বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র
অনলাইন ডেস্ক

সংবিধান বা শাসনতন্ত্র সরকারের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়। তা হলো যে কোনো রাষ্ট্রের মূল ও সর্বোচ্চ আইন। যার মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা চর্চার শাখাগুলোকে বিধিমালার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র হলো মদিনা সনদ। যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত হয়। ইতঃপূর্বে আইন ছিলো স্বৈরাচারী শাসকের ঘোষিত আদেশ এবং সরকার ছিলো ব্যক্তি কেন্দ্রীভূত।

সর্বপ্রথম মহানবী (সাঃ) জনগণের মঙ্গ লার্থে আইনের শাসন বা মদিনা সনদ (ম্যাগনাকার্টা) প্রতিষ্ঠা করেন। হিজরতের পর মহানবী (সাঃ)-এর কর্তব্য ছিলো কলহ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত মদিনাবাসীদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃ-সংঘ গঠন করে হিংসা, দ্বেষ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চিরতরে উচ্ছেদ করা বা গোত্রে গোত্রে চিরদ্বন্দ্ব দূর করা। এক গোত্র আরেক গোত্রকে সমর্থন করায় মদিনার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি দিনে দিনে জটিল ও শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং সংশয়, উদ্বেগ ও অস্থিরতার মধ্যে কালতিপাত করতে থাকে। মহানবী (সাঃ) মদিনায় আগমন করলে মদিনাবাসীগণ তাঁকে সাদরে ও সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন।

মহানবী (সাঃ) ছিলেন নবজাগরণের অগ্রনায়ক, ভবিষ্যৎ কমনওয়েলথের প্রতিষ্ঠাতা, মিলনের দূত, আশার আলো ও বিশ্বমানবের ত্রানকর্তা বিশেষ করে আউশ ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়কে একতা ও ভ্রাত্বত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং অমুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলবার জন্য সাতচল্লিশটি শর্তসম্বলিত এই মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন। “মহান ও পরম দয়ালু আল্লাহর নামে রাসূল করিম (সাঃ) কর্তৃক লিখিত ও প্রদত্ত চুক্তিপত্র (সনদ) কুরাইশ ও ইয়াসরিরেব (মদিনাবাসী) বিশ্বাসী ও মুসলমানদের জন্য এবং যারা তাদের অনুসরণ করবে তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবে (মাওয়ালী) এবং যারা তাদের সঙ্গে ধর্মযুদ্ধে (জিহাদ) অংশগ্রহণ করবে তাদের জন্য প্রদত্ত হলো : (১) তারা (সনদে উল্লেখিত) একটি জাতি (উম্মা) এবং অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র। (২) কুরাইশ-মুহাজিরিন পূর্ব প্রচলিত প্রথানুযায়ী সমবেতভাবে খুন খেসারত প্রদান করবে এবং পরস্পরের সমঝোতর ভিত্তিতে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিচারের দ্বারা তাদের বন্দিদের মুক্তি দিবে। (৩) বানু আউফ গোত্র তাদের পূর্বের শর্তানুযায়ী মৃত্যুপণ প্রদান করবে এবং প্রত্যেকটি অঙ্গ গোত্র স্ব স্ব বন্দির মুক্তিপণ প্রদান করবে। (৪-১০) অনুরূপভাবে বানু হারিস, বানু সায়ীদা, বানু জুশাম, বানু নাজ্জার, বানু আমর-বিন-আউফ, বানু নাফীত ও বানু আল-আউস গোত্র পূর্ববর্তী শর্তানুযায়ী মৃত্যুপণ ও মুক্তিপণ প্রদান করবে। (১১) বিশ্বাসীগণ কোন ঋণী বন্ধুকে পরিত্যাগ করবে না, বরং মুক্তিপণ খুনের খেসারত ইত্যাদি প্রদানের ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গতভাবে সাহায্য করবে। (১২) একজন বিশ্বাসী অপর একজন বিশ্বাসীর অনুমতি ব্যতীত তার মওলার সঙ্গে কোন প্রকার সখ্যতা স্থাপন করতে পারবে না। (১৩) আল্লাহর ভয়ে ভীত যদি কোন বিশ্বাসী বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যায়, বিশ্বাসঘাতকতাপূর্র্ণ বা দুর্নীতিমূলক কাজে লিপ্ত হয় তবে তারা তাদের যথোচিত শাস্তি প্রদান করা হবে। কেউই অবিশ্বাসীর আপন পুত্রকেও এ ব্যাপারে ক্ষমা করতে পারবে না। (১৪) একজন বিশ্বাসী কোন পক্ষাবলম্বন করে কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করতে পারবে না অথবা কোন বিশ্বাসীর বিরুদ্ধে অবিশ্বাসীকে সাহায্য করতে পারবে না। (১৫) আল্লাহপ্রদত্ত নিরাপত্তা একক ও আশ্রয়দান (ইযাজুর) মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য। বিশ্বাসীগন পরস্পরের রক্ষক বা পোষণকারী, অন্যান্য লোক-গোষ্ঠীর পোষণকারী নয়। (১৬) মুসলমানদের অনুগামী কোন ইহুদি যতদিন পর্যন্ত তাদের কোন প্রকার ক্ষতিসাধন না করে অথবা তাদের বিরুদ্ধে অন্য লোকদের সাহায্য না করে তত দিন পর্যন্ত সে একই সাহায্য লাভ করবে। (১৭) বিশ্বাসীগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শান্তি চুক্তি (সনদ) একক এবং সামগ্রিক। যখন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে হবে তখন বিশ্বাসীগণ একত্রে যুদ্ধ করবে, তার জন্য পৃথক চুক্তির প্রয়োজন নেই। এই যুদ্ধের সময় কোনও বিশ্বাসী পৃথকভাবে শান্তি স্থাপন করতে পারবে না। (১৮) মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলেই পর্যায়ক্রমে (বিশেষ করে যাদের অশ্ব বা উট নেই) বিশ্বাসীদের অশ্ব বা উটে সওয়ার হতে পারবে। (১৯) আল্লাহর কাজে (ধর্মযুদ্ধে) যদি কোন বিশ্বাসী প্রাণ দেয় তবে বিশ্বাসীগণ একত্রে এর প্রতিশোধ নিবে। খোদাভীরু বিশ্বাসীগণ সঠিক ও নির্ভুল পথে চলে। (২০) কোন বিশ্বাসী পৌত্তলিক কুরাইশকে আশ্রয় দিবে না এবং তাদের পক্ষ নিয়ে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে মধ্যস্থতা করবে না। (২১) কোনও বিশ্বাসীকে কেউ অন্যায় ভাবে হত্যা করলে এবং হত্যার ঘটনা নির্ভুল ভাবে প্রমাণিত হলে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ মৃত্যুপণ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে হত্যাকারীকে হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বাসীগণ কোনোক্রমে হত্যাকারী পক্ষ সমর্থন করবে না। (২২) এই সনদের প্রতি যারা সম্মতি জ্ঞাপন করছে এবং যারা আল্লাহর ও শেষ দিনের বিচারে (আখেরত) বিশ্বাস রাখে তারা কোনও দুস্কৃতকারীকে আশ্রয় অথবা খাদ্য প্রদান করবে না। যদি কেহ তা লঙ্ঘন করে তাহলে আল্লাহর কর্তৃক সে অভিশপ্ত হবে। কোনও প্রকার ক্ষতিপূরণে উক্ত অপরাধ মওকুফ হবে না। (২৩) বিশ্বাসীদের মধ্যে মতানৈক্য হলে তা আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সম্মুখে পেশ করতে হবে। (২৪) বিশ্বাসীদের সঙ্গে ইহুদীগণও যুদ্ধের ব্যয় বহন করবে। (২৫) বানু আউফ ও সা’লাবাহ গোত্রের ইহুদিগণ এবং বিশ্বাসীগণ একই জাতি (উম্মা) ভুক্ত। বিশ্বাসীগণ ও ইহুদিগণ স্ব স্ব ধর্ম অনুসরণ করবে। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক বা বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে লিপ্ত হবে না। (২৬) বানু আউফের প্রতি যে শর্ত প্রদত্ত হয়েছে বানু নাজ্জার গোত্রের জন্যও অনুরূপ শর্ত প্রযোজ্য হবে। (২৭-৩০) বানু হারিস, বানু সায়িদা, বানু জুশাম, বানু আউশ ইহুদি গোষ্ঠীদের জন্য একই শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে। (৩১) বানু আউফ গোত্রের জন্য যে শর্ত প্রযোজ্য বানু সা’লাবাহ গোত্রের জন্যই তাই প্রযোজ্য। শুধু ব্যতিক্রম এই যে, যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে সে তার পরিবারের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। (৩২) জাফনাহ নামক সালাবাহর উপগোত্রটি একইরূপ। (৩৩) বানু আউফের ন্যায় বানু শুতায়বা গোত্রও বিশ্বাসঘাতক নয়, সম্মানজনক ব্যবহারের উপযুক্ত। (৩৪) সা’লাবাহর মাওয়ালীগণও অনুরূপ। (৩৫) ইহুদি সম্প্রদায়ের বিতানাও তাদের মত। যারা রক্তের সর্ম্পক ব্যতীত ইহুদীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাদের বিতানা বলা হয়। (৩৬) হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ব্যতীত কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। কিন্তু কেউ আহত হলে তার প্রতিশোধ নিতে পারবে। কেউ হঠকারিতা করে কাউকে আক্রমণ করলে আক্রমণকারী ও তার পরিবার তার জন্য দায়ী থাকবে। (৩৭) ইহুদিগণ ও মুসলমানগণ পৃথকভাবে নিজেদের খরচ বহন করবে। এই দুই দলের মধ্যে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উপর সম্পর্ক বিদ্যমান, বিশ্বাসঘাতকতার উপর নয়। (৩৮) এই সনদ যারা স্বীকার করে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কেহ যুদ্ধ করলে তা একত্রে শত্রুর মোকাবিলা করবে। যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদীগণও যুদ্ধের ব্যয় ভার বহন করবে। (৩৯) এই সনদের আওতাভুক্ত লোকজনের নিকট ইয়াসরিব উপত্যকা একটি পবিত্র স্থান। (৪০) আশ্রিত প্রতিবেশী (জাব) কোনও প্রকার নাশকতামূলক অথবা বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে লিপ্ত না হলে সে আপনজন হিসেবে বিবেচিত হবে। (৪১) মহিলাগণ তাদের গোত্রের লোকদের সম্মতি ব্যতীত প্রতিবেশীসুলভ আশ্রয় (তুজার) পাবে না। (৪২)। এই সনদের অন্তর্ভুক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে যদি কোন দুর্ঘটনা বা বিবাদ উপস্থিত হয়, যার ফলে জাতির ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে বিচারের জন্য উহার আল্লাহর রসুলের উপর ন্যস্ত করতে হবে। (৪৩) কোন কুরাইশ বা তাদের সাহায্যদাতাকে প্রতিবেশীসুলভ আশ্রয় দেয়া যাবে না। (৪৪)। ইয়াসরিব সহসা আক্রান্ত হলে এই সনদের আওতাভুক্ত সকলেই শক্রর বিরুদ্ধে একত্রিত হবে। (৪৫) যখন তাদের কোন প্রকার চুক্তি বা সনদ করতে বলা হবে তখন তারা তা করবে এবং উহা মেনে নিবে। (৪৬) আউশ গোত্রের ইহুদিগণ ও তাদের অনুগত ব্যক্তিগণ এই সনদের সমর্থকদের সঙ্গে যতদিন পর্যন্ত সম্মানজনক ব্যবহার করবে ততদিন পর্যন্ত তাদের সনদের আওতাভুক্ত লোকদের সমমর্যাদা লাভ করবে। আল্লাহ এই সনদের সত্যকার বাস্তবায়নকরী। (৪৭) এই সনদ কোন অন্যায়কারী বা বিশ্বাসঘাতককে আশ্রয় দেয় না। অন্যায় বা বিশ্বাসঘাতকতা করে যে বাইরে চলে যায়, সে নিরাপদ এবং যে ভিতরে থাকে সেও মদিনায় নিরাপদ। যারা সৎকর্মে লিপ্ত থাকে এবং আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তাদের রক্ষাকারী এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বাণী বাহক।

আইয়্যামে জাহেলিয়া বলতে অজ্ঞতার যুগে, বর্বরতার যুগে, কুসংস্কারের যুগে, অন্ধকারের যুেগ বা তমস্যার যুগে সময় ও কাল বিচারে মদিনা সনদ ছিল অবশ্যম্ভাবী। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মদিনার সনদ যুগে যুগে, দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মদিনা সনদ মহানবী (সাঃ)-এর অসামান্য ও অপূর্ব মননশীলতা শুধু তৎকালীন যুগে নয়, বরং সর্বযুগে ও সর্বকালের মহামানবের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচালক। পৃথিবীবাসীকে প্রথম লিখিত সংবিধান উপহার এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেওয়ার জন্য তাঁর (সাঃ) প্রতি শত শত দরুদ ও সালাম। সুমহান আদর্শ প্রচারের জন্য মহানবী (সাঃ) কে মনে পড়ে পাখি ডাকে ভোরে, রোদেলা দুপুরে,সূর্যের সামনে, জ্বলন্ত মোমের আড়ালে, হেলে যাওয়া বিকেলে, শান্ত গোধুলিতে, শিশির ভেজা সকালে, কনকনে শীতে, মুষল ধারে বৃষ্টিতে, চাঁদের সুষমা ভরা রাতে, চেতন-অবচেতন মনে আর দিনে পাঁচ বার মুয়াজ্জিনের সুমধুর, সুললিত, লালিত্যময়, জলদ-গম্ভীর কণ্ঠে বা আজানের ধ্বনিতে।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়