরি রহ. চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘ফজর ভেদ করে আলোতে আসা প্রতিটি দিন ডেকে বলে: হে আদম সন্তান! আমি এক নতুন সৃষ্টি। আমি তোমার কাজের ব্যাপারে সাক্ষী। আমার নিকট থেকে রশদ সংগ্রহ করো। কারণ, আমি বিদায় নেওয়ার পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কখনোই ফিরে আসব না।’
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘একজন বিবেকবান মানুষের চার ধরনের সময় থাকা উচিত :
(ক) একটা সময় গোপনে রবের কাছে প্রার্থনা করবে।
(খ) একটা সময় সে নিজেকে মূল্যায়ন করবে।
(গ) একটা সময় আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করবে।
(ঘ) একটা সময় খাবার ও পানীয় সংগ্রহের জন্য ব্যয় করবে।
(সহিহ ইবনে হিব্বান) সময়ের গুরুত্ব এতবেশি যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সময়ের বিষয়ে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। কিয়ামতের দিন যে চারটি প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া পর্যন্ত বান্দার পা বিন্দু পরিমাণ নড়বে না; তার প্রথম দু’টিই সময় সম্পর্কে। জীবন সম্পর্কে; তা কোন কাজে ব্যয় করেছে। যৌবন সম্পর্কে; কীভাবে তা ক্ষয় করেছে। সময়ের স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা মহা হিসাবের দিন আমাদের এ পৃথিবীর প্রত্যেকটি দিনের হিসাব নিবেন। হিসাব দিতে হবে প্রতিটি শব্দের, প্রতিটি বাক্যের; তিনি বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।’ (সূরা ক্বাফ : ১৮) বলা হবে তুমি তোমার সময়ের হিসাব দাও। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘পাঠ কর তুমি তোমার আমলনামা! আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (সূরা বনী ইসরাইল:১৪) হাদিসে রাসূল (সাঃ) পাঁচটি জিনিসের পূর্বে যে পাঁচটি জিনিসকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন, তার মধ্যে একটি হলো- ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে। তেমনিভাবে, যারা দুনিয়াতে সময়কে গুরুত্ব দেয়নি, আল্লাহর দেওয়া নির্ধারিত সময়ে আমলে সালেহের মাধ্যমে পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করেনি; কিয়ামতের দিন তারা আর্তনাদ করে কিছু সময় চাইবে! কিন্তু তাদেরকে কোনো সময় দেওয়া হবে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে বের করুন। এতদিন আমরা যে আমল করেছি, তার পরিবর্তে আমরা এখন নেক আমল করবো। আল্লাহ বলবেন: আমি কি তোমাদেরকে এতো দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখন কেউ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারতো? তোমাদের নিকট তো সতর্ককারীরাও এসেছিল।’ (সূরা ফাতির : ৩৭)
তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো সময়ের প্রতিটা অংশকে কোন না কোন উপকারী কাজে ব্যয় করা, দুনিয়ার ব্যস্ততার মাঝেও পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করা, আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, কল্যাণকর জ্ঞানার্জন করা। অবসর সময়ে ব্যস্ততার সময়ের মূল্যায়ন করা। অবসর সময়কে গণিমত মনে করে কাজে লাগানো; যেন সময়ের ক্ষুদ্র মুহূর্তও বিফলে না যায়। আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) এর একটি হাদিস থেকেও আমরা এ নির্দেশনা পাই। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যদি কিয়ামত এসে উপস্থিত হয় আর তোমাদের কারও হাতে একটা গাছের চারাও থাকে, তোমরা সুযোগ পেলে তা রোপণ করো।’ (মুসনাদে আহমদ) রাসূল (সাঃ) আরও বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন জান্নাতীদের শুধু এতটুকুই আফসোস থাকবে যে, দুনিয়ার জীবনে অবসর সময়ে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করলে জান্নাতে তাদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেতো।’ তাই আর নয় সময় অপচয়, সময়ের কাজ সময়ে করি, তবেই সময় হয়ে উঠবে আলোকময়, আমাদের জীবন ভরে উঠবে সোনালি সাফল্যের মোড়কে, হবে যথার্থ এবং কল্যাণকর।
লেখক : প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।