প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
নামাজ বান্দা ও আল্লাহর সাথে যোগাযোগের সেতু বন্ধন। ইসলামে নামাযের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে পাকে অসংখ্য হাদিস শরীফ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের ফযিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন। ইসলামে প্রত্যেকটা নামাযের আলাদা ফযিলত রয়েছে। ফজর ও জুমু'আর নামাজ আপন মহিমায় গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলত মন্ডিত।
নামাজ/সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : 'কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম যে আমলের হিসাব-নিকাশ হবে তা হলো সালাত। কারো সালাত যদি সঠিক হয়, তাহলে সে সফলতা লাভ করবে ও নাজাত পাবে। আর এই সালাত যদি সঠিক না হয় তাহলে সে নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (তিরমিযী শরীফ) মানুষের আমলের ক্ষেত্রে নামাজ/ সালাতের গুরুত্ব কতখানি তা এই একটি মাত্র হাদীস থেকে উপলব্ধি করা যায়। বলা যায়, ঈমানের পর সালাতই হল সকল আ'মালের মূল। আসুন প্রত্যেক নামাযের ফযিলত সম্পর্কে জেনে নেয়।
ফজরের নামাযের ফযীলতঃ এই প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে অসংখ্য হাদিস শরিফ উল্লেখ রয়েছে। যেমন -
১. হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা থেকে বর্ণিত। হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, 'ফজরের দু'রাকাত (নামায] পৃথিবী এবং পৃথিবীস্থ সমুদয় কিছু থেকে উত্তম। [মুসলিম, তিরমিযী]
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযুর
আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, "ফজরের দু'রাকাতকে অপরিহার্য করে নাও, কারণ তাতে বড় ফযীলত রয়েছে। [তাবরানী]
৩. হুযুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, 'ফজরের সুন্নাতসমূহ ত্যাগ করো না, যদিও তোমাদের উপর শত্রুর ঘোড়া এসে যায়। [আবু দাউদ]
মাসআলা : সকল সুন্নাতের মধ্যে শক্তিশালী হচ্ছে ফজরের সুন্নাত। এমনকি কতেক ইমামগণ উহাকে ওয়াজিব বলেছেন। জেনে-বুঝে এটার অস্বীকারকারীকে কাফির বলা হবে। তাই এ সুন্নাত বিনা ওজরে বসে আদায় করা যায় না। এমনকি আরোহনে এবং চলন্ত গাড়ীতেও আদায় করা যায় না। এসব ব্যাপারে ফজরের সুন্নাত ওয়াজিবের সমতুল্য। [রাদ্দুল মুহতার, ফাৎওয়া-এ রযযভীয়্যাহ, খণ্ড-৩, পৃ. ৪৪]
যোহরের নামাযের ফযীলতঃ এই প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে অসংখ্য হাদিস শরিফ উল্লেখ রয়েছে। যেমন -
১. আমীরুল মু'মিনীন হযরত উমর ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যোহরের প্রথম চার রাকাত পড়লো সে যেন তাহাজ্জুদের চার রাকাত পড়লো।' [তাবরানী।
২. সঠিক অভিমত হচ্ছে যে, ফজরের সুন্নাতের পর যোহরের প্রথম চার রাকাত সুন্নাত এর মর্যাদা রয়েছে। হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে এরশাদ হয়েছে যে, হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, যে ব্যক্তি তা ত্যাগ করবে, তার ভাগ্যে আমার শাফা'আত জুটবে না। (দুররে মুখতার)
আসরের নামাযের ফযীলতঃ এই প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে অসংখ্য হাদিস শরিফ উল্লেখ রয়েছে। যেমন -
১. হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা'আলা ওই ব্যক্তির উপর দয়া করেন যে ব্যক্তি আসরের [ফরযের পূর্বে চার রাকা'আত (সুন্নাত) পড়বে। [আবূ দাউদ, তিরমিযী]
২. তিবরানী, উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আসরের [ফরযের পূর্বে চার রাকা'আত পড়বে, আল্লাহ তা'আলা ওই ব্যক্তির শরীরকে [দোযখের আগুনের জন্য হারাম করে দেবেন।
মাগরিবের নামাযের ফযীলতঃ এই প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে অসংখ্য হাদিস শরিফ উল্লেখ রয়েছে। যেমন -
১. রযীন, মকহুল থেকে বর্ণনা করেন যে, হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের [ফরযের] পর কথা বলার পূর্বে দু'রাকা'আত নামায পড়বে, তাঁর নামায 'ইল্লিয়্যিন'-এ উঠানো হয়।
২. হযরত হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মাগরিবের ফরযের পর দু'রাকা'আত নামায তাড়াতাড়ি পড়ে নাও, কেননা তা ফরযের সাথে উপস্থাপিত করা হয় ।
ইশার নামাযের ফযীলতঃ এই প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে অসংখ্য হাদিস শরিফ উল্লেখ রয়েছে। যেমন -
১. ইবনে মাজাহ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মসজিদে জামা'আতের সাথে চল্লিশ রাত ইশার নামায এমনভাবে পড়বে, যাতে প্রথম রাকা'আত ছুটে না যায়, ওই ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তা'আলা দোযখ থেকে মুক্তির কথা লিখে দিবেন। (ইবনে মাজাহ্)
২. সব নামাযের মধ্যে মুনাফিকদের জন্য কষ্টসাধ্য নামায হচ্ছে ইশার ও ফজরের নামায। [ তিবরানী শরীফ ]
৩. যে ব্যক্তি ইশার নামাযে উপস্থিত হলো সে যেন অর্ধেক রাত জাগরণ (ইবাদতের রত) থাকলো। (বায়হাকী শরীফ) বিতর সত্য। যে ব্যক্তি বিতর পড়ে না, সে আমাদের (মুসলমানদের) অন্তর্ভুক্ত নয়।
আবূ দাউদ শরীফ ] যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে) দেই, জাহান্নামের দরজায় তার নাম লিখে দেয়া হয়। [ আবূ নাঈম ] ইশার নামাযের রাক'আত সংখ্যা
উল্লেখ্য, এশার নামায - সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ- ৪ রাকা'আত + ফরয- ৪ রাকা'আত + সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ- ২ রাকা'আত + নফল- ২ রাকা'আত +বিতির -৩ রাকাত + শফিউল বিতির-২ মোট ১৭ রাকা'আত ।
মাসআলাঃ ইশার নামাযের ওয়াক্ত মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর পরই শুরু হয়ে যায়। এবং সুবহি সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত থাকে। [ ফাতওয়া- এ রযভীয়্যাহ,খন্ড-২, পৃঃ ২২৬ ]
জুমু'আর দিনের ফজিলতঃ এই প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদিসে পাকে অসংখ্য বর্ণনা বিদ্যমান। যেমন-
জুমু'আর নামাযের ফযিলত প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল করেছেন- নাম সুরা জুমু'আ। হাদিসে পাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, উদিত সূর্যের প্রভাদীপ্ত দিনগুলোর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হচ্ছে জুমা'র দিন। এদিনে সৃষ্টি করা হয়েছিল হযরত আদম আলাইহিস সালাম কে এবং এদিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। আর এদিনেই তাঁকে বের করা হয়েছিল সেখান থেকে । আর জুমার দিন ছাড়া কিয়ামত কায়েম হবেনা। (সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম শরীফ, মিশকাত-১১৯ পৃঃ)
২. হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম ইরশাদ করেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে আর এক জুমা এবং এক রমযান থেকে আর এক রমযান। এই সমস্ত যে সব (সগীরা) গুনাহ হয় তার জন্য কাফ্ফারা হয়ে যায় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে । (সহীহ্ মুসলিম শরীফ)
৩. হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি জুমুয়ার দিন নাপাকী থেকে পাক হওয়ার জন্য যেমন গোসল করে, তেমনি ভালভাবে গোসল করে তারপর (প্রথম সময়ে জুমুয়া'র সালাতের জন্য) মাসজিদে যায় সে যেন একটি উট আল্লাহর পথে কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় সময়ে মাসজিদে যায় সে যেন একটি গরু কুরবানী করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় সময়ে যায় সে যেন একটি শিং ওয়ালা মেঘ কুরবানী করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ সময়ে যায় সে যেন একটি মুরগী আল্লাহর পথে দান করল। আর যে ব্যক্তি পঞ্চম সময়ে যায়, সে যেন আল্লাহর পথে একটি ডিম দান করল। যখন ইমাম বের হন (তাঁর হুজরা থেকে) তখন ফিরিশতারা খুতবা শুনার জন্য হাযির হয়ে যান (এবং খাতায় নাম উঠান বন্ধ হয়ে যায়। (সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
৪. হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুয়া'র কথা প্রসঙ্গে এরশাদ করলেন: এর মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি মুসলিম বান্দা সেটি পেয়ে যায় এবং সে সালাত পড়তে থাকে, আল্লাহর কাছে সে কিছু চায়, তাহলে আল্লাহ তায়া'লা অবশ্য তাকে তা দেন। তিনি হাতের ইশারায় তার স্বল্পতা ব্যক্ত করলেন। (সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
প্রতীয়মান যে, প্রত্যেক নামাযের ফযিলত অপরিসীম। আর তাই প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া ও গুরুত্ব দেয়া মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব ।
লেখক : মুদাররিস-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম; খতিব, মসজিদণ্ডএ রহমানিয়া গাউসিয়া, অক্সিজেন, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।