প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
একদিন এ পৃথিবীর সব ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশাল বিশাল অট্টালিকা ভেঙ্গে গুড়ে চুরমার হয়ে যাবে। পাহাড়- পর্বত গুলো আকাশে তুলার মত উড়তে থাকবে। চন্দ্র- সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে একটি প্রাণও আর বেঁচে থাকবে না। আল্লাহ তায়ালার সমস্ত ফেরেশতা মারা যাবে। জিব্রাইল, মিকাইল, ইসরাফিল, সর্বশেষ আজরাইল (আঃ) নিজের জান নিজেই কবজ করে মারা যাবেন। সেদিন আল্লাহ ছাড়া আর কেহ অবশিষ্ট থাকবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হুকুমে ইসরাফিল আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিংগায় মুখ দিয়ে বসে আছেন। আল্লাহ তাআলার হুকুম হওয়ার সাথে সাথেই কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। ইসরাফিল আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার হুকুম পেয়েই সিঙ্গায় ফুৎকার দিয়ে দিবেন।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া আসমানসমূহে যারা আছে এবং পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। তারপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে। (সূরা ৩৯. আয-যুমার, আয়াত নং ৬৮)
আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের ভয়াবহতার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং এটা হবে দ্বিতীয় ফুঙ্কার, যার ফলে প্রত্যেক জীবিত মরে যাবে, সে আসমানেই থাকুক বা যমীনেই থাকুক। কিন্তু আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন জীবিত ও সজ্ঞান রাখার তাদের কথা স্বতন্ত্র। মশহুর হাদীসে আছে যে, এরপর অবশিষ্টদের রূহগুলো কবয করা হবে, এমন কি সর্বশেষে স্বয়ং হযরত মালাকুল মাউতের রূহ কবয করে নেয়া হবে। শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলাই বাকী থাকবেন, যিনি জীবিত ও চিরঞ্জীব। যিনি পূর্ব হতেই ছিলেন এবং পরেও চিরস্থায়ীভাবে থাকবেন। অতঃপর তিনি বলবেন, ‘আজ রাজত্ব কার?’ (সূরা গাফির - ১৬)
এ কথা তিনি তিনবার বলবেন। তারপর তিনি নিজেকেই নিজে উত্তর দিবেন : ‘(আজকে রাজত্ব হচ্ছে) এক আল্লাহর জন্যে তিনি মহাপরাক্রমশালী।’ (সূরা গাফির-১৬)
তিনিই আজ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যিনি প্রত্যেক জিনিসকে নিজের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। আজ তিনি সবকিছুকেই ধ্বংসের হুকুম দান করেছেন। তারপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় মাখলুককে দ্বিতীয়বার জীবিত করবেন। সর্বপ্রথম তিনি জীবিত করবেন হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে। তাঁকে আবার তিনি শিংগায় ফুৎকার দেয়ার নির্দেশ দিবেন। এটা হবে তৃতীয় ফুৎকার যার ফলে সমস্ত সৃষ্টজীব, যারা মৃত ছিল, জীবিত হয়ে যাবে, যার বর্ণনা এই আয়াতে দেয়া হয়েছে যে, আবার শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকাতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘এটাতো শুধু এক বিকট শব্দ, তখনই ময়দানে তাদের আবির্ভাব হবে।’ (আন নাযিয়াত : ১৩-১৪)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেন, ‘যেদিন আল্লাহ তোমাদেরকে আহ্বান করবেন সেই দিন তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে তার আহ্বানে সাড়া দিবে এবং তোমরা ধারণা করবে যে, দুনিয়ায় তোমরা অল্প দিনই অবস্থান করেছিলে।’ (সূরা ইসরা-৫২)
মহান আল্লাহ অন্য এক জায়গায় বলেন, ‘এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে তারই আদেশে আকাশ ও পৃথিবীর স্থিতি, অতঃপর আল্লাহ যখন তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে উঠাবার জন্যে একবার আহ্বান করবেন তখন তোমরা উঠে আসবে।’ (সূরা রুমণ্ড২৫)
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)কে বলেন ‘আপনি বলে থাকেন যে, এরূপ এরূপ সময়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে (তা কখন হবে?)।’ হযরত ইবনে উমার (রাঃ) তার এ কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, ‘আমার মন তো চাচ্ছে যে, তোমাদের কাছে কিছুই বর্ণনা করবো না। আমি তো বলেছিলাম যে, অল্প দিনের মধ্যেই তোমরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অবলোকন করবে। অতঃপর তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জাল আসবে এবং চল্লিশ পর্যন্ত অবস্থান করবে। চল্লিশ দিন না চল্লিশ মাস, না চল্লিশ বছর, না চল্লিশ রাত তা আমি জানি না। তারপর আল্লাহ তা'আলা হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন। তিনি আকৃতিতে হযরত উরওয়া ইবন মাসউদ (রাঃ)-এর সাথে খুবই সাদৃশ্যযুক্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিজয়ী করবেন এবং দাজ্জাল তার হাতে মারা পড়বে। এর পর সাত বছর পর্যন্ত লোক এমনভাবে মিলে-জুলে থাকবে যে, দুই ব্যক্তির মধ্যে কোন শত্রুতা থাকবে না। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা সিরিয়ার দিক হতে এক হালকা ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত করবেন, যার দ্বারা সমস্ত মুমিন ব্যক্তির জীবন কবয করে নেয়া হবে। এমনকি যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান রয়েছে সেও মরে যাবে, সে যেখানেই থাকুক না কেন। যদি সে পাহাড়ের গহ্বরেও অবস্থান করে তবুও ঐ বায়ু সেখানে পৌঁছে যাবে।’ আমি এটা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে শুনেছি। অতঃপর শুধুমাত্র মন্দ ও পাপী লোকেরাই বেঁচে থাকবে যারা হবে পাখী ও পশুর মত বিবেক-বুদ্ধিহীন। না তারা ভাল চিনবে না বুঝবে, না মন্দকে মন্দ বলে জানবে। তাদের উপর শয়তান প্রকাশিত হবে এবং সে তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের লজ্জা করে না যে, তোমরা মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করেছো?’ অতঃপর সে তাদেরকে মূর্তিপূজার নির্দেশ দিবে এবং তারা তখন ওগুলোর পূজা শুরু করে দিবে। ঐ অবস্থাতেও আল্লাহ তা'আলা তাদের রুযী-রোযগারে প্রশস্ততা দান করতে থাকবেন। তারপর শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। যার কানে এ শব্দ পৌঁছবে সে এদিকে পড়ে যাবে এবং ওদিকে দাঁড়িয়ে যাবে, আবার পড়বে। সর্বপ্রথম এই শব্দ যার কানে পৌঁছবে সে হবে ঐ ব্যক্তি যে তার হাউয বা চৌবাচ্চা ঠিকঠাক করতে থাকবে। তৎক্ষণাৎ সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। তারপর সবাই বেহুশ ও আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়বে। এরপর আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি বর্ষণ করবেন যা শিশিরের মত হবে, যার দ্বারা মানুষের দেহ উদগত হবে। তারপর দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন সবাই দণ্ডায়মান হয়ে তাকাতে থাকবে। অতঃপর তাদেরকে বলা হবে, ‘হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালকের দিকে চল।’ (আল্লাহ তা'আলা বলবেন) ‘তাদেরকে দাঁড় করাও, তারা জিজ্ঞাসিত হবে। তারপর বলা হবে, ‘জাহান্নামের অংশ বের করে নাও।’ জিজ্ঞেস করা হবে, ‘কত?’ উত্তরে বলা হবে, ‘প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জন।" এটা হবে ঐদিন যেই দিন (ভয়ে) বালক বৃন্ধ হয়ে যাবে এবং পদনালী খুলে যাবে। ‘পদনালী বা পায়ের গোছা উন্মোচিত হবে'।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ ‘দুই ফুঙ্কারের মাঝে চল্লিশের ব্যবধান থাকবে। জনগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবু হুরাইরা (রাঃ)! চল্লিশ দিন কি?" জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি (উত্তর দিতে) অস্বীকার করলাম। তারা বললোঃ ‘চল্লিশ বছর কি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি (এর উত্তর দিতেও) অস্বীকৃতি জানাচ্ছি।’ তারা জিজ্ঞেস করলোঃ ‘চল্লিশ মাস কি?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আমি (এর উত্তর দানেও) অস্বীকার করছি। কথা হলো এই যে, মানুষের দেহের) সব কিছুই সড়ে পচে নষ্ট ও বিলীন হয়ে যাবে। শুধুমাত্র মেরুদণ্ডের একটি অস্থি ঠিক থাকবে। ওটা দ্বারা সৃষ্টির পুনর্বিন্যাস করা হবে।’ (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সাঃ) বলেছেন, আমি হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এই আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার ইচ্ছায় যারা মূছিবত হবে না তারা কারা? উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেন, ‘তারা হলো শহীদ, যারা তরবারী লটকানো অবস্থায় আল্লাহর আরশের চতুর্দিকে অবস্থান করবে। ফেরেশতাবর্গ অভ্যর্থনা করে তাদেরকে হাশরের মাঠে নিয়ে যাবেন। তারা মণি-মানিক্যের উষ্ট্রের উপর সওয়ার হবে, যেগুলোর গদি রেশমের চেয়েও নরম হবে। মানুষের দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত হবে উষ্ট্রগুলোর এক কদম। তারা জান্নাতের মধ্যে পরম সুখে ও আরাম আয়েশের মধ্যে থাকবে। তারা বলবে, চল, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর সৃষ্টজীবের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করবেন তা আমরা দেখবো। সুতরাং তাদের দিকে দেখে আল্লাহ তা'আলা হেসে উঠবেন। যেখানে আল্লাহ পাক কোন বান্দাকে দেখে হাসেন সেখানে তার উপর কোন হিসাব নেই।’ (এ হাদীসটি আবু ইয়া’লা (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর সমস্ত বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। কিন্তু ইসমাঈল ইবনে আইয়াশ (রঃ)-এর উস্তাদ অপরিচিত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন) মহান আল্লাহ বলেন, বিশ্ব ওর প্রতিপালকের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, আমলনামা পেশ করা হবে এবং নবীদেরকে আনয়ন করা হবে। যাঁরা সাক্ষ্য দিবেন যে, তাঁরা নিজেদের উম্মতদের নিকট তাবলীগ বা প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন। আর বান্দাদের ভাল ও মন্দ কাজের রক্ষক ফেরেশতাদেরকে আনয়ন করা হবে এবং আদল ও ইনসাফের সাথে মাখলুকের বিচার মীমাংসা করা হবে। কারো উপর কোন প্রকারের অত্যাচার করা হবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লা প্রতিষ্ঠিত করবো এবং কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবে না। কোন আমল যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় তবুও আমি তা হাযির করবো এবং আমিই হিসাব নেয়ার জন্যে যথেষ্ট।’ (আম্বিয়া - ৪৭)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা অণু পরিমাণও অত্যাচার করেন না। যদি একটি পুণ্য হয় তবে তিনি তা বৃদ্ধি করে দেন এবং নিজের নিকট হতে তিনি বড় প্রতিদান প্রদান করেন।’ (সূরা নিসা - ৪০)
এজন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে বলেন, প্রত্যেককে তার ভাল-মন্দ কার্যের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে এবং তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সৃবিশেষ অবহিত।
হযরত ইস্রাফিল (আঃ) শিঙ্গা মুখে নিয়ে অপেক্ষায় আছেন যে, কখন আল্লাহর হুকুম হবে এবং আমি শিঙ্গায় ফুঁক দেবো। তার ফুঁক দেবার সাথে সাথেই সমস্ত জগত পর্যুদস্ত হয়ে যাবে, লন্ড-ভন্ড হয়ে পড়বে, সৃষ্টি জগতের মধ্যে আশ্চর্য ধরনের পেরেশানী দেখা দেবে। দ্বিতীয়বার ফুঁক দেবেন, তখন সমস্ত জগত ধ্বংস হয়ে যাবে, কয়েক জন ফেরেস্তা ছাড়া সৃষ্ট জগতে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আল্লাহু রাব্বুল ইজ্জত মালেকুল মউত কে বলবেন, এখন কে কে বাকী আছে, তিনি আরজ করবেন, জিব্রাঈল,মিকাঈল, ইস্রাফীল, আরশের বাহকগণ, এবং আমি। তখন মালেকুল মউত কে হুকুম দেয়া হবে যে, তাদের আত্মাও কবজ করে নাও, সুতরাং তাদের সবার রূহও হরন করে নেয়া হবে, তখন সৃষ্টি জগতের মধ্যে মালেকুল মউত ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। আল্লাহ্ তা'আলা বলবেন, মালেকুল মউত! এখন কে বাকী আছে? আরজ করবেন, এখন আপনি ছাড়া শুধু আমিই বাকী আছি। তখন হুকুম হবে, মালেকুল মউত! আমি ছাড়া সকলকে ধ্বংশ হতে হবে, সুতরাং তুমিও মরে যাও। অতএব জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে তিনি নিজেই নিজের রূহ্ কবজ করবেন এবং এমন এক চিৎকার দেবেন যে, যদি তখন মাখলূক জীবিত থাকতো, তাহলে তাঁর চিৎকারের ভীষণ আওয়াজে সবাই মরে যেত। তখন তিনি বলবেন, যদি আমার জানা থাকতো যে, মৃত্যুর সময় এত কষ্ট হয়, তাহলে মুমিনদের প্রাণ হরন করতে আমি আরো সহজ করতাম। এখন আল্লাহু রাব্বুল ইজ্জত ছাড়া আর কেউ নেই, তাই এখন তিনি আল্লাহ্ বলবেন- আজকে বাদশাহরা, শাজাদারা কোথায়? জালেমরা কোথায়, তাদের ঢেলারা কোথায়? ওরা কোথায়? যারা আমার খেত আর শয়তানের কাজ করত। আজকের রাজত্ব কার? সমস্ত জগত-ই তো ধ্বংস, জবাব দেবে কে? তাই আল্লাহ্ তা'আলা নিজেই বলবেন- আজকের রাজত্ব শুধু আল্লাহর। তিনিই এক এবং পরাক্রমশালী।
অতঃপর আসমান থেকে বীর্য্যের মত পানি বর্ষিত হবে, উদ্ভিদণ্ডঘাস-গাছরার মত মানুষের দেহ জমীন থেকে বেরুবে, অতঃপর হযরত ইস্রাফীল (আঃ)-কে জীবিত করা হবে, অনুরূপ হযরত জিব্রাঈল ও মীকাঈল আল্লাহিচ্ছালামকেও জীবিত করা হবে। তারপর ইস্রাফীল (আঃ) তৃতীয় বার শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন, ফলে সমস্ত মাখলুক জীবিত হয়ে যাবে। (সর্ব প্রথম হযরত রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত হবেন) সমস্ত মানুষ উলঙ্গ হবে এবং এক আজীমুশশান ময়দানে সমবেত হয়ে যাবে।
আল্লাহ্ তা'আলা মাখলুকের প্রতি মোটেও দৃষ্টিপাত করবেন না, তাদের ব্যাপারে ফায়সালাও করবেন না। মাখলুক কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যাবে, চোখের পানি নিঃশেষ হয়ে যাবে, পানির স্থলে রক্ত বের হতে থাকবে, এবং এত পরিমাণ ঘাম বেরুবে যে, অনেকের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এমন পরিনতিতে হিসাব শুরু করার সুপারিশ করানোর জন্যে মানুষ নবীগণ (আঃ)-এর কাছে যাবে, সকলের অস্বীকার করার পর অবশেষে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর কাছে আসবে। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন, তারপর হিসাব-নিকাশ শুরু হবে।
ফেরেশতাগণ কাতার বন্ধী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন, বলা হবে, সকলের আমল (কৃতকার্য) আমল নামায় লিখা আছে। যে ব্যক্তির ভাল আমল লিখা দেখবে, সে যেন আল্লাহর শুকরীয়া আদায় করে, আর যে ব্যক্তি খারাপ আমল লিখা দেখতে পাবে, সে যেন নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে।
মানুষ ও জ্বিন ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদেরকে একে অপরের প্রতিশোধ করিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে। সেদিনকার দিনে টাকা পয়সার জরিমানা থাকবে না, বরং জালেমের নেকী মজলূমকে দিয়ে দেয়া হবে, নেকী শেষ হয়ে গেলেও যদি হক বাকী থাকে, তাহলে মজলূমের গুণাহ জালেমের মাথায় স্তুপ দিয়ে দেয়া হবে, যদ্দরুন অবস্থা এই দাঁড়াবে যে, অনেক বড় জালেম ব্যক্তির কাছে একটি নেকীও তখন থাকবে না, ফলে জালেমকে জাহান্নামে এবং মজলুমকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
এত ভয়াবহ কঠিন দিন হবে যে, নৈকট্যশীল ফেরেশতা, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুচ্ছালাম ও শোহাদা (রাঃ) গণ পর্যন্ত নিজেদের নাজাতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হয়ে পড়বেন।
পূর্ণ জীবন, যৌবন, মাল-সম্পদ ও এলম প্রতিটির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। মানুষ নেকীর তালাশে পিতা-পুত্র-বিবি প্রমূখ গণের কাছে যাবে, কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে আসবে।
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত জিব্রাঈল (আঃ) হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর খেদমতে এমনভাবে আসলেন যে ভয়ের কারণে তাঁর চেহারার রঙ পরিবর্তন ছিল। ইতিপূর্বে কখনো এমন অবস্থায় আসেন নি। হযরত রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমালেন, জিব্রাঈল! আজ কী ব্যাপার, তোমার চেহারার রঙ পরিবর্তন কেন? আরজ করলেন, আজ জাহান্নামের এমন অবস্থা দেখে আসছি যে, যে কারোর এটা বিশ্বাস হবে, সে ততক্ষণ পর্যন্ত ধীর স্থির থাকতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজেকে এটা থেকে হেফাজত করে নেবে।
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমালেন, জিব্রাঈল! কিছু আমাদের কাছেও বর্ণনা কর। তিনি (আঃ) বললেন, আচ্ছা, তাহলে শুনূন! আল্লাহ্ তা'আলা জাহান্নামকে সৃষ্টি করে এক হাজার বছর পর্যন্ত দাহ করলেন, ফলে এটা লাল হয়ে গেল। অতঃপর হাজার বছর প্রজ্জলিত করলেন, ফলে সাদা হয়ে গেল, তারপর হাজার বছর পর্যন্ত দাহ্ করলেন, যদ্দরুন কালো হয়ে গেল, অতএব এখনো এটা সম্পূর্ণ কালো ও অন্ধকার আছে। এটার শিখা ও আঙ্গরা কখনো স্থিমিত হয় না। আল্লাহর কসম, যদি সুঁই-এর ছিদ্র পরিমাণ জাহান্নাম খুলে দেয়া হয়, তাহলে সমস্ত জগত পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে।
যদি কোন দোজখীর বস্ত্র আসমান ও জমিনের মাঝখানে লঠকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে এটার দুর্গন্ধ ও তেজসক্রিয়ায় সমস্ত সৃষ্টিই ধ্বংশ হয়ে যাবে।
পবিত্র কুরআনে যে সমস্ত শিকল বা জিঞ্জিরের কথা উল্লেখ আছে, তন্মধ্যে যদি মাত্র একটি জিঞ্জির কোন পাহাড়ে রেখে দেয়া যায়, তাহলে তা গলে পাতাল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। যদি দুনিয়ার পূর্ব প্রান্তে কাউকে জাহান্নামের আজাব দেয়া যায়, তাহলে এটার ভয়াবহতায় পশ্চিম প্রান্তের অধিবাসীগণ কাঁপতে থাকবে। যার তেজসক্রিয়া খুবই তীব্র ও কঠিন এবং গভীরতা অন্তহীন আর এখানের অলংকার হবে লোহার, পানি হবে উত্তপ্ত পুঁজ এবং কাপড় হবে আগুনের। এটার সাতটি দরজা থাকবে, প্রত্যেক দরজা দিয়ে নির্ধারিত নারী-পুরুষ প্রবেশ করবে।
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ওগুলো কি আমাদের ঘরের দরজার মত হবে? আরজ করলেন, না, বরং এগুলো স্তর বিশিষ্ট হবে এবং খোলা থাকবে। দু'দরজার মাঝখানে সত্তর বছরের রাস্তার দূরত্ব সম হবে। প্রত্যেক দরজা একটি অপরটি থেকে সত্তর গুণ বেশী গরম, উত্তপ্ত হবে।
আল্লাহ্’র দুশমন, (অবাধ্যদেরকে) তাড়িয়ে ঐ দরজা সমূহের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, যখন দরজা পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন তাদেরকে জিঞ্জির (শিকল)দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে, মুখে জিঞ্জির ঢুকিয়ে গুহ্যদ্বার দিয়ে বের করা হবে, অনুরূপ হাত-পা বেঁধে দেয়া হবে।
প্রত্যেকের সাথে শয়তানও (যাদেরকে ওরা খোদা মনে করত) থাকবে, উপুড় করে হেঁচড়িয়ে ফেরেস্তারা লোহার হাতুড়ী দিয়ে পিটাতে পিটাতে জাহান্নামে ঢুকাবে। তথা থেকে যন্ত্রনায় কাতর হয়ে যখনই বেরুতে চাইবে, তখনই আবার ফেরৎ ঢুকিয়ে দেয়া হবে।
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন যে, ঐ দরজা সমূহে কোন ধরনের লোকেরা থাকবে তথা প্রবেশ করবে! আরজ করলেন, সর্বনিম্ন দরজায় (স্তরে) মুনাফিক, আল্লাহদ্রোহী, ও ফেরআউনেরা থাকবে, সে স্তরের নাম হলো, হাবীয়া দ্বিতীয় স্তরের নাম হলো জাহীম, এতে মুশরীকরা থাকবে, তৃতীয় স্তর হলো ছাক্কার, তাতে ধর্মদ্রোহীরা থাকবে, চতুর্থ স্তরে ইবলিশ ও তার অনুসারীরা থাকবে, এটার নাম লাজা। পঞ্চম স্তর হুতামা, এতে ইহুদীরা এবং ষষ্ঠ স্তর-সায়ীর-এ নাসারারা থাকবে, অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) চুপ হয়ে গেলেন। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, চুপ হয়ে গেলেন কেন? সপ্তম স্তরে কারা থাকবে? বলুন। হযরত জিব্রাইল (আঃ) কাকুতি-মিনতি ভরে বললেন, তথায় আপনার উম্মতের সেই সমস্ত লোকেরা থাকবে, যারা গুনাহে কবীরাহ করেছে এবং তওবা ছাড়া মরেছে। একথা শুনে হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহ্য করতে না পেরে বেঁহুশ হয়ে গেলেন। (আমার মা-বাবা তার জন্যে উৎসর্গ হোক) হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তাঁর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুবারক নিজ কোলে নিয়ে নিলেন। যখন তিনি সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুঁশে আসলেন, তখন বললেন, জিব্রাঈল! আমি বড়ই পেরেশানী ও চিন্তায় পড়ে গেছি। আমার উম্মতেরও কি কোন লোক কে আগুনে ফেলা হবে? আরজ করলেন, জী হ্যাঁ! যদি কবীরাহ গুনাহ কারী ব্যক্তি তওবা ব্যতিত মরে যায়। একথা শুনে হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁদতে লাগলেন।
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে তাশরীফ নিয়ে গেলেন আর মানুষের সাথে মেলা-মেশা ছেড়ে দিলেন, শুধু নামাজের জন্যে তাশরীফ আনতেন এবং কারো সাথে কথা-বার্তা না বলেই ঘরে চলে যেতেন। অবস্থা এই ছিল যে, কাঁদতে কাঁদতে নামাজ শুরু করতেন এবং ক্রন্দন রত অবস্থায়ই নামাজ শেষ করতেন। তৃতীয় দিবসে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) দরজায় হাজির হয়ে সালাম করলেন এবং প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, কিন্তু ভিতর থেকে কোন জবাব না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন অনুরূপ হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-ও আসলেন এবং এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন। ইত্যবসরে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)-ও এসে ফিরে গেলেন, তিনিও কোন উত্তর না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। কখনো বসেন, কখনো দাঁড়িয়ে ফেরত যান আবার ফিরে আসেন। এ অবস্থায় তিনি হযরত ফাতেমা জাহরা (রাঃ) এর দরজায় গিয়ে পৌছে গেলেন এবং সমস্ত ঘটনা শুনিয়ে দিলেন। হযরত ফাতেমা (রাঃ) শুনা মাত্রই পেরেশান হয়ে গেলেন এবং তৎক্ষনাৎ চাঁদর মুড়ি দিয়ে সোজা দরবারে নববীর দিকে রওয়ানা হলেন। দরজায় পৌঁছে সালামের পর আরজ করলেন যে, আমি ফাতেমা! তখন হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় পড়ে নিজ উম্মতের জন্যে কাঁদছিলেন। মাথা মুবারক উঠিয়ে বললেন, আমার চোখের শান্তি ফাতেমা! কি অবস্থা? (কেন এসেছো, এই বলে) ঘরের লোক জনকে বললেন, দরজা খুলে দাও। হযরত ফাতেমা (রা) ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। তখন তিনি তার সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থা দেখে তুমূল ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়লেন এবং খুবই কাঁদলেন।
তিনি দেখলেন যে, তার (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে, রং হলদে বর্ণ হয়ে গেছে, চেহারার ঔজ্জ্বল্য মুছে গেছে। জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ'র রাসূল (সাঃ)! আপনার কী পেরেশানী? আর আপনি কোন কথার চিন্তায় এত পেরেশান হয়েছেন। যাদ্দরুন আপনার এই দশা? এরশাদ করলেন, ফাতেমা! আমার কাছে জিব্রাঈল (আঃ) এসেছিলেন, তিনি আমার কাছে জাহান্নামের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, সবচে উপরের স্তরে আমার উম্মতের কবিরা গুনাহ্কারীরা থাকবে। এ চিন্তায় আমার এ অবস্থা হয়ে গেছে। হযরত ফাতেমা (রাঃ) আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! তাদেরকে কী ভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে? ফরমালেন, ফেরেশতারা তাদেরকে জাহান্নামের দিকে টেনে-হেঁচরিয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু তাদের চেহারা কালো হবে না, চোখ নীলাভ বর্ণও হবেনা, না তাদের মুখে মোহর লাগবে, না তাদের সাথে শয়তান হবে, তাদেরকে জিঞ্জির দ্বারাও বাঁধা হবে না। হযরত ফাতেমা (রাঃ) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহ তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ফেরেস্তারা কী ভাবে টানবে?
ফরমালেন পুরুষদের দাঁড়ি ধরে, মেয়েদের চুলের বেনী ধরে টেনে নেয়া হবে। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সবাই নিজেদের এহেন অপমান-অপদস্তের কারনে ডাক-চিৎকার করতে থাকবে। এ অবস্থায় যখন জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন জাহান্নামের দারোগা ফেরেশতাদের বলবেন, এরা কারা?
তাদের অবস্থা তো ভিন্নরূপ, আশ্চর্য ধরনের। তাদের চেহারাও কালো নয়, চোখও নীল নয়, বাকশক্তিও রুদ্ধ নয়, শয়তানও সঙ্গে নেই, গ্রীবাদেশেও বন্ধন নেই এবং জিঞ্জির দিয়েও বাঁধা নেই। ফেরেস্তাগণ বলবেন, আমরা কিছু জানিনা, আমরা হুকুম মোতাবিক তাদেরকে আপনার পর্যন্ত পৌছে দিলাম। তখন জাহান্নামের দারোগা তাদের বলবেন, আরে বদ বখতের দল! তোরাই বল যে তোরা করা? (এক বর্ণনায় আছে যে ওরা রাস্তায় ‘হায় মুহাম্মদ, হায় মুহাম্মদ’ বলতে বলতে যাবে কিন্তু জাহান্নামের দারোগাকে দেখা মাত্র হুজুর পাক (সাঃ)-এর নাম ভুলে যাবে) ওরা বলবে, আমরা তারাই, যাদের উপর কুরআন নাযিল হয়েছিল এবং রামাযানের রোজা ফরজ করা হয়েছিল। দারোগা বলবেন-কুরআন তো শুধু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর উপর নাযিল হয়েছিল। তখন তার (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম মুবারক শুনা মাত্রই চিৎকার করে বলবে, আমরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর উম্মত। দারোগা বলবেন, পবিত্র কুরআনে কি আল্লাহর নাফরমানী সম্পর্কে তোমাদেরকে ভয় দেখানো হয় নাই? (সে মুহুর্তে) তারা জাহান্নামের দরজায় আগুন দেখে দারোগার কাছে আবেদন করবে, আমাদেরকে নিজেদের উপর কেঁদে নিতে দিন । সুতরাং (তখন) কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শেষ হয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যাবে।
তখন দারোগা বলবেন, আফসোস! এ কান্না যদি দুনিয়ায় হতো, তাহলে আজ এ অবস্থা হতো না। (তখন) দারোগার হুকুমে তাঁদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দেয়া হবে। তখন সবাই সমস্বরে চীৎকার দিয়ে বলবে- 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এটা শুনে আগুন ফিরে যাবে,দারোগা আগুনের কাছে ফিরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আগুন বলবে, আমি তাদেরকে কিভাবে ধরবো, যেখানে তাদের জবানে কালেমায়ে তাওহীদ জারী আছে। এমনটি কয়েকবার হবে।
অতঃপর দারোগা মালেক বলবেন, আল্লার হুকুম এটাই, তখন তাদেরকে আগুন ধরবে এবং কাউকে পা পর্যন্ত, কাউকে হাটু পর্যন্ত, কাউকে কোমর পর্যন্ত, আর কাউকে গলা পর্যন্ত ধরবে। যখন আগুন চেহারার দিকে আসবে, তখন দারোগা বলবেন, তাদের চেহারা ও হৃদয়কে জ্বালাবে না, কেননা তারা দুনিয়ায় নামাজে সেজদা করেছে, রমজানের রোজা রেখেছে। সুতরাং যতক্ষণ আল্লাহ্'র ইচ্ছা, ততক্ষণ এরা নিজেদের গুনাহর শাস্তিতে জাহান্নামে পড়ে থাকবে এবং বার বার আল্লাহ্কে (ইয়া হান্নানু, ইয়া মান্নানু, ইয়া আর- হামার রাহেমীন বলে) ডাকতে থাকবে।
অবশেষে একদিন আল্লাহু রাব্বুল উজ্জত হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে বলবেন, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার খবর নাও তো, দেখ! তাদের কি অবস্থা? তিনি (তখনি) দৌঁড়ে দোজখের দারোগার কাছে পৌঁছবেন, দারোগা তখন জাহান্নামের মধ্যস্থলে আগুনের মঞ্চে উপবিষ্ট থাকবেন। জিব্রাঈল (আঃ)-কে দেখা মাত্রই তিনি অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে যাবেন এবং আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করবেন। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বলবেন, আমি উন্মাতে মোহাম্মাদীয়ার অবস্থা দেখতে এসেছি, তাদের কি অবস্থা? তিনি জবাব দেবেন, বড়ই খারাপ অবস্থা, সংকির্ণ জায়গায় পড়ে আছে, আগুনে তাদের শরীর জ্বালিয়ে দিয়েছে, তাদের গোশত খেয়ে ফেলেছে, শুধু চেহারা এবং হৃদয়টা বাকী আছে যেখানে ঈমান চমকাচ্ছে, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বলবেন, একটু আমাকেও দেখান।
হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে দেখা মাত্রই লোকেরা বুঝে ফেলবে যে, ইনি আজাবের ফেরেশতা নন, এত সুন্দর চেহারা আজ পর্যন্ত কখনো দেখিনি।
তাদেরকে বলা হবে যে, ইনি হযরত জিব্রাঈল (আঃ), যিনি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর কাছে ওহী নিয়ে যেতেন। এ লোকেরা এই মুবারক নাম শূনা মাত্রই চীৎকার করে বলতে থাকবে : হে হযরত জিব্রাঈল (আঃ)! আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর দরবারে আমাদের সালাম বলবেন, আর এটাও বলে দেবেন।
যে, আমাদের গুনাহ আমাদেরকে আপনার থেকে পৃথক করে দিয়েছে এবং বরবাদ করে দিয়েছে। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) ফিরে এসে আল্লাহু রাব্বুল কারীম এর দরবারে পুরা ঘটনা শুনাবেন। আল্লাহ্ তা'আলা ফরমাবেন, জিব্রাঈল! তারা তোমার কাছে কিছু বলেছে? বলবেন, জী হ্যাঁ! হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর কাছে তাদের সালাম পেশ করতে এবং নিজেদের ধ্বংসাত্মক অবস্থা বর্ণনা করতে বলেছে। তখন হুকুম হবে, যাও! তাদের পয়গাম পৌছিয়ে দাও। এ হুকুম শুনা মাত্রই হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তৎক্ষণাৎ হুজুর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা- আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডএর খেদমতে আসবেন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলাআলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন সাদা মূতির তৈরী এমন একটি মহলে আরাম করতে থাকবেন, যার চার হাজার দরজা হবে, প্রত্যেক দরজার উভয় পার্শ্ব স্বর্ণের হবে।
জিব্রাঈল (আঃ) সালাম শেষে আরজ করবেন, আমি আপনার গুনাহ্গার উম্মতদের কাছ থেকে এসেছি, তারা আপনাকে ছালাম বলেছে এবং নিজেদের ধ্বংস ও দুর্বিসহ অবস্থার কথা আপনার কাছে পৌঁছাতে বলেছে (তারা নিতান্তই দুঃখণ্ডকষ্টে নিমজ্জিত আছে) হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা শুনা মাত্রই আরশের নীচে যেয়ে সেজদায় পড়ে যাবেন এবং আল্লাহ্ পাকের এমন প্রশংসা করবেন, যা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগে কেউই এমন ভাষায় প্রশংসা করতে পারে নাই। তখন আল্লাহ পাকের হুকুম হবে যে, মাথা উঠান! বলুন, কি চান! অবশ্যই দেয়া হবে, যদি কারো সম্পর্কে সুপারিশ করতে চান, তাহলে সুপারিশ করুন, মঞ্জুর করা হবে।
তখন আল্লাহ্'র দরবারে হুজুর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরজ করবেন, হে আমার পরওয়ারদেগার! আমার গুনাহ্গার উম্মতের উপর আপনার হুকুম জারী হয়েছে, তাদের গুনাহর শাস্তি দেয়া হয়েছে, এখন তাদের ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।
এরশাদ হবে, আমি আপনার সুপারিশ কবুল করে নিলাম, আপনি নিজে তাশরীফ নিয়ে যান এবং জাহান্নাম থেকে প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে বের করে আনেন, যে ব্যক্তি— লা ইলাহা ইল্লাহ" পড়েছিল। সুতরাং হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহান্নামের দিকে যাবেন।
দোজখের দারোগা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডকে দেখামাত্রই সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাবেন। হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম দারোগার কাছে বলবেন, মালেক! আমার গুনাহগার উম্মাতের কী অবস্থা? তিনি বলবেন, খুবই খারাপ অবস্থা। তিনি সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোজখের দরজা খোলার হুকুম দেবেন। যেই মাত্র জাহান্নামীরা হুজুর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামণ্ডকে দেখবে, তখনই চীৎকারে ফেটে পড়বে, বলবে- ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! আমাদের চামড়া, কলিজা সব আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকলকে বের করবেন, সবাই কয়লার মত কালো হয়ে থাকবে, এ অবস্থায় তিনি সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জান্নাতের দরজায় বিদ্যমান ‘নরে রেজওয়ান" এ গোছল দেবেন। এতে তারা গোছল করে সুন্দর যুবক হয়ে যাবে। চেহারা চাঁদের মত চমকাতে থাকবে, কপালে লেখা হবে-"আল জাহান্নামি ও না ইত্তিক ইর রহমান (এরা মেহেরবান আল্লাহ্’র মুক্ত করা জাহান্নামী’) অতঃপর তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হবে। অবশিষ্ট জাহান্নামী পরিতাপ করে বলবে, আফসোস! আমরাও যদি মুসলমান হতাম, তাহলে তো আজ আমাদেরকেও তাদের মত দোজখ থেকে বের করিয়ে নেয়া হত। এটাই পবিত্র কুরআন ঘোষনা করছে- ‘অনেক কাফের (সেদিন) আকাংখা করবে যে, তারাও যদি মুসলমান হতো’ । অতঃপর মৃত্যু কে একটি ভেড়ার আকারে এনে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের সামনে জবেহ্ করে দেয়া হবে এবং উভয়কে বলে দেয়া হবে যে, এখন থেকে আর কারো মরণ হবেনা, যে সেখানে আছে, সে সেখানেই চিরকাল থাকবে।(তাম্বিহুল গাফিলীন) আল্লাহুম্মা আজিরনা মিনার নার ইয়া মুজিরু ইয়া মুজিরু ইয়া মুজিরু।
লেখক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।