প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আরবি অষ্টম মাস শাবান। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুয়াজজাম তথা মহান শাবান মাস’। সে কারণেই মহানবি (সাঃ) এ মাসজুড়ে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি ও রোজা পালন করতেন।
বিশ্বনবি (সাঃ) শাবান মাসজুড়ে ইবাদত-বন্দেগি করতেন এবং অনেক বেশি রোজা রাখতেন। শাবান মাসের মতো এতবেশি রোজা রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে রাখতেন না। মহানবি (সাঃ) রমজানের আগের দুই মাসজুড়ে নফল ইবাদত ও রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতেন। এ কারণেই রজবকে আল্লাহর মাস, শাবানকে নবিজির মাস আর রমজানকে উম্মতের মাস মাস বলা হয়। তাই ইসলামিক স্কলররা ইবাদত করা ও রোজা রাখার মাধ্যমে কীভাবে নিজেদের প্রস্তুত করা যায়, তার একটি চমৎকার উপমা তুলে ধরেছেন। তাহলো- মুমিন মুসলমান রজব মাসে ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিন চাষাবাদ করবে, শাবান মাসে আরও বেশি নফল ইবাদত ও রোজা রাখার অভ্যাস গঠনের মাধ্যমে মনের জমিনে বীজ বপন করবে। আর রমজান মাসজুড়ে শুধু রাতের কিয়াম তথা ইবাদত এবং দিনের সিয়াম তথা রোজা পালনের মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে জমিন থেকে ফসল ঘরে তুলবে।
এ বিষয়গুলো হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা ফুটে ওঠেছে-
১. হজরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রোজা রাখতে থাকতেন, যাতে আমরা বলতাম যে, তিনি (এ শাবান মাসে) আর রোজা ছাড়বেন না; আবার তিনি রোজা ভাঙতে শুরু করতেন, যাতে আমরা বলতাম যে, তিনি (এ শাবান মাসে) আর রোজা রাখবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে রমজান মাস ছাড়া আর কখনো পূর্ণ মাস রোজা রাখতে দেখিনি। আর তাঁকে শাবান মাস ছাড়া কোনো মাসে এতো বেশি রোজা রাখতেও দেখিনি।
২. অন্য বর্ণনায় তিনি (আয়েশা) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শাবানের পূর্ণ মাসই রোজা রাখতেন। তিনি শাবানের রোজা রাখতেন তবে অল্প কিছু দিন (রাখতেন না)। (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকি, আবু দাউদ, মিশকাত)
৩. হজরত উসামা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে এ মাসে (শাবান) বেশি বেশি রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি উত্তরে বললেন, ‘লোকেরা রজব ও রমজান এ দু’মাসের গুরুত্ব বেশি দেয় এবং রোজাও রাখে। কিন্তু মধ্যবর্তী এ মাসটিকে উপেক্ষা করে চলে। অথচ এ মাসেই বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হয়। আর আমার কামনা হলো, আমার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করার সময় আমি রোজা অবস্থায় থাকি। এ কারণেই আমি শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখি। (নাসাঈ, আবু দাউদ)
মহানবি (সাঃ) রজব ও শাবান মাস দুইটির বরকত কামনা করতেন। আর শাবান মাস এলে শাবান মাসের বরকত কামনা করতেন এবং রমজান পাওয়ার জন্য আবেদন করতেন। মহানবি শাবান মাসে আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাব ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’
অর্থাৎ হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজানে পৌঁছে দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকি)
শাবান মাসের রোজা : নিসফা শাবানে তথা পনেরোতম শাবানে মহানবি রোজা পালন করতেন। তবে এ উপলক্ষে আমাদের সমাজে অন্যান্য কিছু কাজ করা হয়; যা বাড়াবাড়ির নামান্তর। আবার অনেকে ইবাদতের ক্ষেত্রে এমন ভান দেখায় যে, নিসফ শাবান, আইয়ামে বিজ ইত্যাদি ইবাদত বলে কিছু নেই। না! তা সঠিক নয়; বরং এ রাতের ইবাদত মর্যাদার আবার এ রাতটি আইয়ামে বিজের রাতও বটে। আর এ দিনে রোজা রাখা সুন্নাত আমলও বটে।
শাবান মাসের সতর্কতা : শাবান মাসে নফল ইবাদত-বন্দেগিতে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কোনোভাবেই যেন কোনো ফরজ ওয়াজিব, সুন্নাত ও মোস্তাহাব কাজ ছুটে না যায়। এ মাসে যেন কোনো নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত না হয়।
শাবান মাসের অন্যতম কাজ হলো রমজানের রোজা পালনের জন্য শাবান মাসের চাঁদের হিসাব রাখা। হাদিসে মহানবি (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’
শাবান মাস বিশেষ দু’কারণে ফজিলতপূর্ণ : ‘শাবান’ মাস নফল ইবাদত-বন্দেগির মাস। এছাড়াও বিশেষ দুটি কারণে মাসটি প্রসিদ্ধ। শাবান মাসে মহানবি (সাঃ) অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক আমল করতেন। শাবান মাসের বিশেষ ঘটনা হলো, ইসলামের ইতিহাসে হিজরি বছরের অষ্টম মাস শাবান মাসে বিশেষ দুটি ঘটনা ঘটে, যা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও আকাক্সক্ষক্ষার বিষয়। তাহলো-
১. কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশে আয়াত নাজিল : ইসলামের ইতিহাসের সেরা ঘটনা ‘কেবলা পরিবর্তন’। এটি ছিল হিজরতের ১৬ মাস পরের এবং বদরের যুদ্ধের মাত্র দু’মাস আগের ঘটনা। আকাঙ্ক্ষিত বরকতময় মূহূর্তটি ছিল দ্বিতীয় হিজরি সনের শাবান মাস। মদিনা থেকে একটু দূরের একটি মসজিদে মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবিদের নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে জোহরের নামাজ আদায় করছিলেন। মহানবি নামাজে থাকাকালীন সময়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিল করে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব অবশ্যই আমি তোমাকে সেই কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব, যাকে তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করো এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকেই মুখ করো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৪৪)
এ কারণেই শাবান মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামি ঐক্যের মাস, অন্যদিকে তেমনি কাবা শরিফ কেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।
২. দরূদ পড়ার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নাজিল : শাবান মাসেই নবিজি (সাঃ)-এর প্রতি রহমত তথা দরূদপাঠের নির্দেশ সম্বলিত অসাধারণ আয়াতটি নাজিল হয়। তাই মহানবির প্রতি অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধা, প্রেমণ্ডভালোবাসা দেখানোর মাসও এটি। এ মাসেই মহানবি (সাঃ) সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত-বন্দেগি করতেন। আল্লাহ তায়ালা এ মাসেই নাজিল করেন-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা নবিজির প্রতি পরিপূর্ণ রহমত নাজিল করেন, ফেরেশতারা নবিজির জন্য রহমত কামনা করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৫৬)
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন।