প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৩, ০০:০০
সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্যে যিনি রাসূল (সাঃ) কে সব মাখলুকের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যাঁর পদধূলিতে স্থানের সম্মান বেড়ে যায়, যার স্পর্শে ভেজাল খাঁটি হয়ে যায়, যার সুহবতে নিকৃষ্ট মানুষ শ্রেষ্ঠ মানুষে রূপান্তরিত হয়। আল্লাহর লাখো কোটি শোকরিয়া আমাদের মতো নগণ্যদেরও তিনি তাঁর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন। সালাত ও সালাম সেই নবীর ওপর যার ওপর সালাত না পড়া পর্যন্ত প্রার্থনাগুলো অবরুদ্ধ থাকে। যার প্রতি সরাসরি সালাম পেশ করার জন্যে মুসলমানরা মদিনার দিকে ছুটে পতঙ্গের মতো। মদিনা নামটি কোনো ইমানদার ব্যক্তির কাছে উচ্চারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে শিহরণের সৃষ্টি হয়। কারণ মদিনা শরিফ শব্দটি উচ্চারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর অসহায় অবস্থায় মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগের স্মৃতি, মদিনায় বসে সারা বিশ্বে কলমার দাওয়াত পৌঁছানোর স্মৃতি, সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে বিভিন্ন আবদার নিয়ে আসার কোলাহলের স্মৃতি, দুনিয়া থেকে তাঁর বিদায় নেওয়ার সময় সাহাবায়ে কিরামের ভগ্নহৃদয় নিয়ে শিশুদের মতো গগনবিদারী কান্নাকাটির স্মৃতি, সেই অবস্থাকে অতিক্রম করে পুনরায় নতুন উদ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া মিশনকে সারা বিশ্বে পৌঁছানোর জন্য কোরবানির স্মৃতি সব ভেসে ওঠে। বিশেষ করে এ হজের মাসগুলোয়।
যখন সারা বিশ্বের আনাচকানাচ থেকে মুসলমানরা পঙ্গপালের মতো তাঁকে সালাম দেওয়ার জন্য মদিনার দিকে ছোটে তখন আমরা যারা এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত তারা নিজেদের খুব অসহায় মনে করি। মনে হয় যেন সবাই ঘরের দিকে ছোটে আর আমাদের মতো বঞ্চিতদের প্রবাসজীবন শেষ হলো না। এ রকম হওয়ারই কথা কারণ যখন মাসজিদুন নববী প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, রওজাতুল জান্নাহ মানুষের অজানা ছিল সেই সময় যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জীবনের শেষ দিকে আল্লাহর সঙ্গে দিদারের জন্য মিরাজে যাচ্ছিলেন তখন তিনি মদিনার এই বিরানভূমি জিয়ারত করলেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। বর্তমানে মদিনায় মাসজিদুন নববী প্রতিষ্ঠিত, রওজাতুল জান্নাহ নির্ধারিত, বিশেষ করে রাসূল (সাঃ) তাঁর দুই খলিফা নিয়ে চিরবিশ্রামে থাকার রওজা বিদ্যমান, এ অবস্থায় তাঁর জিয়ারতের গুরুত্ব ও এর মর্যাদা কতটুকু তা সহজে বলা যাবে না। বরং রাসূল (সাঃ)-এর একটি উক্তি থেকে এর মর্যাদা অনুমান করা যাবে। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! মক্কায় তুমি যেই বরকত দান করেছ মদিনায় তার দ্বিগুণ বরকত দাও! মক্কায় বায়তুল্লাহ আছে, মাকামে ইবরাহিম আছে, আরও কত ফজিলতপূর্ণ কিছু আছে এমনকি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছাড়া হজ হবে না তাও বায়তুল্লাহর ফজিলত। এত কিছু থাকার পরও যদি কেউ বলে আল্লাহ! আমি দুনিয়ায় একটু জান্নাতের অংশে বসে থাকতে চাই, অবস্থাদৃষ্টে মনে করা যায় আল্লাহ এটা উত্তর দেবেন যে, সেই ব্যবস্থা মক্কায় নেই, মদিনায় যাও, সে ব্যবস্থা মদিনায় আছে। কারণ রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘আমার মিম্বার ও কবরের মাঝখানে জান্নাতের একটি বাগান রয়েছে।’ এখন যদি কেউ দুনিয়ায় জান্নাতের বাগানে বসতে চাই তাহলে তাকে মাসজিদুন নববীতে প্রবেশ করে সবুজ কার্পেট বিছানো সেই রওজাতুল জান্নাতেই বসতে হবে। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মাসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য যে কোনো মসজিদের এক হাজার নামাজের সমান হলো আমার মসজিদে নামাজ। মাসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য যে কোনো মসজিদের এক হাজার জুমার নামাজের সমান হলো আমার মসজিদের এক জুমার নামাজ, মাসজিদুল হারামের রমজান ছাড়া অন্য যে কোনো মসজিদের এক হাজার রমজানের সমান হলো আমার মসজিদের এক রমজান।’ এটা তো হলো মাসজিদুন নববীর ফজিলত। মাসজিদুন নববী ও রওজায়ে আকদাসের সুবাদে পুরো মদিনা অঞ্চলটাই বরকতময় হয়ে গেছে। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘(স্থায়ী বাসিন্দা হোক অস্থায়ী বাসিন্দা হোক) যে কেউ মদিনার কোনো দুঃখণ্ডকষ্টের ওপর ধৈর্য ধারণ করলে আমি তার জন্য কাল কিয়ামতের ময়দানে সুপারিশ করব।’ মদিনা অঞ্চলের কষ্ট সহ্য করলেও আল্লাহর রসুলের সুপারিশ পাওয়া যায় তা হলে মাসজিদুন নববী, রওজাতুল জান্নাহ, রওজায়ে আকদাসের কত মর্যাদা ও কত ফজিলত?
রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘যারা দূরে থেকে আমাকে সালাম দেয় সেই সালাম ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। যারা কাছের থেকে আমাকে সালাম দেয় তাদের সালাম আমি শুনে থাকি।’ অন্য এক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যখন আমার ওপর দরুদ পাঠ কর তখন আল্লাহ আমার রুহ আমাকে ফেরত দেন এবং আমি তার সালামের জবাব দিই।’ সুনানে আবু দাউদ। অতএব রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজায়ে আকদাসে দাঁড়িয়ে সালাম দেওয়া মানে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাঁর সঙ্গে যে রকম সালাম বিনিময় করতেন আপনিও তাঁর সঙ্গে সে রকমই সালাম বিনিময় করছেন। তবে আপনার কানে পর্দা থাকার কারণে তাঁর উত্তরটা আপনি শুনছেন না। অতএব, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজায়ে আকদাসের জিয়ারতের সময় সর্বোচ্চ আদব রক্ষা করা উচিত। রসুলপ্রেম ছাড়া এ আদব অর্জন করা অসম্ভব। প্রেমহীন, নির্জীব অন্তর নিয়ে তাঁকে সালাম দিলে আপনি সালাম ও সালামের কোনো স্বাদ পাবেন না। গতানুগতিকতার অনুসরণ হবে মাত্র।
রাসূল (সাঃ) পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারতের ফজিলত
১. সাধারণত মহামান্য নবীগণের (সাঃ) সমাধিকে ‘রওজা শরীফ’, সম্মানিত ওলী আল্লাহগণের (রাঃ) সমাধিকে ‘মাজার শরীফ’ এবং সাধারণ মুসলমানের সমাধিকে আরবিতে ‘কবর’ বলা হয়। ফার্সি ‘রওজা’ শব্দটি আরবি ‘রাওদ্বাহ’ থেকে এসেছে যার অর্থ বাগান, তৃণভূমি, উদ্যান ইত্যাদি। আর আরবি ‘মাজার’ শব্দটির অর্থ জিয়ারত বা পরিদর্শনের জায়গা। মাজার একটি আরবি শব্দ, যা এখন শুধু বাংলাতেই ব্যবহৃত হয়। শব্দটি ফার্সি দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ। এর ধাতুগত অর্থ ‘যিয়ারতের স্থান’। মাজার বলতে সাধারণত আওলিয়া-দরবেশগণের সমাধিস্থলকে বুঝায়। এখন মনে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দাফনস্থল বা কবরকে রওজা বলা হয় কেনো? মূলত রওজা শব্দের অর্থ বাগান। এখানে রওজা বা বাগান দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ‘জান্নাতের একটি বাগান।’ যেহেতু তাঁর কবরটি জান্নাতের নেয়ামতে ভরপুর একটি পবিত্র বাগান। তাই এ অর্থে তাঁর কবরকে ‘রওজায়ে আতহার’ (পবিত্র বাগান), রওজা শরিফ ইত্যাদি বলা হয়। দলিল [সহীহ বুখারী ১/১৮৬, সহীহ মুসলিম ১/২০১, জামে তিরমিযী ১/৭৩; সুনানে নাসাঈ ১/২২২; সুনানে আবু দাউদ ২/৪৬১; সহীহ ইবনে হিব্বান ৭/৪৫২-৪৫৪; রূহুল মাআনী ৮/২৩৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৩৯; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৮; হাশিয়া তাহতাবী আলাল মারাকী পৃ. ৩৪১; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/৩৭২; রদ্দুল মুহতার ২/২৪২]।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমার ঘর মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটি জান্নাতের একটি টুকরা (রিয়াজুল জান্নাহ) এবং আমার মিম্বরটি আমার হাউজের উপর স্থাপিত’। [সহীহ বুখারী-১১৩৮] রওজার পশ্চিম দিকে রাসুল (সাঃ)-এর মিম্বার পর্যন্ত স্থানটুকুকে ‘রিয়াজুল জান্নাত’ বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়ায় একমাত্র জান্নাতের অংশ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘আমার মিম্বার ও ঘরের মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের বাগিচাসমূহের একটি বাগিচা।’ [সহিহ বুখারি ১১৯৫] মসজিদে নববীর পাশে আয়েশা (রাঃ)-এর হুজরায় অবস্থিত নবীজির কবর। তারই পাশে হজরত আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ)-এর কবর। এর পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি আছে, এখানে হজরত ঈসা (আঃ)-এঁর সমাধি হবে। [তিরমিজি ৩৬১৭] মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত বাকি গোরস্তানে অসংখ্য সাহাবা, তাবেইন, আউলিয়া ও নেককার মুসলমানের কবর রয়েছে। এর মধ্যে হজরত উসমান (রাঃ), ইবনে মাসউদ, ফাতিমা (রাঃ), আয়েশা (রাঃ), রাসুল (সাঃ)-এর দুধ মা হালিমা (রাঃ), চাচা আব্বাস (রাঃ), রাসুল (সাঃ)-এর ছেলে ইব্রাহিম আনহুমসহ অনেকের কবর শরীফ আছে। রাসুল (সাঃ) প্রায়ই বাকি জিয়ারতে যেতেন।
২. রাসূল (সাঃ)-এর রওজা মোবারকের মাটি আল্লাহর আরশের চেয়ে উত্তম!-সুবহানআল্লাহ।
ক. ফতয়ায়ে শামী এবারত হলো এই : রওজা মোবারকের যে মাটি নবী করীম সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেহ মোবারকের সাথে লেগে আছে, তা আসমান-জমিন এমনকি আল্লাহর আরশ আযীম হতেও উত্তম’। [ফতয়ায়ে শামী, ৩য় খণ্ড, যেয়ারত অধ্যায়।] খ. রওজা মোবরক যদি সর্বোত্তম হয়, তাহলে শরীর মোবারকের অবস্থা কি হতে পারে? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ আক্বিদা চার মাযহাবের ইমামগণ ঐক্যবদ্বভাবে পোষণ করে থাকেন। এ আক্বিদার উপর চার মাযহাবের ইজমা প্রতিষ্ঠিত। সুতারাং রওজা মোবারক খানায়ে কা’বা ও আরশ মোয়াল্লা হতেও উত্তম। ইহাই আহলে সুন্নাতের আক্বিদা। এ সম্পর্কে অসংখ্য কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। [মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, ৪র্থ খণ্ড, ৬০২ পৃষ্ঠা। গ. বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা আলুসী (রহঃ) বলেন, মাটির যে অংশটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মুবারকের সাথে লেগে আছে, তা আসমান যমীনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। এমনকি বলা হয় এবং আমিও বলি যে, রওযা শরীফ আল্লাহর আরশ থেকেও শ্রেষ্ঠ।’[রূহুল মা’আনীঃ৩/১১১] ঘ. আল্লামা মুল্লা আলী কারী (রহঃ) বলেন, মাটির যে অংশটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিসিম (শরীর) মুবারকের সাথে লেগে আছে, ইজমা এর ভিত্তিতে তা মক্কা মুকাররামাহ এমনকি আরশ থেকেও শ্রেষ্ঠ। [মিরকাতুল মাফাতিহঃ ৬/১০, যারকানীঃ১২/২৩৪]
৩. পবিত্র হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ১. হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার রওজ্বা যিয়ারত করল, তার জন্য সুপারিশ/শাফায়াত করা আমার উপর ওয়াজিব হয়ে গেল। দলিল : সুনানে দারে কুত্বনী ২/২৭৮ হাঃ ১৯৪, বায়হাকীঃকৃত শুয়াইবুল ইমান ৩/৪৯০ হাঃ ৪১৫৯-৬০, ইমাম হায়সামী কৃত মুজামুয যাওয়ায়েদ ৪/২
২. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহঃ) লিখেছেন, উপরোল্লিখিত হাদীসটিতে নবী করীম (সাঃ)-এর যিয়ারত জীবদ্দশায় ও পরবর্তী জীবনে উভয়টিকেই বোঝানো হয়েছে। তদ্রুপ যিয়ারতকারী কাছের হোক কিংবা দূরের, পুরুষ হোক বা মহিলা সবাইকে বোঝানো হয়েছে [হাশিয়া আলাল ঈজাহ ৪৮১]
৩. হযরত উমর (রাঃ ) হতে বর্ণিত আছে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যারা আমার রওজা যিয়ারত করবে তার জন্য আমার শাফায়াত অবশ্যক হয়ে যাবে। [সুবুলুল হুদা ওয়ার রাসাদ, ১২তম খণ্ড, ৩৭৯ পৃষ্ঠা]
৪. হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি, যারা আমার রওজা জিয়ারত করবে অথবা বললেন যারা আমার যিয়ারত করবে আঁমি তার সুপারিশকারি বা সাক্ষি হবো। দলিল : মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালছী, হাদিস নং ৬৫, শুয়াইবুল ইমান, হাদিস নং ৩৮৫৭, সুনানে কুবরা লিল বায়হাক্বি, হাদিস নং ১০২৭৩
৫. হযরত উমর (রাঃ) বলেন, রাসুলে করিম (সাঃ) আমাকে বলেছেন, যে ব্যাক্তি আমার কাছে শুধু যিয়ারতের উদ্দেশ্য আসবে অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়, তাহলে কিয়ামতের দিন তার জন্য শাফায়াত কারি হওয়া আমার জন্য অবশ্যক হয়ে যাবে। তাবারানী তার কবীরে, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৭৪ পৃ :, হাদিস নং ১৩১৪৯ ও আওছাতে, ৩য় খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা, হাদিস নং ৪৫৪৬
৬. হযরত ইবনে উমর (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছেন, যারা আমার ওফাত শরীফের পরে আমার রওজা যিয়ারত করবে সে যেনো আমার জিবদ্দশায় জিয়ারত করলো। [মু’জামুল আওছাত লিত-ত্বাারানী, হাদিস নং ২৮৭; মু’ জামুল কাবির, হাদিস নং ১৩৪৯৬]।
৭. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীসে আছে নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর হজ করবে অতঃপর আমার কবর যিয়ারত করবে, সে যেন জীবিতাবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল’। বায়হাকী শু’আবুল ঈমান, হাদীস :৩৮৫৫
৮. হযরত আনাস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, যে কেবল মদিনা শরীফে আমার জিয়ারত এর উদ্দেশ্যে আসবে ও জিয়ারত করবে (কিয়ামতের দিন) সে আমার পার্শ্বে থাকবে। আর সে দিন আমি তার জন্য শাফায়াত করব। [জামে সগীর, পৃঃ১৭১, মুয়ালিম দারুল হিজরাত পৃঃ১০২]
৯. হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি মক্কায় হজ করলো অতঃপর আমার মসজিদের উদ্দেশ্য রওয়ানা করল। তার আমলনামায় দুটি মাকবুল হজ্জের সওয়াব লিখে দেয়া হবে’। [দাইলামী-ওফাউল ওফা ২য় খণ্ড, ৪০১ পৃষ্ঠা, জযবুল কুলুব পৃষ্ঠা ১৯৪]
১০. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, হুজুর (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ করল কিন্তু আমার রওজা শরীফ জিয়ারত করল না সে আমার উপর জুলুম বা অন্যায় আচরন করল। শিফাউল সিকাম পৃঃ ২৭, ওফাউল ওফা ২য় খণ্ড, ৩৯৮ পৃঃ, ইলাউম সুনান-১০ম খণ্ড, ৩৩২ পৃষ্ঠা
অনেকে বলেন, জিয়ারত হজের অংশ নয়। জিয়ারত না করলেও ফরজ হজ আদায় হয়ে যাবে। যারা পবিত্র রওজা শরীফ জিয়ারতে নিরুৎসাহিত করে তাদের উদ্দেশ্যে নবী (সাঃ)-এর এই হাদীস পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘যে হজ করল, কিন্তু আমার রওজা যিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি জুলুম বা অন্যায় আচরণ করল’।
হজের সফরে পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারাহ জিয়ারত করার জন্য ওলামায়ে কেরামগণ অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ‘মাআরিফুছ ছুনান’ নামক কিতাবের মধ্যে আছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বড় মাধ্যম হলো রাসূল (সাঃ)-এর রওজা শরীফ যিয়ারত করা এবং এর উদ্দেশ্যে সফর করা। আল ওফা নামক কিতাবের মধ্যে রয়েছে, হানাফী মাজহাবের ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, রাসূল (সাঃ)-এর রওজা শরীফ যিয়ারত মর্যাদার দিক দিয়ে ওয়াজিবের নিকটবর্তী। অনুরূপভাবে মালিকী ও হাম্বলী-মাজহাবের ওলামায়ে কেরাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দীছ দেহলভী (রহঃ) তাঁর জযবুল কুলুব নামক কিতাবে লিখেছেন, রাসূল (সাঃ)-এর রওজা শরীফ জিয়ারত করা সুন্নত। এটা ইজমা দ্বারা ছাবিত হয়েছে।
হজ করে রওজা মোবারক জিয়ারত না করে চলে আসা প্রিয়নবী (সাঃ)-এর সাথে চরম ধৃষ্ঠতা ছাড়া কিছুই নয়। পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারাহর জিয়ারতের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রিয়নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে সে ব্যক্তি যেন মৃত্যু পর্যন্ত মদিনায় অবস্থান করে। যে ব্যক্তিই মদিনায় মারা যাবে তার জন্য আমি নিশ্চয়ই সুপারিশ করবো’। [তিরমিজি, হাদীস : ৩৯১৭]
রাসূল (সাঃ)-ই-খাঁটি নবী প্রেমিকগণ মদিনায় মৃত্যুবরণের জন্য দোয়া করতেন। হযরত ওমর (রাঃ) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ আমাকে তোমার রাসূল (সাঃ)-এর শহর মদিনায় মৃত্যুমুখে পতিত কর’। (বুখারী)। আল্লাহপাক তার দোয়া কবুল করে ছিলেন। এভাবে ইমাম মালিক (রাঃ)সহ অগণিত নবী প্রেমিকের নাম নবীপ্রেমের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইমাম মালিক (রাঃ) সারা জীবনই মদিনায় কাটিয়েছিলেন। কেবলমাত্র ফরজ হজ আদায় করণার্থে এক বছর মক্কা শরীফ গিয়েছিলেন। নবী (সাঃ)-এর মহব্বতে আর কখনও মদিনা ত্যাগ করেন নি। মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা নববী (রহঃ) লিখেছেন, হজ ও উমরাহকারীগণ মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে রওজাপাকের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা শরীফের সফর করবে। কেননা এটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং সফলতার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা। [আল ঈজাহ, ৪৪৭]
ঐতিহাসিক হাররার ঘটনার সময় আবু সাঈদ মাওলা আল মাহরী আবু সাঈদ খুদরীর (রাঃ)-এর নিকট এসে মদিনা থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ চাইলেন। তিনি অভিযোগ করলেন, মদিনার আসবাব-পত্র ও পণ্যের দাম বেশি এবং তার সন্তান-সন্ততির সংখ্যাও প্রচুর। এও বললেন, মদিনার এই দুঃখ ও কষ্টে ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা তার নেই। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) তাকে বললেন, আফসোস! তোমাকে এ পরামর্শ দিতে পারি না। কারণ, আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি : ‘যে ব্যক্তি মদিনার দুঃখণ্ডকষ্টে ধৈর্য ধারণ করে এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য শুপারিশকারী বা সাক্ষী হব যদি সে মুসলিম হয়।’
১১. যে মদিনায় মারা যাবে নবীজী (সাঃ) তার জন্য সুপারিশ করবেন : মদিনাতে মৃত্যুবরণ করা সৌভাগ্যের মৃত্যু। হজরত ওমর (রাঃ) মদিনাতে ইন্তেকালের জন্য দু’আ করতেন। মদিনাতে মৃত্যুবরণকারীর জন্য নবীজী (সাঃ) সুপারিশ করবেন। হজরত ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছেন, যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম সে যেন সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। কেননা, যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করবে আমি তার জন্য সুপারিশ করবো। [তিরমিজি : ৩৯১৭, আহমদ, ইবনে হিব্বান ৩১৪১]
১২. হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে : খাত্তাব পরিবারের এক ব্যক্তি হুজুর পাক (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, যে স্বেচ্ছায় আমার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে আমার জিয়ারত করবে, পরকাল দিবসে সে আমার পাশে থাকবে। আর যে মদিনা শরীফ বাস করবে এবং উহার বালা মসিবত ও কষ্টে ধৈর্য্য অবলম্বন করবে কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য সাক্ষী ও সুপারিশকারী হব। আর যে দুই হেরেম শরীফের কোন একটিতে মৃত্যুবরণ করবে পরকাল দিবসে তাকে আল্লাহ্ তায়ালার নিরাপত্তা প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করে উঠাবেন। [মেশকাত শরীফ]
নবী করিম (সাঃ)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতে অশেষ বরকত ও সওয়াবের কাজ। ইহা মোস্তাহাব কাজগুলির মধ্যে সর্বোত্তম মোস্তাহাব বরং ওয়াজিবের নিকটবর্তী। এজন্য সফর করাও মোস্তাহাব। হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী মাযহাবের সকলেই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। আল্লামা সুবুকী রহমতুল্লাহি আলাইহি এ ব্যাপারে কওলী ও ফেলী মতামত একত্রে নকল করেছেন। [মাআরেফে মাদানিয়া]
হুজুর পাক (সাঃ)-এর রওজা শরীফ জিয়ারত করা জায়েজ বরং মোস্তাহাব। কোন কোন রেওয়ায়েতে ওয়াজিবের নিকটবর্তী বলে উল্লেখ আছে। অধিকাংশ বর্ণনায় একে সহীহ বলা হয়েছে। এ রেওয়ায়েত অনুযায়ী মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মানাসেক, সামহুদী তাঁর ওফাউল ওফা কিতাবে আর খোলাসাতুল ওফা কিতাবে মশহুর রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রতি বৎসর দুই জন ব্যক্তিকে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর রওজা শরীফে সালাম পৌঁছানোর জন্যে প্রেরণ করতেন। [ফতওয়ায়ে দারুল উলুমণ্ডকিতাবুল হজ]
মহাল আল্লাহ আমাদের জীবনে একবার হলেও রাসূল (সাঃ) রওজা জিয়ারাত করার তাওফিক দান করুক। আমিন।
লেখক : খতিব, কালেক্টরেট জামে মসজিদ ও প্রভাষক (আরবি), মান্দারী ফাযিল মাদ্রাসা, চাঁদপুর।