প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে আরও জানিয়ে দেন, দুনিয়ার জীবন কখনোই চিরস্থায়ী নয়, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, দুনিয়ার জীবন নিঃসন্দেহে শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনে মানুষ অনন্ত অসীম কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং আখিরাতের অফুরন্ত, অসংখ্য, অগণিত ও চিরস্থায়ী নি‘আমতসমূহের প্রতি অগ্রসর হতে তাগিদ ও নির্দেশ দেন।
মুমিনদের দুনিয়ার জীবন মুল লক্ষ্য হতে পারে না। তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো আখিরাত। তাই মুমিনরা দুনিয়াতে তাদের যাবতীয় কর্ম দ্বারা আখিরাত লাভের চেষ্টা চালিয়ে যায়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হলো বৃষ্টির মতো, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।’ [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২০]
আয়াতের তাফসীর : আল্লামা কুরতবী রহ. বলেন, এ আয়াতে মা শব্দটি সম্পর্ক স্থাপনকারী। আয়াতের অর্থ হলো, তোমরা জেনে রাখ! দুনিয়ার জীবন হলো, নিষ্ফল ও অনর্থক খেলাধুলা এবং আনন্দদায়ক কৌতুক ও বিনোদন। তারপর তা অচিরেই নিঃশেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লামা কাতাদাহ রহ. বলেন, ক্রীড়া ও কৌতুক শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো, খাওয়া ও পান করা। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন হলো, কেবলই খাওয়া ও পান করার নাম, এ ছাড়া আর কিছু না। আবার কেউ কেউ বলেন, শব্দদ্বয়ের ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই এখানে উভয় শব্দ তার নিজস্ব অর্থেই ব্যবহার হয়েছে। আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন, শব্দদ্বয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই- দু’টির অর্থ একই। অর্থাৎ সব খেলাধুলাই কৌতুক আবার সব কৌতুকই খেলাধুলা। তাফসীরে কুরতুবী [১৭/২৫৪]
আল্লামা ইবন কাসীর রহ. বলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবনের বিষয়টিকে নিকৃষ্ট ও নগণ্য আখ্যায়িত করে বলেন, ‘দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র’। অর্থাৎ দুনিয়াদারদের নিকট দুনিয়ার নির্যাস ও সারসংক্ষেপ এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্যত্র বলেন, মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যখেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগ সামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তন স্থল’। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪]
তারপর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবনের একটি উপমা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, দুনিয়ার জীবন হলো, সাময়িক চাকচিক্য ও সৌন্দর্য এবং ক্ষণস্থায়ী নি‘আমত, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই। তিনি আরও বলেন, দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত হলো, সেই বৃষ্টির মতো, যে বৃষ্টির প্রতীক্ষা করতে করতে মানুষ হতাশ হয়, তারপর হঠাৎ বৃষ্টি এসে যায়। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আর তারা নিরাশ হয়ে পড়লে তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তাঁর রহমত ছড়িয়ে দেন। আর তিনিই তো অভিভাবক, প্রশংসিত।’ [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২৮]
বৃষ্টির দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদের খুশি করে ও আনন্দ দেয়। যেমনিভাবে বৃষ্টির দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদের খুশি করে এবং আনন্দ দেয়, অনুরূপভাবে কাফিরদেরও দুনিয়ার জীবন সাময়িক খুশি করে এবং আনন্দ দেয়। কারণ, তারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি সর্বাধিক আসক্ত ও লোভী এবং দুনিয়ার সব মানুষের তুলনায় তারাই দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে।
অতঃপর উৎপাদিত ফসল শুকিয়ে যায়, তখন তুমি দেখতে পাবে ফসলগুলো হলুদ বর্ণের। অথচ এসব ফসল একটু আগেও তরতাজা ও সবুজ বর্ণের ছিল। তারপর তুমি দেখতে পাবে এ ফসলগুলো সব শুকিয়ে খড়-কুটো ও ধুলায় পরিণত। এটিই হলো দুনিয়ার জীবনের উপমা ও দৃষ্টান্ত, প্রথমে দুনিয়ার জীবনকে আমরা দেখতে পাই সবুজ শ্যামল ও তরতাজা। তারপর ধীরে ধীরে তা দুর্বল হতে থাকে। অতঃপর একটি সময় আসে, তখন সে বুড়ো হয়ে যায়; তার নিজস্ব কোনো শক্তি, জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। একজন মানুষ তার জীবনের শুরুতে তরতাজা ডালের মত যুবক, কর্মক্ষম ও শক্তিশালী থাকে; তা শক্তি সামর্থ্য বাহাদূরী ও কর্মতৎপরতা মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয় এবং মানুষ তাকে দেখে অভিভূত ও মুগ্ধ হয়। তারপর সে ধীরে ধীরে বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হতে থাকে, অবস্থার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়; কর্মক্ষমতা, শক্তি ও সামর্থ্য লোপ পায় এবং বার্ধক্য তার ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণ ও আগ্রাসন চালায়। ফলে সে ধীরে ধীরে একেবারেই নিঃশক্তি, দুর্বল, কুনকুনে বুড়ো হয়ে যায়, এখন আর নড়চড় করতে পারে না এবং কোনো কিছুই জয় করতে পারে না, সবকিছু তাকেই জয় করে। যার হুংকারে থরথর করত মাটি, আজ সে মাটিতেই লোকটি গড়াগড়ি করে, নিজের শরীর থেকে কর্দমাক্ত মাটিগুলো পরিষ্কার করার কোনো শক্তি তার নেই। আহ! কী করুণ পরিণতি! কী নিদারুণ এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, ‘আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল বস্তু থেকে এবং দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দান করেন। আর শক্তির পর তিনি আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান”। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ৫৪]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দৃষ্টান্ত ও উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, দুনিয়ার জীবনের অবস্থা ও পরিণতি কী হবে এবং তাদের গন্তব্য কোথায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে আরও জানিয়ে দেন, দুনিয়ার জীবন কখনোই চিরস্থায়ী নয়, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, দুনিয়ার জীবন নিঃসন্দেহে শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনে মানুষ অনন্ত অসীম কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং আখিরাতের অফুরন্ত, অসংখ্য, অগণিত ও চিরস্থায়ী নি‘আমতসমূহের প্রতি অগ্রসর হতে তাগিদ ও নির্দেশ দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে বলেন, ‘আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।’ অর্থাৎ আসন্ন আখিরাতের জীবনে তোমাদের জন্য কেবলই আছে, এটি বা ওটি। অর্থাৎ হয় জাহান্নামের কঠিন আযাব অথবা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্টি, অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও দণ্ড-হীন ক্ষমা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী: দুনিয়ার জীবন শুধুই ধোঁকার সামগ্রী। এর অর্থ হলো, যারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে তাদের এ জীবন দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী সামগ্রী শুধুই ধোঁকা দেয়। কারণ, সে দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এ ধারণা করে যে, এ দুনিয়াই তার শেষ গন্তব্য, এ জীবন ছাড়া আর কোনো জীবন নেই এবং এ দুনিয়ার জীবনের পর কোনো উত্থান নেই। অথচ আখিরাতের চিরস্থায়ী হায়াতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন একেবারেই তুচ্ছ ও নগণ্য।(তাফসীরে ইবন কাসীর ৮/২৪।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন, ‘আর আপনি তাদের জন্য পেশ করুন দুনিয়ার জীবনের উপমা: তা পানির মতো, যা আমি আসমান থেকে বর্ষণ করেছি। অতঃপর তার সাথে মিশ্রিত হয় জমিনের উদ্ভিদ। ফলে তা পরিণত হয় এমন শুকনো গুঁড়ায়, বাতাস যাকে উড়িয়ে নেয়। আর আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান’। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ৪৫]
আল্লামা তাবারী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, সম্পদশালীরা তাদের অধিক সম্পদের কারণে যেন অহংকার না করে এবং ধন-সম্পদের কারণে অন্যদের ওপর অহংকার ও বড়াই করা হতে তারা যেন বিরত থাকে। দুনিয়াদাররা যেন দুনিয়ার দ্বারা ধোঁকায় নিমজ্জিত না হয়। দুনিয়ার দৃষ্টান্ত শস্য, শ্যামল, সুজলা, সুফলা ফসলের মতো, বৃষ্টির পানির কারণে যা সৌন্দর্য-মণ্ডিত ও দৃষ্টি-বান্ধব হয়ে উঠেছিল, মানুষ যার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ ও মোহিত হত। কিন্তু যখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে মাটি শুকিয়ে যায়, তখন ফসলের সেই সৌন্দর্য, গৌরব ও উজ্জ্বলতা আর বাকী থাকে না, ফসল হয়ে যায় হলুদ। তারপর আরও কিছুদিন অতিবাহিত হলে তা শুকিয়ে খড়-কুটে পরিণত হয়ে অবস্থা এতই করুণ হয়, বাতাস সেগুলোকে এদিক সেদিক উড়িয়ে নিয়ে যায়। বাতাসকে প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতা ফসলের আর অবশিষ্ট থাকে না এবং মানুষের দৃষ্টি এখন আর এসবের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। দুনিয়ার জীবনও ঠিক এসব ফসলের মতো। সুতরাং যে জীবনের এ পরিণতি তার জন্য ব্যস্ত না হয়ে আমাদের উচিৎ এমন এক জীবনের জন্য কাজ করা যার কোনো ক্ষয় নাই, যে জীবন চিরস্থায়ী যার কোনো পরিবর্তন ও বার্ধক্য নাই। (তাফসীরে তাবারী ১৮/৩০)।
আল্লামা ইবন কাসীর রহ. বলেন, ‘আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, হে মুহাম্মাদ তুমি মানবজাতির জন্য দুনিয়ার জীবনের উদাহরণ তুলে ধর! তাদের বলে দাও! দুনিয়ার জীবন হলো সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী তা একদিন শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে, দুনিয়ার কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। যেমন, আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন পানি জমিনে ছিটানো বীজের সাথে মিশে তা থেকে ফসল উৎপন্ন হয়ে তা যৌবনে উপনীত হয়। তারপর সবুজ শ্যামল হয়ে তা এক অপরূপ সৌন্দর্যে পরিণত হয়। একজন কৃষক এ অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকনে মুগ্ধ হয়। কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। তারপর নেমে আসে বিপর্যয় ও দুর্ভোগ। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর ফসল ধীরে ধীরে শুকিয়ে খড়-কুটে পরিণত হয়। বাতাস তখন এদিক সেদিক উড়িয়ে নিয়ে যায়, কখনো ডান দিকে নেয়, আবার কখনো বাম দিকে নেয়। বাতাসের গতিরোধ করার মতো নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ফসলের থাকে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি এ অবস্থার সৃষ্টিকর্তা আবার পরবর্তী অবস্থারও সৃষ্টিকর্তা”। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে এ ধরনের দৃষ্টান্ত একাধিক বার বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘নিশ্চয় দুনিয়ার জীবনের তুলনা তো পানির ন্যায় যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি, অতঃপর তার সাথে জমিনের উদ্ভিদের মিশ্রণ ঘটে, যা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু ভোগ করে। অবশেষে যখন জমিন শোভিত ও সজ্জিত হয় এবং তার অধিবাসীরা মনে করে জমিনে উৎপন্ন ফসল করায়ত্ত করতে তারা সক্ষম, তখন তাতে রাতে কিংবা দিনে আমার আদেশ চলে আসে। অতঃপর আমি সেগুলোকে বানিয়ে দেই কর্তিত ফসল, মনে হয় গতকালও এখানে কিছু ছিল না। এভাবে আমি চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করি’। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৪]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে এ ধরনের আরও একটি উপমা পেশ করেন। দুনিয়ার জীবন দেখতে একজন পরিদর্শকের দৃষ্টিতে খুবই সুন্দর, সে যখন নীরবে এ জীবনের সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকে, তখন এ জীবন তাকে অনাবিল আনন্দে ভরে দেয়। ফলে সে এ জীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং এ জীবনকে তার জীবনের স্থায়ী সমাধান ভাবতে থাকে। আর সে মনে করে, সে নিজেই এ জীবনের মালিক এবং এ জীবনকে ধরে রাখতে সে নিজেই সক্ষম। ঠিক এ মুহূর্তে আকস্মিকভাবে যে জীবনের প্রতি এত নির্ভরশীল ও আসক্ত ছিল, সে জীবনকে তার থেকে চিনিয়ে নেয়া হয়। তৈরি করা হয় তার ও জীবনের মাঝে সুবিশাল নিশ্ছিদ্র প্রাচীর। তখন তার হতভম্ব হয়ে চোখ উল্টিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার এ জীবনকে জমিনের সাথে তুলনা করেন। জমিনে যখন বৃষ্টি পড়ে তখন এ বৃষ্টির পানি বীজের সাথে মিশে খুব সুন্দর ও দৃষ্টি নন্দন ফসল উৎপন্ন হয়। ফসলের অপরূপ সৌন্দর্য একজন দর্শকের দৃষ্টিকে ভরে দেয় অনাবিল আনন্দে। তখন সে ধোঁকার বশবর্তী হয়ে ধারণা করে যে, সে নিজেই ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম এবং এ ফসলের সে নিজেই প্রকৃত মালিক ও নিয়ন্ত্রক। তখন হঠাৎ করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ এসে যায় এবং আক্রান্ত হয় জমিনের ফসল। আর ফসলের অবস্থা এতই করুণ হয় যে, যেন এখানে কখনোই কোনো ফসলী জমি ছিল না। তখন তার ধারণা ও বিশ্বাস একেবারেই পর্যবসিত হয়, তার হাত একদম খালি হয়ে যায়। অনুরূপভাবে দুনিয়ার জীবনের অবস্থা এবং যারা দুনিয়ার জীবনে আঁকড়ে ধরে তাদের পরিণতি। এ দৃষ্টান্ত হলো, দুনিয়ার জীবনের সর্ব উৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। (এলামুল মুউকীয়ীন ১/১৫৩)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, ‘আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত’। [সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত: ৬৪]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অবশ্যই দুনিয়ার জীবন খুবই মজাদার ও সুন্দর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের এ দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি দেখেন তোমরা জমিনে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা কর। তোমরা দুনিয়াকে ভয় কর এবং নারীদের ভয় কর। কারণ, বনী ইসরাঈলদের মধ্যে প্রথম ফিতনা ছিল নারীদের নিয়ে। অপর একটি বর্ণনায় আছে: যাতে তিনি অবলোকন করেন তোমরা কি কাজ কর’। আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়া হলো, ভোগের পন্য আর সর্বাধিক উত্তম ভোগের পন্য হলো, নেককার নারী’।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা আর কাফিরদের জন্য জান্নাত’।সহীহ মুসলিম।
একজন মুমিন ইচ্ছা করলে দুনিয়াতে যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। তাকে একটি নিয়মণ্ডকানূন এবং বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। পক্ষান্তরে একজন কাফিরকে কোনো বিধি-বিধান কিংবা নিয়ম কানুনের পাবন্দি করতে হয় না, সে যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এ কারণেই হাদীসে দুনিয়াকে মুমিনদের জন্য জেলখানা বলা আর কাফিরদের জন্য জান্নাত বলা হয়েছে। এ ছাড়া কাফিররা যখন মারা যাবে তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। আর জাহান্নামের শাস্তি যে কত ভয়াবহ তা আমাদের কারো অজানা নয়। জাহান্নামে নিদারুন বেদনাদায়ক শাস্তির তুলনায় দুনিয়া কাফিরদের জন্য জান্নাত স্বরূপ আর মুমিনদের জন্য জাহান্নাম। মুমিনরা তাদের মৃত্যুর পর তাদের গন্তব্য হবে জান্নাত। জান্নাতে তারা পরম সুখ ও অনাবিল আনন্দ ভোগ করতে থাকবে। চিরদিন তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দেওয়া নাজ-নি‘আমত ভোগ করতে থাকবে। তা হতে তারা বের হবে না। জান্নাতের এ পরম সুখের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটি তাদের জাহান্নাম তথা কারাগারের মত। তাই হাদীসে দুনিয়াকে মুমিনদের জন্য কারাগার বা জেলখানা বলা হয়েছে। মুস্তাওরাদ ইবন সাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়ার জীবন দৃষ্টান্ত আখিরাতের জীবনের তুলনায় এমন, যেমন তোমাদের কেউ অকুল সমুদ্রে একটি আঙ্গুল রাখল, তারপর তা তুলে ফেলল, তখন তার আঙ্গুলের সাথে যতটুকু পানি উঠে আসে দুনিয়ার জীবনও আখিরাতের তুলনায় তার মতো। সে যেন চিন্তা করে দেখে সমুদ্রের পানির তুলনায় তার আঙ্গুলের সাথে উঠে আসা পানির পরিমাণ কতটুকু’।
সমুদ্রের পানির তুলনায় আঙ্গুলের সাথে উঠে আসা পানি কোনো পরিমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তা এতই নগণ্য যে দুনিয়ার কোনো অংক তা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারবে না। আখিরাতের জীবন অনন্ত অসীম যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন একেবারেই হিসাবের বাহিরে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝানের জন্য একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন মাত্র।
মুমিনদের দুনিয়ার জীবন মুল লক্ষ্য হতে পারে না। তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো আখিরাত। তাই মুমিনরা দুনিয়াতে তাদের যাবতীয় কর্ম দ্বারা আখিরাত লাভের চেষ্টা চালিয়ে যায়। দুনিয়া মুমিনদের জন্য আখিরাতের পথ চলার সাময়িক বিশ্রামাগার। পথিক যেমন পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কোথাও ছায়া তালাশ করে সেখানে বিশ্রাম নেয় অনুরূপ একজন মুমিনের জন্য আখিরাতের কল্যাণ হাসিলের লক্ষ্যে কাজ করতে করতে বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। আর দুনিয়া হলো, তাদের বিশ্রামাগার।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে প্রেরণ করছে মানবজাতিকে দুনিয়ার অন্ধকার থেকে বের করে আলোর সন্ধান দিতে এবং সরল পথ দেখাতে। দুনিয়ার রাজত্ব বা বাদশাহী করতে তাকে দুনিয়াতে পাঠানো হয় নি। দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না। তাকে দুনিয়ার নারী, বাড়ী, গাড়ী ও রাজত্ব সবকিছুই দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি কোনো কিছুই গ্রহণ করেন নি। তিনি বলেছিলেন আমি এক বেলা খাব অপর বেলা উপবাস থাকবো এটাই আমার নিকট বেশি পছন্দনীয়। (চলবে)