প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
নারী শব্দটির প্রতি অনায়াসে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। কারণ এই নারী কারও মা, কারও বোন, কারও স্ত্রী, কারও দাদি-নানি, কারও খালা-ফুফি ইত্যাদি। অথচ এ নারীর প্রতিই তথাকথিত আধুনিক সমাজব্যবস্থায় নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়। এহেন নির্মমতা থেকে নারীকে উদ্ধার করা সময়ের প্রয়োজনেই অপরিহার্য। ইসলাম নারীমুক্তির সময়োপযোগী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ইসলাম নারীর শিক্ষা অর্জনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করেছে। এমনকি ইসলামি শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে পুরুষের মতো শ্রমণ্ডসাধনা করায় নারীর সমান অংশগ্রহণের অনুমতিও রয়েছে।
ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা, যেখানে নারীরা তাদের মানমর্যাদা ও ইজ্জত-আবরু হেফাজতের নিশ্চয়তা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে ঘোষণা করেছে কার্যকর দিকনির্দেশনা। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমের নির্দেশনাগুলো তুলে ধরা হলো-
১. নারীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি : ইসলাম নারীর সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করেছে। রাস্তায়, কর্মস্থলে ও যত্রতত্র নারীদের হয়রানি করা তো দূরের কথা বরং ইসলাম নারীদের সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি দিতেও কঠোর নির্দেশ দেয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘হে রাসুল! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।’ (সুরা নূও, আয়াত ৩০)
অন্যদিকে কেউ যেন নারীকে হয়রানি না করে সে জন্য নারীকে বোনের দৃষ্টিতে দেখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেছেন- ‘নারীরা পুরুষদের সহোদরা বোন।’ (সুনানু আবি দাউদ)
২. ব্যভিচার-ধর্ষণ-অপবাদ রোধের ঘোষণা : ইসলাম ব্যভিচার, দেহব্যবসা, নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও দেহপ্রদর্শনীকে নিষিদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, ইসলামে নারীকে ধর্ষণ করা কিংবা ধর্ষণের চেষ্টা করা, ইভটিজিং তথা উত্ত্যক্ত করা এবং নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার অত্যন্ত ভয়াবহ শাস্তি ঘোষণা করেছে। যাতে খারাপ চিত্তের পুরুষগণ এসব অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বিরত থাকে। একাধিক আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩২)
‘তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতার কাছেও যেও না।।’ (সুরা আনয়াম, আয়াত ১৫১)
‘যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’ (সুরা নূর, আয়াত ১৯)
‘যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহকালে ও পরকালে ধিকৃত এবং তাদের জন্যে রয়েছে গুরুতর শাস্তি।’ (সুরা নূর, আয়াত ২৩)
৩. নারীর অধিকার বাস্তবায়নের নির্দেশ : ইসলাম নারীকে দিয়েছে সম্পদের অধিকার। এ অধিকার আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক নির্ধারিত। চাইলে যে কেউ নারীকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার ইসলাম দেয়নি। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন, একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান।’ (সুরা নিসা, আয়াত ১১)
এ আয়াতে নারী ক্ষেত্র বিশেষ যেমন পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে; আবার ক্ষেত্র বিশেষ নারীর সমান অর্ধেক সম্পত্তিও পাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর নারীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঘোষণা করেছে ইসলাম।
৪. দেনমোহর দেওয়ার নির্দেশ : নারীর দেনমোহরের অধিকার সম্পর্কেও ইসলাম সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘হে নবি! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদের আপনি দেনমোহর প্রদান করেন।’ (সুরা আহজাব, আয়াত ৫০)
দেনমোহর সম্পর্কে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশি মনে।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৪)
৫. নারীর প্রতি নির্যাতন নয় : নারীকে যে কোনো ছুঁতোয় দৈহিকভাবে কিংবা মানসিকভাবে নির্যাতন করা ইসলামি শরিয়তে বৈধ নয়। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জীবনে তার কোনো স্ত্রী কিংবা কন্যার গায়ে হাত তোলেননি।
বাসা-বাড়িতে কর্মরত কাজের মেয়ে কিংবা বুয়ারাও ক্রীতদাসী নয়। ইসলামে ক্রীতদাস প্রথাবিলোপ করা হয়েছে। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাস-দাসীদের ব্যাপারে বিশেষ নসিহত পেশ করেছেন-
‘তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান! তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান! তোমাদের দাসদাসীদের ব্যাপারে সাবধান! তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে এবং তোমরা যা পরবে তাদেরকে তা পরতে দেবে।’ (মুসনাদ আহমাদ, আত তাবাকাত আল কুবরা)
৬. নারীকে অপবাদ দেওয়ার শাস্তি : নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’য়ালা এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এভাবে- ‘যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতঃপর স্বপক্ষে চার জন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে।’ (সুরা নূর, আয়াত ৪)
৭. তালাকের অপব্যবহার রোধ : স্বামী-স্ত্রীর অস্বস্তিকর জীবনের সুন্দর সমাধানের জন্য ইসলাম তালাকের বিধান রেখেছে। স্বামীর হাতে যদিও তালাকের প্রাথমিক অধিকার ন্যস্ত হয়েছে, কিন্তু সে অধিকার অন্যায়ভাবে প্রয়োাগ করাও ইসলামি শরিয়তে আরেকটি অন্যায় ও গোনাহের কাজ হিসেবে বিবেচিত।
মনে রাখা জরুরি, বিয়ে যেভাবে সামাজিক সমঝোতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে ঠিক তেমনি তালাকও উভয়ের বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয় ইসলাম। এ ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনা হলো এমন- ‘যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত।’
(সুরা নিসা, আয়াত ৩৫)
অতঃপর করণীয় কী হবে? এ সম্পর্কেও আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
‘তালাকে-‘রাজঈ’ হলো- দু’বার পর্যন্ত। তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে। আর তাদের কাছ থেকে নিজের দেওয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেওয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না; অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবে উভয়ের মধ্যে কারওরই কোনো পাপ নেই। এ হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করবে, তারাই জালেম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২২৯)
৮. পরকালের জবাবদিহিতা : প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেককেই তার কাজের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সুতরাং যে বা যারা নারী নির্যাতন করে থাকে; তাদের এ কথা স্মরণ রাখা জরুরি যে, এ নির্যাতনের জন্য অবশ্যই তাকে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আর এ জবাবদিহিতাই মানুষকে নারী নির্যাতনসহ যে কোনো অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে। জবাবদিহিতা থাকলে নারী-পুরুষ সবাই উত্তম চরিত্রের মুসলিমে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স। ০১৭১১ ৩৩৩৯৯৬