প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বসন্তের আগমণে হৃদয়ে প্রেমের সুশীতল সমীরণ বইতে শুরু করেছে। বলছি ঈমানের বসন্তকাল পবিত্র মাহে রবিউল আউয়াল আগমণের কথা। রবিউল আউয়াল মানে প্রথম বসন্ত। দীর্ঘকাল খরতাপে পুড়ে এ ধরিত্রী যখন রুক্ষ-শুষ্ক-প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল, তখন আল্লাহ তায়ালার অপর রহমত হয়ে, কুল কায়েনাত আলোকিত করে সুদূর মক্কার বনু হাশেম গোত্রের কোরাইশ বংশে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সৌভাগ্যবতী মা হযরত আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহার কোলজুড়ে এক নূরের টুকরোর শুভাগমণ ঘটে। যাঁর কদমধূলির বরকতে রহমতে এলাহীর অঝোর বর্ষণে পৃথিবীজুড়ে বসন্তের হাওয়া বইতে থাকে। সে বছরকে আরবগণ ‘ছানাতুল বাহ্জাতি ওয়াস্ সূরুর’ বা খুশি ও আনন্দের বছর বলে অভিহিত করত। কারণ তাঁর আগমণে বিশ্বপ্রকৃতিতে নতুন করে বসন্তের কমনীয় রূপ ফুটে উঠে। মরু মক্কায় সবুজ গাছপালা, পত্র-পল্লবে ছেয়ে যায়। তিনি নূরের নবী, ধ্যানের ছবি, আমিনার দুলাল, মহান রবের শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত মোহাম্মদ মোস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর আগমণ কোন সাধারণ বিষয় ছিলো না। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সবদিক থেকে অতুলনীয়, অনন্য করে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বিশ্বচরাচর সাজিয়েছেন। তিনি আসবেন, জগত ধন্য হবে, আঁধার দূর হয়ে এই ধরা নূরে আলোকিত হবে এর প্রস্তুতি ও আগাম ঘোষণা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই চলেছিল। জাতীয় কবি আশেকে রাসূল কাজী নজরুল ইসলাম সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া কে এলো মক্কায় আমিনার কোলে’
মূলতঃ নূরে মোহাম্মদী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি। তখন এক আল্লাহ ছাড়া কেউ ছিলেন না, কোনকিছুই সৃষ্টি হয়নি। নিজের পরিচয় প্রকাশার্থে মহান খালিক একজনকে সৃষ্টি করলেন। আল্লাহ তায়ালা হাদিসে কুদসীতে ইরশাদ করেন, ‘আমি ছিলাম সুপ্ত ভান্ডার (কেউ আমার পরিচয় জানত না) অতঃপর আমি চাইলাম নিজের পরিচয় প্রকাশ করব, তাই এক সত্তাকে তৈরী করলাম নিজের পরিচয় প্রকাশ করার জন্য।’ [মিরক্বাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাত-১/৩৫৬, ছইদুল খাত্বের লি ইবনিল জওযী-১/১২৩]
বলাবাহুল্য যাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিল তিনিই ছিলেন প্রিয়নবী মোহাম্মদ মোস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যার প্রমাণ পাওয়া যায় অপর বর্ণনায়। নবীজী ইরশাদ করেন- আমি সৃষ্টিগত দিক থেকে মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম আর প্রেরণের দিক থেকে সর্বশেষ। [তাবাকাতে ইবনে সা’দণ্ড১/১৪৯] এখন প্রশ্ন হলো, প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল? নিচের বর্ণনাটি লক্ষ্য করুন- ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বর্ণনা করেন- হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করে তাকে তার সন্তানদের সম্পর্কে সংবাদ দেন, তখন তিনি কতেক সন্তানের উপর অপর কতেকের মর্যাদা দেখতে পান। তিনি তাদের সর্বশেষে নিচের দিকে আমাকে একটি উজ্জ্বল নূর হিসেবে দেখতে পেয়ে বললেন, হে প্রভূ! ইনি কে? আল্লাহ তায়ালা বললেন, ইনি হলেন তোমার পুত্র আহমদ। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ এবং তাঁর সুপারিশই কবুল করা হবে।’ [দালাইলুন নবুওয়্যাহ-হাদিস নং ২২২৫, কানযুল উম্মাল- হা: নং ৩২০৫৬, কিতাবুল আওয়ায়েল ইবনে আসেমণ্ড হাদি: নং-০৫] এই হাদিসের প্রত্যেক রাবী সিক্বাহ এবং সনদ হাসান বা উত্তম পর্যায়ের। এর দ্বারা প্রমাণ হয়, প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বপ্রথম নূর হিসেবে তৈরী করা হয়েছে। এছাড়াও কুরআনুল কারীমের সূরা মায়িদার ১৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের কাছে নূর এবং স্পষ্ট কিতাব এসেছে।’ আয়াতে কারীমায় ‘নূর’ দ্বারা অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য। এই নূরে মোহাম্মদী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর সকল সৃষ্টির মূল। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্তরে নূরে মোস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্থানান্তর হয়ে এই পৃথিবীতে কিভাবে আগমন করেন তার বর্ণনা এই ক্ষুদ্র কলেবরে দেয়া সম্ভব নয়। সংক্ষেপে নি¤েœ তুলে ধরা হল।
যুগে যুগে নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্থানান্তর : বেহেশতে নূরে মুহাম্মদী হযরত আদম আলাইহিস সালামের ঔরশে রাখা হয় এবং নূরের ঝলক পেশানী থেকে বিচ্ছুরতি হত। [মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ-১/৪৯] আদম (আঃ)-এর কপালে নূরে মুহাম্মদী রাখার পরে তিনি একদিন পেশানী থেকে হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কিসের আওয়াজ? আল্লাহ জবাব দিলেন- এটা হচ্ছে তোমার সন্তানদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তার তাসবীহ-এর আওয়াজ এবং বর্ণিত আছে আদম (আঃ)-এর কপালে নূরে মুহাম্মদী প্রখর সূর্যের মত ঝলমল করতো [শরফুল মুস্তফা-১/৩০১, ৩০২]
জান্নাতের নূরাণী পরিবেশে হাজার কোটি বছর অবস্থান করার পর নূরে মুহাম্মদী বাবা আদমের সাথে পৃথিবীতে নেমে আসেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) থেকে বর্ণিত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আদম (আঃ) সৃষ্টিরও দুই হাজার বছর পূর্ব থেকে নবীজীর রূহ মুবারক নূর হিসেবে আল্লাহর সামনে তাসবীহ পাঠ করতেন, তাঁর তাসবীহ শুনে ফেরেশতারাও তাসবীহ পাঠ করতো। আল্লাহ যখন আদম (আঃ)কে তৈরী করলেন, তখন আদমের পৃষ্ঠদেশে ঐ নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তর করেন। অতঃপর আদমের সাথেই ঐ নূর পৃথীবিতে নেমে আসেন, সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে নূহ (আঃ)-এর পৃষ্ঠে, তারপর নবী ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ)-এর পৃষ্ঠে নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তর করা হয়।’ [আশ শিফা-১/৮৩, খাছাইছুল কুবরা-১/৬৭, সীরাতে হালাবিয়্যাহ-১/৪৯]
হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র নসবনামায় আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আব্বাজান খাজা আবদুল্লাহ (রাদিঃ) এবং আম্মাজান আমেনা (রাদিঃ) পর্যন্ত প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানে-গুনে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে যুগের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। পবিত্র কুরআনের সূরা আশ শুআ’রা-এর ১৯নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আমি আপনাকে (যুগে যুগে) সিজদাকারীদের মধ্যে স্থানান্তর করেছি’। এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে মুফাসসীরকুল শ্রেষ্ঠ ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) বলেন- এর দ্বারা উদ্দেশ্যে হলো ‘আমি আপনাকে এক নবী থেকে অন্য নবীর ঔরসে স্থানান্তর করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত নবী হিসেবে বের করেছি’, ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে আমি আপনাকে নবীদের পৃষ্ঠদেশে স্থানান্তর করেছি এবং শেষ পর্যন্ত আপনাকে আপনার আম্মাজান জন্ম দিয়েছেন। [মু’জামুল কবীর লিত তবারাণী-হাদি: নং ১২০২১, মু’জামে ইবনুল আ’রাবী-হাদি: নং-১৭০৫, মাজামউয যাওয়ায়েদণ্ডহাদি: নং ১১২৪৭- এবং হাদিসটি সহিহ]
এভাবেই বাবা আদম থেকে প্রত্যেক নবীর যুগেই আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নূর মুবারক কোন না কোন নবীর কিংবা সময়ের সবচেয়ে মুত্তাকী ব্যক্তির পৃষ্ঠদেশে ছিল। হিজরী তৃতীয় শতকের জগত বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল মালেক খারকুশী সংকলিত ‘শরফুল মুস্তাফা’ কিতাবের প্রথম অধ্যায় পর্যালোচনা করে জানা যায় আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী ঈসা (আঃ) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই যখনই কোন বড় বিপদণ্ডআপদ আসতো আল্লাহ তায়ালা নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর বরকতে তাদেরকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। কাল পরিক্রমায় আল্লাহর হাবিব সরকারে দোআ’লম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর আগমনের সময় ঘনিয়ে এল। নবীজীর পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের ঔরসে নূরে মুহাম্মদী গচ্ছিত ছিল তাদের থেকেও নানা আলামত প্রকাশ হওয়া শুরু করলো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর পূর্ব পুরুষদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘আদনান’ নামে। তিনিই সর্বপ্রথম হারাম শরীফে বসতি স্থাপন করেন এবং সর্বপ্রথম তিনিই পবিত্র কা’বায় গেলাফ পরান। তার পরবর্তীজন হচ্ছেন ‘মাআ’দ’। তার সারা জীবন কেটেছে জিহাদের ময়দানে এবং তিনি প্রত্যেক যুদ্ধেই বিজয় লাভ করতেন। আল্লাহ তায়ালা ঐ যুগের নবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘মাআদণ্ডকে সম্মানের সাথে নিজ বোরাকে আরোহন করিয়ে সিরিয়ায় নিয়ে যেতে। কেননা আমি তার বংশ থেকেই এক সম্মানিত নবী পয়দা করতে যাচ্ছি, যার মাধ্যমে পয়গম্বরের ধারাবাহিকতায় সমাপ্তি ঘটবে।’ বলা বাহুল্য এসবই নূরে মুহাম্মদীর সম্মানে। তার পরবর্তী জন হলেন ‘নিযার’। এটি নযর শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ বিরল। তিনি নিজ যুগে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তার ললাটে নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চমকাচ্ছিল। সে যুগে জ্ঞানে গুণে বুদ্ধিমত্তায় তার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। পরবর্তী জন হলেন ‘মুযার’। অত্যন্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নূরে মুহাম্মদীর বরকতে তিনি দেখতে এত আকর্ষণীয় ছিলেন যে, যে কেউ দেখলেই তাকে মহব্বত ও সম্মান করত। তিনি সুকণ্ঠের অধিকারীও ছিলেন। তার পরে ‘ইলয়াস’। তিনিই প্রথম বাইতুল্লাহ হতে পশু প্রেরণের প্রচলন করেন। বর্ণিত আছে ইলয়াস বিন মুযার স্বীয় পৃষ্ঠদেশ হতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর হজ্জের তালবিয়া শ্রবণ করতেন। এভাবে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর বুযুর্গ দাদা পর্যন্ত প্রত্যেকেই ঈমানদার এবং যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন মক্কার সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রভাবশালী মানুষ। নূরে মুহাম্মদীর ঝলকে তার চেহারা এত উজ্জ্বল ছিল যে, অন্ধকার রাত্রেও তিনি কোথাও আগমন করলে আঁধার দূরীভূত হয়ে যেত। [শরহুয যুরক্বানী আলাল মাওয়াহিব-১/১৩৫, ১৩৬ ও ১৩৭, রওজুল উনফ-১/৮]
নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর সম্মানিত আব্বাজান হযরত আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রিয় পুত্র। বর্ণিত আছে যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেদিন সম্পর্কে সিরিয়ার খ্রিস্টান ও ইহুদী পন্ডিতরা জানতে পারে। তাদের কাছে নবী ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের রক্তমাখা একটি জুব্বাহ ছিল। তাদের আসমানী কিতাবে লিখিত ছিল যখন দেখবে এই জুব্বার রক্ত তাজা হয়ে উঠেছে এবং টপটপ করে রক্ত ঝরছে তখন বুঝে নিও আখেরী যামানার পয়গম্বরের পিতা দুনিয়ায় আগমন করেছেন। ঠিকই যেদিন আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন সেদিন ঐ জুব্বা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরতে থাকে। তারা দলবলে মক্কায় এসে হুজুরের আব্বাজানকে খোঁজ করে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আল্লাহ কুদরতীভাবে তাকে রক্ষা করেন। তারা ব্যর্থ হয়ে সিরিয়ায় ফিরে যায়। সিরিয়ায় পৌঁছানোর পর ওখানকার লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে তারা বলতে থাকল আমার মক্কার কুরাইশদের মাঝে ঝলমল করা একটা নূর রেখে এসেছি। হুজুরে পুর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর আব্বা একদিন পিতা আবদুল মুত্তালিবকে বলেন ‘আমি মক্কার উপকণ্ঠে জাবালে ছুবাইরে উঠলে দেখলাম আমার পৃষ্ঠ হতে দুটি নূর বের হল। একটি পূর্ব দিগন্তে অন্যটি পশ্চিম দিগন্তে মিলিত হল। তারপর দেখলাম নূর দুটি বৃত্তাকার ঘুরছে এমনকি মেঘের আকৃতি ধারন করল। এরপর আকাশ বিদীর্ণ হয়ে গেলে মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম নূর দুটি আকাশাভ্যান্তরে প্রবেশ করে আবার আমার কাছে ফিরে আসল। আমি যেখানেই বসি আমি শুনতে পাই কেউ আমাকে সালাম দিচ্ছে হে নূরে মুহাম্মদীর রক্ষক আপনায় সালাম। যে কোন শুকনো জায়গায় বসলে সেটা মুহূর্তেই সবুজ-শ্যামলে রূপান্তর হয়ে যায়। আবদুল মুত্তালিব বললেন সুসংবাদ গ্রহণ কর হে আমার পুত্র! তোমার নছল থেকেই আল্লাহ জগতের সবচেয়ে সম্মানিত সত্তাকে বের করবেন। [তারিখুল খামীছ-১/১৮২] পরিণত বয়সে আবদুল্লাহকে বিবাহ দেয়ার জন্য পিতা আবদুল মুত্তালিব রওয়ানা হলে পথিমধ্যে ফাতেমা বিনতে মুররাহ নামে এক ইহুদি মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। সে তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ ছিল। খাজা আবদুল্লাহর চেহারায় নূরে মুহাম্মদীর অপরূপ ঝলক দেখে সে নিজেকে তার কাছে পেশ করলো এবং প্রস্তাব দিল আমি তোমাকে একশত উট উপহার দেব তুমি আমাকে বিয়ে কর। কিন্তু আবদুল্লাহ চারিত্রিক মাধুর্যতা ও পিতার সম্মানের কথা খেয়াল করে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। অবশেষে বনী যোহরা গোত্রের ওহাব বিন আবদে মানাফের অতুলনীয় কন্যা জগতের সবচেয়ে ভাগ্যবান রমণী আম্মাজান আমেনা (রাদিঃ)-এর সাথে তার বিবাহ হয়ে যায়। [দালাইলুন নবুওয়্যাহ-আবূ নুআইম ইস্ফাহানী-১/৩৮] বিবি আমেনার সাথে পরিণয়ের পরদিন হযরত আবদুল্লাহ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তণকালে ফের ঐ মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। এবার মহিলা আবদুল্লাহকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জবাব দিল- ‘গতকাল তোমার মাঝে যে নূর ছিল- আজ সে নূর তোমার থেকে বিদায় নিয়েছে। সুতরাং তোমাতে আমার কোন প্রয়োজন নাই।’ [শরহুয যুরকানী- ১/১৯৩] এখানেও একজন ইহুদি মহিলা আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে
নূর হিসেবে অভিহিত করলেন। মা আমেনা আল্লাহর হাবিবকে গর্ভে ধারণ করার দুই মাস পরেই হযরত আবদুল্লাহ (রাদিঃ) ইন্তেকাল করেন। যে রাতে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর নূর মুবারক আম্মাজানের রেহেমে স্থানান্তর হয়, সে রাতে আল্লাহ জান্নাতের রক্ষক ‘খাজেন’কে হুকুম দিয়েছিলেন জান্নাতের সকল দরজা খুলে দিতে। আকাশের ফেরশতারা আনন্দে মেতে উঠেছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করলেন- ‘সাবধান! তোমরা জেনে রাখ, আজকের রাত্রেই ঐ গচ্ছিত নূর যা থেকে হেদায়েত দানকারী শেষ নবী আবির্ভূত হবেন তা তাঁর আম্মাজানের রেহেমে স্থানান্তর হচ্ছে।’ [তারিখুল খামিছ-১/১৮৫] নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পেয়ারা নবী নিখিল বিশ্বের পরম প্রেমাসম্পদ হাবিবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর শুভাগমনের সময় এসে গেল। অবশেষে ৫৭০ খ্রিঃ সহিহ ও প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে ১২ই রবিউল আউয়াল নূর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধরায় আগমণ করেন। [সিরাতে নববী-ইবনে কাছির-১/১৯৯] পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমণের ধারাও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যান্য মানবশিশুর মত তাঁর মীলাদ বা জন্ম হয়নি। বরং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভূমিষ্ঠ হয়েছেন মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহার বাম উরুদেশ দিয়ে, যা বাম পাঁজরের হাড়ের নি¤েœ অবস্থিত। তারপর উক্ত স্থান সাথে সাথেই জোড়া লেগে যায়। এই বিশেষ ব্যবস্থায় ভূমিষ্ঠ হওয়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর একক বৈশিষ্ট্য। (উমদাতুন নুকুল ফি কাইফিয়্যাতে বিলাদাতির রাসূল)
তাঁর আগমণে ধন্য হল সৃষ্টিকুল। তিনি সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ গৌরব। মানজাতির শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান এজন্যই, তাঁদের মধ্যে তাশরীফ এনেছেন কায়েনাতের শ্রেষ্ঠজন মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর কদমে জানাই লাখো-কোটি সালাম।
লেখক : হাফেজ মাওলানা আবুল হাসান মোহাম্মদ বায়জীদ, লেকচারার, ধানুয়া ছালেহিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।