প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
আমরা মুসলমান। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের অনুষ্ঠান ইসলামের আলোকেই হবে। ইসলামের বাইরে কোনো কাজ করা যাবে না। মুসলমানদের সংস্কৃতি বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই কোনো কাজ করার পূর্বে ইসলামী আদর্শ কী, ইসলামী সংস্কৃতি কী, এ বিষয়ে আমাদের জানা থাকতে হবে। আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের দিকে আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো যে, খ্রিস্টীয় নববর্ষ পালনের জন্যে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অন্যান্য দেশের দেখাদেখি আমরা খ্রিষ্টীয় নববর্ষ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘থার্টি ফাস্ট নাইট’ করে থাকি। সেখানে যুবক-যুবতীরা একত্র হয়ে নাচণ্ডগানসহ নানাবিধ অশ্লীলতাণ্ডবেহায়াপনা ও গর্হিত কাজ করে থাকে। যার কোনটিই ইসলাম সমর্থন করে না।
আমরা যদি বাংলা নববর্ষের দিকে যাই তাহলে দেখতে পাবো বাংলা নববর্ষের মূল প্রবর্তক সম্রাট আকবর। তিনি খাজনা গ্রহণের সুবিধার্থে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর একটি নতুন দ্বীন প্রবর্তন করেন ‘দ্বীন-এ এলাহী’ নামে, যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। তার সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজী হিজরি সনকে গবেষণা করে বাংলা সন আবিষ্কার করেন। আর আমরা আজ এ বাংলা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতি বলে পহেলা বৈশাখ পালন করে থাকি। পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পালনে কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু আনন্দণ্ডফূর্তির নামে যেসব অনৈসলামিক কার্যকলাপ হয়ে থাকে তাতেই আপত্তি। বিশেষভাবে বাঘ-হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণিদের ছবি অথবা কোনো মানুষ প্রাণি সেজে সেটা নিয়ে র্যালি খুবই দুঃখজনক। যা ইসলামে একেবারেই হারাম করা হয়েছে। বাংলা নববর্ষ এবং খ্রিস্টীয় নববর্ষ আমাদের দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি হতে পারে। তবে ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বহন করে হিজরি নববর্ষ। কারণ হিজরি বর্ষের মাধ্যমেই রমজানের রোজা রাখা হয়। ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, লাইলাতুল ক্বদর, লাইলাতুল বারাআত, শবে মেরাজ, আশুরা, হজ্ব, কোরবানিসহ অসংখ্য ইবাদত হিজরি সন অনুযায়ী হয়ে থাকে। তাই বলা যায় হিজরি নববর্ষই ইসলামী সংস্কৃতি।
হিজরি সন মুসলমানদের সন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে আল্লাহর বন্ধু নবীজি মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরি সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। ১৭ হিজরি (৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ) হতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শাসক হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসন আমল থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরী (রাঃ) এক চিঠিতে লেখেন, হে বিশ্ববাসীর নেতা! আল্লাহর পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোনো সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হযরত ওমর (রাঃ) মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরি সন শুরু করার কারণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলমানদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের কথা গুরুত্বের সাথে কোরআনে উল্লেখ করেছেন। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলেই এ সনকে হিজরি সন বলা হয়। আমাদের ঈমানী দায়িত্ব হিজরি সন অনুসরণ করা। হিজরি সন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সে হৃদয় বিদারক ঘটনার কথা। সে দিনে মক্কার কাফের বেঈমানরা রাসূল (সাঃ)কে মক্কাতে তাঁর গর্দান উড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশে রাসূল (সাঃ) হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। রাত্রিতে রাসূল (সাঃ)-এর ঘর মোবারকের চতুর্দিকে কাফিররা বেষ্টন করে রাখে। সকালে নামাজ পড়তে উঠলেই দুনিয়া থেকে চির বিদায় করে দেয়া হবে। রাসূল (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)কে তাঁর বিছানায় শুইয়ে দিলেন এবং মক্কার মানুষের আমানতের সম্পদ জিনিসপত্র আলী (রাঃ)কে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন আগামীকাল সকালে মানুষের আমানত বুঝিয়ে দিয়ে মদিনাতে চলে আসবে। রাসূল (রাঃ) হাতে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন, কাফিররা চোখে কিছুই দেখতে পেলো না। অথচ তাদের শরীরে মাথায় চোখে বালি প্রবেশ করছে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে হাত দ্বারা সরিয়ে হুজরা মোবারক থেকে বের হয়ে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ)-এর বাড়িতে গিয়ে দরজায় আওয়াজ করতেই হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) দরজা খুলে দিলেন। উভয়ে হিজরতের জন্যে বের হয়ে পড়লেন। রাত্রিতে গারে ছাওরে গিয়ে অবস্থান করলেন। ভোর হলে কাফিররা দেখল রাসূল (সাঃ) ঘরে নেই, আলী (রাঃ) ঘর থেকে বের হলেন। তারা খুঁজতে খুঁজতে গারে ছাওরের একেবারেই নিকটে চলে আসলেন। তারা সে গুহার দিকে নজর দিয়ে দেখলো গুহার মুখে মাকড়শার জাল এবং সেখান থেকে কবুতর উড়ে যাচ্ছে। সেখানে কবুতরের ডিম। তারা ভাবলো, এখানে কেউ থাকলে মাকড়শার জাল থাকত না এবং কবুতরের বাসা থাকত না, ডিমও পাড়ত না। তারা চলে আসলো।
রাসূল (সাঃ) প্রথমে কুবা পৌঁছলেন। সেখানে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। সেখান থেকে মদিনাতে (ইয়াসরিবে) চলে যান। মদিনার শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সকলেই রাসূল (সাঃ) কে স্বাগত জানিয়ে আনন্দিত হন। হিজরি সন আমাদেরকে সে হৃদয় বিদারক ঘটনার কথাই বলে দেয়। চাঁদের হিসাবেই হযরত আদম (আঃ)-এর সময় থেকেই গণনা করা হতো। তবে সন হিসেবে গণনা হতো না। হযরত ওমর (রাঃ)-এর সময় হতে হিজরি সন গণনার প্রবর্তন হয়। আজ আমরা খ্রিষ্টীয় এবং বাংলা নববর্ষ পালনের জন্যে কত আয়োজন করে থাকি অথচ হিজরি নববর্ষের কোনো গুরুত্ব দেই না। সত্যিই হইা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আজ আমরা ইতিহাস ভুলে গেছি। বাংলা এবং ভারত উপমহাদেশে আরব বণিকদের মাধ্যমে হিজর সন প্রবেশ করে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ হতে সর্বক্ষেত্রে হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। যা প্রায় ৫৫০ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল। পরে ১৭৯০ সাল হতে এ উপমহাদেশে খ্রিস্টীয় সনের প্রচলন হয়। অথচ আমরা হিজরি সন কবে আসে কবে যায় তাও বুঝি না। হিজরতের দ্বারা আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) সাহাবীদের এবং মুসলমানদের ধর্ম ও রাসূল প্রেম ফুটে উঠে। তাই বলতে হয় হিজরি সন পালনের মাঝে রাসূল (সাঃ) প্রেম রয়েছে। তাই ইহা ঈমানের দাবি। হিজরী সন উদযাপনে কতিপয় প্রস্তাবনা।
হিজরি সন উদযাপনে মিলাদ, দোয়া, আলোচনা, ব্যানার, লিফলেট, লিখনীসহ বিভিন্ন আয়োজন করা যায়। হিজরী সন উদযাপনে হিজরী সন উদযাপন কমিটি গঠন করে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সেমিনার করা যায়। এ ছাড়া সরকারি, বে-সরকারি সকল দপ্তর ও বিভিন্ন সংগঠন হিজরী সন উদযাপনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিটি মসজিদে বাদ ফজর যেকোন সময়ে দোয়া, মিলাদ, আলোচনার মাধ্যমে হিজরী সন উদযাপন করা যায়। সর্বশেষ কথা প্রস্তাব হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন পালনের দাবি রইলো।
লেখক : মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক, খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমান জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।