শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বিশ্বনবির (সাঃ) মেরাজ ও আধুনিক বিজ্ঞান
অনলাইন ডেস্ক

মেরাজ আরবি শব্দ। এর শব্দমূল ‘উরুজ’। অর্থ উত্থান। সাধারণ অর্থে ঊর্ধ্বারোহণ বা সিঁড়ি। ইসলামি পরিভাষায় মেরাজ শুধু ঘটনা নয়; বরং বিশ্ব ইতিহাসের অত্যাশ্চর্য ও বিস্ময়কর এক ঘটনা। মূলত মহানবি (সাঃ)-এর মেরাজ হলো প্রকৃত বন্ধত্বের নিদর্শনস্বরূপ আশ্বস্তকরণের এক দীপ্ত নমুনা। মহানবি (সাঃ) দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে গিয়ে একদিকে যখন লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার তীব্র দাহনে উৎপীড়িত হচ্ছিলেন, অন্যদিকে তার আশ্রয়দাতা আবু তালেব ও জীবনসঙ্গিনী হজরত খাদিজা (রাঃ) ইহধাম ত্যাগ করেন। আবার তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েও তায়েফবাসীর অত্যাচারে আহত হয়ে বিফল মনোরথ হন। মোটকথা, এ সময়টাতে তিনি দারুণ মর্মপীড়ায় ভোগেন। ঠিক এমনি সময়ে মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিজ সান্নিধ্যে ডেকে আশ্বাসবাণী দিয়ে সান্ত¡না প্রদান করেন। কেননা বিপদ মুহূর্তে প্রকৃত বন্ধুর সামান্য সাহচর্যদান দুঃখকে হালকা করে দেয়।

মেরাজ প্রিয়নবি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনের একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এটি মূলত একটি মোজেজা। সকল নবিই মোজেজা প্রদর্শন করেছেন। তাতে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের হেদায়াতের নির্দেশ ঘটেছে। এসব কারণেই এ মোজেজাটি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার অসীম দান এবং মহাকুদরতের ফল। পূর্বেকার নবি-রাসুলগণ শুধু অহির মারফতে অবগত হয়েই আল্লাহর ক্ষমতা, তার আরশ-কুরসি বেহেশত-দোজখ ইত্যাদি সম্বন্ধে মানুষকে অবগত করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তা স্বচক্ষে অবলোকন করান।

মেরাজ মানে আল্লাহর দিদার লাভ করা। এ মেরাজ দু’ভাবে হতে পারে। দৈহিক মেরাজ এবং আত্মিক মেরাজ। একটি হাদিসে নামাজকে মুমিনের মেরাজ বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো- নামাজের মাধ্যমে মুমিনগণ আত্মিকভাবে আল্লাহর দিদার পেয়ে থাকে। সরাসরি দৈহিকভাবে আল্লাহর দিদার লাভ হয় না। আমাদের আলোচ্য মেরাজটি নবিজির দৈহিক মেরাজ সম্পর্কে। নামাজ ছাড়াও নবিজির জীবনে আত্মিক মেরাজ ঘটেছে বহুবার। আত্মিক বা স্বপ্নযোগে আল্লাহর দিদারলাভের প্রসঙ্গটি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আয়েশা (রাঃ) থেকে উল্লেখ আছে।

মেরাজ সম্পর্কে পবিত্র কালামামুল্লাহ শরিফে সুরা বনি ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- “পবিত্রতম ও সকল দুর্বলতামুক্ত সেই মহিমাময় সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়।”

মেরাজ বিষয়ে ৩১ জন সাহাবির নিকট থেকে বিশদ বিবরণ সম্বলিত ৩২টি বর্ণনা রয়েছে। এ বিশাল সংখ্যক বর্ণনার সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ- রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মহানবি (সাঃ) কাবা শরিফের ‘হাতিম’ নামক স্থানে বা অন্য বর্ণনামতে কাবার অতি সন্নিকটে অবস্থিত উম্মে হানী (রাঃ)-এর ঘরে শায়িত ছিলেন। এ সময় হজরত জিবরাইল (আঃ), হজরত মিকাইল (আঃ) ও হজরত ইসরাফিল (আঃ) এসে নবিকে জাগ্রত করান। তাঁরা নবিজির বক্ষবিদারণ তথা ওপেন হার্টসার্জারি করে তাঁর কলব জমজমের পানিতে ধুয়ে ঈমান ও হেকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে দেন। এ বক্ষবিদারণ করার সময় মহানবি (সাঃ) কোনো রকম ব্যথা অনুভব করেননি এবং কোনো রক্তপাতও হয়নি। মহানবির বক্ষবিদারণের পর তার সামনে ‘বোরাক’ নামের এক আশ্চর্য স্বর্গীয় বাহন উপস্থিত করা হয়। তাতে জিন ও লাগাম লাগানো ছিল। এ বাহনটি গাধা হতে উঁচু এবং খচ্চর হতে নিচু। তার গতি অকল্পনীয় দ্রুত। তা’ নিজ দৃষ্টির সীমানায় পদক্ষেপ করে থাকে। যেমন এক কদমে পৃথিবী থেকে প্রথম আসমান বা নিম্নতম আসমানে পৌঁছে যায়। পলকের মধ্যে এ জাতীয় ভ্রমণ কাজ সম্পন্ন হয়। এ বাহনে আরোহণ করে নবিজি (সাঃ) বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছেন। সেখানে তিনি বোরাক অদূরে বেঁধে রেখে মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর বিশেষ সিঁড়ির মাধ্যমে প্রথম আসমানে ওঠে হজরত আদম (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এভাবে যথাক্রমে দ্বিতীয় হতে সপ্তম আসমানে হজরত ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ), হজরত ইউসুফ (আঃ), হজরত ইদরিস (আঃ), হজরত হারুন (আঃ), হজরত মুসা (আঃ) এবং হজরত ইবরাহিম (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সকলেই মহানবি (সাঃ)-কে ‘মারহাবা’ তথা সুস্বাগতম বলে সম্বর্ধনা জানান।

সপ্তম আকাশে নবিজি বায়তুল মামুর দেখতে পান। অতঃপর নবিজি ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বা শেষ সীমা নির্দেশক কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেন। ক্রমান্বয়ে তিনি জান্নাত ও দোজখ পরিদর্শন করেন। সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে বোরাকের গতি থেমে যায়। ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ)-ও আর এগুতে পারেননি। সিদরাতুল মুনতাহার নিকটেই সবুজ রংয়ের ‘রফরফ’ নামের একটি কুদরতি পালকি জাতীয় যানবাহন অপেক্ষমাণ ছিল। এতে চড়ে একাই মহানবি (সাঃ) আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হন।

এ মেরাজ সফরেই উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার বিধান সাব্যস্ত হয়। ফেরৎ পথে মুসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তার পীড়াপীড়িতে নবিজি (সাঃ) মহান আল্লাহর দরবারে ফিরে গিয়ে তা’ কমাবার জন্য সুপারিশ করেন। এতে দশ দশ করে কমে শেষে পাঁচ ওয়াক্তে এসে দাঁড়ায়। মহান আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট হয়ে পাঁচ ওয়াক্তে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াবদানে ওয়াদাবদ্ধ হন।

অতঃপর আসমানে যেসব নবির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল, মহানবি (সাঃ) তাদের সহকারে বায়তুল মোকাদ্দাসে ফিরে আসেন। তারা তাঁকে বিদায় সম্বর্ধনা জানাবার জন্য এখান পর্যন্ত আগমন করেন। ইতোমধ্যে নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি নবিদের ইমাম হয়ে নামাজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর তিনি বোরাকে চড়েই রওয়ানা হন এবং অন্ধকার থাকতেই যথাস্থানে ফিরে আসেন।

সময় থামিয়ে দেওয়ার হেকমত : হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, নবিজি (সাঃ) এ অতিপ্রাকৃত সফরশেষে ফিরে এসে দেখতে পান তার অজুর পানি তখনও গড়াচ্ছে এবং বিছানা উষ্ণই ছিল। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল ভ্রমণ তথা মেরাজ সফল সমাপ্ত হয়। অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, মহানবি (সাঃ)-এর এ বিস্ময়কর ভ্রমণে দীর্ঘ সাতাশ বছর কেটে যায়। স্ববিরোধী এ বক্তব্যের জবাবে মুহাদ্দিসিন বলেছেন, দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের আগমনে যেমন জনতা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তার সম্মানে সব যানবাহন, মানুষের কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে, তেমনিভাবে মহানবির (সাঃ) আগমনে তামাম ব্রহ্মা-ের কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এখানে স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে যে, মেরাজের এমন মর্যাদাপূর্ণ সফরে দুনিয়ার সময়ের গতিকে থামানো হলো কেন? এর যৌক্তিক জবাব হলো- যদি দুনিয়ার সময়কে চালু রেখেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের সাতাশ বছরের মেরাজের সফরের সময় পার করতেন, তাহলে এ সুদীর্ঘ সময়ে জাতি সম্পূর্ণভাবেই খোদাবিমুখ হয়ে যেত এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগেই ফেতনা-ফাসাদে জড়িয়ে পড়ত। উদাহরণত হজরত মুসা (আঃ) মাত্র চল্লিশ দিন তুর পর্বতে সাধনা করতে গিয়ে উম্মতের কাছ থেকে দূরে থাকার সময় তার উম্মতেরা বাছুর পূজার ফেতনায় জড়িয়ে ঈমানহারা হয়ে যায়। মহানবির দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণেও মুশরিকদের পক্ষে ও ইসলামের বিপক্ষে হয়তো এমন জনমত গড়ে ওঠত, যা’ পরে আর কাটিয়ে ওঠা মুসলমানদের পক্ষে সহজ হতো না। এ ধরনের ঘটনা মহানবির উম্মতের জীবনে ঘটুক, তা’ আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেননি বলেই তিনি দুনিয়ার সময়ের গতি বন্ধ করে দিয়েছেন।

এ মেরাজের প্রতি সকল মুসলিম তথা মানুষের বিশ্বাস আছে। তবে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এত স্বল্প সময়ে এ ব্যাপক ভ্রমণ ও বহুবিধ ঘটনাবলির সংঘটন সংক্রান্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তি নিয়ে। কিছু দুর্বলমনা ঈমানদার ও অবিশ্বাসী অমুসলিমদের কাছে এটি রহস্য হয়ে তাদের মনকে অনেক সময় তোলপাড় করে তোলে। তবে খাঁটি ঈমানদার বিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে অবশ্য এটি অত্যন্ত সহজ ছিল। কেননা তারা বিশ্বাস করে যে, হজরত (সাঃ) জীবনে মিথ্যা বলেননি। ‘আল আমিন’ তথা মহাবিশ্বাসী ছিল তার উপাধি। তাছাড়া সব কথাই যেখানে তার সত্য বলে প্রমাণিত, সেখানে মেরাজের ঘটনা অসত্য হবে কেন?

মেরাজের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে অবিশ্বাসী কোরাইশরা বায়তুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। তারা নবিজিকে কাবা হতে জেরুজালেমের পথের বর্ণনা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে বলে। জবাবে নবিজি (সাঃ) প্রতিটি উত্তর ও প্রত্যেক স্থানের বিবরণ নিখুঁতভাবে দিতে সক্ষম হন। এতে অবিশ্বাসীদের চোখ স্থির হয়ে যায় এবং বিশ্বাস না হলেও অন্তর তাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।

বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের জবাব : বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সশরীরে মেরাজ গমনের ঘটনা নিয়ে আলোড়ন চলতে থাকে। তাদের মতে, নভোমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার পেছনে যে সব অসাধারণ গুণাবলি দরকার, তা’ মানবের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, পৃথিবীর উপরে মাত্র বায়ান্ন মাইলব্যাপি বায়ুমণ্ডল রয়েছে, তার উপরে আর বায়ুমণ্ডল নেই। আছে হিলিয়াম, ক্রিপটন, জিয়ন প্রভৃতি গ্যাসীয় পদার্থ। বায়ুস্তর ভেদ করে এসব হালকা গ্যাসীয় পদার্থের অভ্যন্তরে এসে কোনো জীবজন্তুর প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব নয়। কেননা দেহের অভ্যন্তরীণ চাপ ও বহির্ভাগের চাপ সম্পূর্ণ পৃথক। এ চাপের সমতা রক্ষা করা জীবের পক্ষে কঠিন। এছাড়া ঊর্ধ্বাকাশে রয়েছে মহাজাগতিক রশ্মি ও উল্কাপাতের মতো ভয়ংকর ও প্রাণহরণকারী বস্তু ও প্রাণীসমূহের ভয়। এ যুক্তি প্রদর্শন করে চৌদ্দশ’ বছর কেটে গেছে এবং বিজ্ঞানীদের চোখে বিশ্বনবি (সাঃ)-এর নভোভ্রমণ বা মেরাজ উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে এ কথা দিন দিন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এ মেরাজ সশরীরেই হয়েছিল। তিনি সশরীরে মেরাজে গিয়েছিলেন বললেও তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভব এবং আজকের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও আগামী দিনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করতে পারছে।

প্রায় দেড় হাজার বছর জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা যেখানে জোর গলায় প্রমাণ করে দেখাতেন যে, মহাশূন্যের মহাকাশে মানুষ বিচরণ করতে পারে না, সেখানে তারাই বিংশ শতাব্দীর শেষে প্রমাণ করে দেখালেন যে, মানুষ গ্রহ হতে গ্রহান্তরে শূন্য হতে মহাশূন্যে বিচরণ করতে পারে। নতুন আবিষ্কার করে নতুনের সন্ধান দিয়ে তারা চৌদ্দশ’ বছরের পুরাতন বৈজ্ঞানিকদের হতাশাকে খণ্ডন করতে সক্ষম হয়েছেন। আমেরিকা নভোচারী ও তার সহচরবৃন্দ পৃথিবী হতে দু’ লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরের চাঁদের সাথে মিতালি পেতে বিশ্বকে অবাক করে দিলেন। বর্তমান সময়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে চলছে দারুণ প্রতিযোগিতা। কে প্রথম মঙ্গলগ্রহে, কে বুধ, শুক্র, ইউরেনাস ও নেপচুনে গিয়ে পৌঁছুতে পারবে। কোনো নির্বোধ এখন কথা বলার কি কোনো অবকাশ রাখে যে, নভোচারী গ্যাগারিন স্বপ্ন সাধনায় আধ্যাত্মিক শক্তিবলে মহাশূন্যে বিচরণ করেছেন?

মাটির মানুষের আকাশ ভ্রমণ নতুন নয় : আকাশ থেকে পৃথিবীতে কিংবা পৃথিবী থেকে আসমানে মানুষের আসা-যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের নবির আগেও তা’ সংঘটিত হয়েছে। হজরত আদম (আঃ) ও তার স্ত্রী হাওয়া উভয়েই মানুষ। সৃষ্টির পর থেকেই তারা সপ্তম আকাশে অবস্থিত জান্নাতে বসবাস করছিলেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। আদম ও হাওয়া (আঃ)-কে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসতে বলেন আর তারা হাত ধরাধরি করে নেমে এসেছে- ব্যাপারটি তো এমন নয়। সপ্তম আকাশ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। এখানেও যে কুদরতি সিঁড়ির প্রয়োজন ছিল, তা’ অবান্তর নয়।

এছাড়া হজরত ঈসা (আঃ)-কে ইহুদিরা হত্যা করতে চেয়েও হত্যা করতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা তার অসীম কুদরতে ঈসা নবিকে সশরীরে আসমানে তুলে নেন। সুরা নিসার ১৫৬-১৫৮ নং আয়াতে তার সাক্ষ্য রয়েছে। নব্য আবিষ্কারের যুগে মেরাজ সম্পর্কে যুক্তিবাদীদের জিজ্ঞাস্য ছিল যে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কৃত যান্ত্রিক উপকরণ ব্যতীত ভুলোক থেকে আরশে আজিম পর্যন্ত হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পক্ষে সশরীরে মেরাজে গমন করা কি সম্ভব?

এ প্রশ্নের জবাব খুবই সহজ। প্রথমত মেরাজ হলো একটি মোজেজা। আর নবিদের মোজেজাবলির প্রকাশক একমাত্র আল্লাহ। নবিগণ হলেন প্রকাশনার ক্ষেত্রমাত্র। মানুষের পক্ষে যা’ অসম্ভব, আল্লাহর পক্ষে তা-ই সম্ভব। আল্লাহর কুদরতি ক্ষমতার সামনে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। সব জিনিসের ওপর তিনি ক্ষমতাবান। আর নবিজির মেরাজ সম্পর্কিত আয়াতে তো স্বয়ং আল্লাহ বলে দিয়েছেন- ‘সমস্ত দুর্বলতা থেকে পবিত্র যে আল্লাহ তিনিই নিজের বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন।’ এখানে নবি মেরাজে ‘গেছেন’ বলা হয়নি; বরং তাকে স্বয়ং ‘আল্লাহ নিয়ে গেছেন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর মেরাজ হলো মোজেজা আর মোজেজার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

বৈজ্ঞানিকরা যেসব নিয়মতত্ত্বের আবিষ্কার করেন, মেরাজ সেসবের বিরোধী। যেমন আগুন মানুষকে পোড়ায় কিন্তু ইবরাহিম (আঃ)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের পরও তিনি পোড়া যাননি। এ সবই বিজ্ঞানীদের জ্ঞান বা সিদ্ধান্ত বিরোধী। নবি-রাসুলগণের এ জাতীয় অসংখ্য মোজেজা আছে, যা’ বিজ্ঞানের সূত্রে ব্যাখ্যা করা যায় না। দ্বিতীয়ত মুহাম্মদ (সাঃ) মানুষের আবিষ্কৃত কোনো রকেট নিয়ে আকাশ ভ্রমণ করেননি, করেছিলেন জিবরাঈল কর্তৃক আনীত আল্লাহপ্রদত্ত ‘বোরাকে’ চড়ে। যার গতিবেগ রকেটের গতিবেগের মতো ছিল না। ছিল সেকেন্ডে কোটি কোটি মাইল। চন্দ্র অভিযানে এপোলো-১৬ যেমন বিকল হয়ে পড়েছিল, অরিয়ন-এর এলুমিনিয়াম আস্তরগুলো যেমন খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছিল ও নভোচারীদের জীবনের ওপর মহাবিপদ এসেছিল, তেমন ঘটনা বোরাকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তেমন মহাবিপদও নভোভ্রমণে নবিজির জীবনের ওপর আসেনি। দু’ লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল অতিক্রম করতে যে কষ্ট পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের স্বীকার করতে হয়, যে উদ্বেগ, অস্বস্তি ও ভীতির মাঝে সময় গুণতে হয়, তেমন ঝুঁকি মহানবি (সাঃ)-কে নিতে হয়নি। কোটি কোটি মাইল পথ অতিক্রম করে, আকাশের কঠিন দ্বার উন্মোচন করে নবিজি আকাশের শেষপ্রান্তে এমনকি আরশে আজিমে উপনীত হন। ক্লান্তি, জড়তা, অস্থিরতা তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।

নভোচারীদের মহাশূন্যে বিচরণের পূর্বে তাদের দেহকে তন্ন তন্ন করে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। শুধু একদিন-দু’দিন পরীক্ষা করে উপযুক্ত বলে তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস তাদের শারীরিক সহিষ্ণুতার কৌশল, রক্তচাপ, হৃদক্রিয়া, বৃদ্ধির পরিমাণ, পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপযুক্ততা যাচাই করে নভোভ্রমণের উপযুক্ত কি না, তা’ বিচার করা হয়। এরপর উপযুক্তদেরকে সর্বপ্রকার ব্যবস্থাদি দিয়ে মহাকাশ বিচরণে পাঠানো হয়। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য বিংশ শতাব্দীর নভোচারীদের চেয়েও ভিন্নতর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয় গ্যাসীয় বস্তুর মাঝে টিকে থাকার মতো কুদরতি ঔষধ তার শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছিল। নবিজিকে সর্বকাজে উপযোগী ও সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরূপে প্রকাশ করতেই আল্লাহর সর্বাপেক্ষা প্রিয়, সুনিপুণ ও শক্তিশালী ডাক্তার জিবরাঈল নবিজির বক্ষ অপারেশন করেছিলেন এবং তার জড়ধর্মী স্বভাব দূরীভূত করে শক্তিশালী আলোর স্বভাবে রূপান্তরিত করেন।

লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন।

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়