প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমাদ রেজা খান ফাযেলে বেরলভী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মহান অস্তিত্ব কারো পরিচয়ের মুখাপেক্ষী নয়। তিনি স্বয়ং কামালাত ও ফাযালাতের সূর্য। উদিত সূর্যের খবর যেমনি সর্বজনসহ অন্ধজনও দিতে সক্ষম তেমনি কুত্ববুল আওলিয়া, শায়খুল মাশাইখ ও বেলায়ত দানকারী আ’লা হযরত আজীমুল বারাকাত, ইমামে আহলে সুন্নাত-এর অগণিত দ্বীনী দেখমতের অমর অবদান সূর্যের ন্যায় বিস্তৃত ও জ্ঞাত। বরকতময় নাম আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু এর শুভ জন্মকালীন নাম ‘মুহাম্মদ’ আর ঐতিহাসিক নাম ‘আল মুখতার’। কিন্তু আপন দাদাজান মাওলানা রেজা আলী খাঁন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর নাম নির্ধারণ করেন আহমাদ রেজা। পরবর্তীতে তিনি নিজেই নিজ নামের সাথে ‘আব্দুল মুস্তফা’ সংযোগ করেন। তিনি বংশীয় পর্যায়ে ‘পাঠান’, মাযহাবের দিক থেকে হানাফী ও ত্বরিকার দিক থেকে ক্বাদেরী ছিলেন।
শুভজন্ম : তাঁর সৌভাগ্যময় জন্ম সময় ১০ই শাওয়াল-ই মুকাররম, ১২৭২ হিজরি মোতাবেক ১৪ জুন ১৮৫৬ ইংরেজী, রোজ শনিবার যোহরের সময়। আর জন্মস্থান হল ভারতের প্রসিদ্ধ নগরী বেরেলী শরীফে (ইউ.পি)’র জাসুলী মহল্লায়। আ’লা হযরত নিজের জন্ম সন কোরআন মসজিদের আয়াত থেকে বের করেছেন। অর্থাৎ ১২৭২ হিজরির তত্ত্ব সন্ধানে বর্ণিত আয়াত শরীফ-অর্থ তাঁরা হলো ওই সব লোক যাদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা ঈমানকে অংকন করে দিয়েছেন এবং নিজ পক্ষ থেকে রুহ্ দ্বারা তাঁদেরকে সাহায্য করেছেন। এ কথা যথার্থ যে, আ’লা হযরত ওই সব খাস বান্দার অন্তর্ভূক্ত, মহান আল্লাহ যাদের অন্তরে ঈমানের নক্শা এঁকে দিয়েছেন। তাঁর আপদমস্তক আল্লাহর ইশক ও নবীজির মহাব্বতে ডুবন্ত ছিল। তিনি বলতেন, আল্লাহর শপথ ! ‘যদি আমার অন্তরকে দু’টুকরো করা হয় তবে দেখা যাবে যে, এক টুকরোর উপর লিখা আছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, অপর টুকরোর উপর লিখা আছে মুহাম্মাদুর রাছূলুল্লাহ।
বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের অগণিত লোক, যাঁদের মধ্যে অনেক আলিম, ফাজিল ও মাশাঈখও রয়েছেন যে, ১২৭২ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু আপনি যদি আ’লা হযরতের জীবনের প্রতি একটু গভীর দৃষ্টিপাত করেন তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠবেন (১২৭২ হিজরির) এর অলৌকিক মুকুট আ’লা হযরতের পবিত্র শিরে সত্যিই শোভা পাচ্ছে।
বংশীয় পরিচয় : আ’লা হযরত শাহ্ ইমাম আহমাদ রেজা খাঁন। তাঁর পিতা হযরত মাওলানা শাহ্ নক্বী আলী খাঁন তাঁর পিতা হযরত মাওলানা শাহ রেজা আলী খাঁন, তাঁর পিতা হযরত মাওলানা হাফিজ শাহ্ কাজিম আলী খাঁন, তাঁর পিতা হযরত মাওলানা শাহ্ মুহাম্মদ আজম খাঁন, তাঁর পিতা হযরত মাওলানা শাহ্ সা’আদাত ইয়ার খাঁন, তাঁর পিতা হযরত মাওলানা শাহ্ সাঈদ উল্লাহ্ খাঁন (রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহিম আজমাঈন)। আ’লা হযরতের পূর্ব পুরুষ অর্থাৎ হযরত মাওলানা শাহ্ সাঈদ উল্লাহ খাঁন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি মুঘল শাসনামলে লাহোর পদার্পণ করেন এবং সেখানে তিনি বিভিন্ন সম্মানিত পদে অলংকৃত হন।
হযরতের জ্ঞান অর্জন : আ’লা হযরত পরিবারে পারিবারিক ঐতিহ্য-রেওয়াজ অনুযায়ী বিছমিল্লাহ্খানী তথা বিছমিল্লাহ শরীফের আনুষ্ঠানিক ছবক হত। বিছমিল্লাহ শরীফের ছবক গ্রহণকালে হযরতের বয়স কত ছিল বিশুদ্ধভাবে বলা মুশকিল। তবে ছবক গ্রহণ সময়ের বয়স এভাবে অনুমান করা যায় যে, তিনি মাত্র চার বৎসর বয়সেই পবিত্র কুরআনের নাজেরা খতম করেছিলেন।
হযরতের মুখস্ত শক্তি : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহ তা’য়ালা আনহু এর মুখস্ত শক্তির অবস্থা এমন ছিল যে, একদিকে ওস্তাদ ছবক দেন অপরদিকে তিনি এক দুবার পড়েই কিতাব বন্ধ করে দিতেন। যখন ওস্তাদ ছবক শুনতেন তখন পুংঙ্খানুপুংঙ্খভাবে তা শুনিয়ে দিতেন। ওস্তাদ এ অবস্থা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে বলতেন যে, হে ‘আহমাদ মিয়া’ তুমি মানব না জ্বীন যে, আমি পড়াতে দেরী কিন্তু তোমার শুনাতে বিলম্ব হয় না। বস্তুতঃ এ উক্তিটি ওস্তাদের দোয়া স্বরূপই ছিল। একদিন আ’লা হযরত বললেন, অনেকেই না জেনে আবেগ প্রবণ হয়ে আমার নামের সাথে ‘হাফিজ’ শব্দটি যুক্ত করে দেয়, অথচ আমি হাফিজ নই। তবে এটা সম্ভব যে, কোনো হাফিজ সাহেব যদি আমাকে কুরআন কারীমের এক রুকু’ করে পড়ে শুনান তাহলে অনুরূপ আমার থেকে মুখস্ত শুনানো সম্ভব হবে। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক মাহে রমজানে একজন হাফিজ সাহেবের সান্নিধ্যে মাত্র ২৩ দিনে ৩০ পাড়া কোরআন শরীফ মুখস্ত করে শুনিয়েছেন। আর হিফজ করার সময়টুকু হিসাব করলে মাত্র ১৫ ঘন্টা হয়। (সুবহানাল্লাহ্!)
পাঠ্য জ্ঞানের সমাপ্তি : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রাথমিক উর্দ্দু, ফার্সী ভাষার কিতাবাদী অধ্যয়নের পর আরবী ভাষায় ছরফ-নাহু এর কিতাব সমূহ মীর্যা গোলাম ক্কাদীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সান্নিধ্যে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর নিজ পিতা আলেমকুল সম্রাট হযরত মাওলানা শাহ্ নক্কী আলী খাঁন (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর সান্নিধ্যে নিম্নোক্ত জ্ঞানকোষ সমূহের উপর বিদ্যা অর্জন করেন। (১) ইলমে কুরআন, (২) ইলমে তাফছীর, (৩) ইলমে হাদীছ, (৪) উসূলে হাদীছ, (৫) হানাফী ফিকহের কিতাবাদী, (৬) শাফেঈ ফিক্হের কিতাবাদী, (৭) মালেকী ফিকহের কিতাবাদী, (৮) হাম্বলী ফিকহের কিতাবাদী, (৯) উসূলে ফিক্বহ, (১০) জাদাল-ই মাযহাব, (১১) ইলমে আকাইদ ও কালাম, (১২) ইলমে নাহভ, (১৩) ইলমে ছরফ, (১৪) ইলমে মা’আনী, (১৫) ইলমে বয়ান, (১৬) ইলমে বদী, (১৭) ইলমে মানতিক, (১৮) ইলমে মুনাজারাহ, (১৯) ইলমে কানসাকাহ্ মুদাল্লাসাহ্, (২০) ইবতিদায়ী ইলমে তাকছীর, (২১) ইবতেদায়ী ইলমে হাইয়াত, (২২) ইলমে হিছাব, (২৩) ইলমে হিন্দাসাহ্ প্রভৃতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদী অধ্যয়ন করে ১২৮৬ হিজরিতে পাঠ্য জ্ঞান সমাপ্ত করেন এবং ১৪ বৎসর বয়সেই সমাপ্তি সনদপত্র লাভ করেন।
ফতোয়া প্রদান : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যে দিন সমাপ্তি সনদ লাভ করলেন- সে দিনেই পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী দরগাহ্ শরীফে ‘মায়ের স্তন্যপান সম্পর্কিত একটি মাসআলার সমাধানের জন্যে কোনো এক আগন্তুক এসেছিল। আগন্তুকের এ মাসআলাটির উপর আ’লা হযরত চমৎকার একটি ফতোয়া তৈরী করে নিজ পিতার হাতে অর্পণ করলেন। আর তা এতোই সুন্দর ও নিখুঁত ছিল যে, তা দেখে প্রবীণ মুফতীয়ানে কিরামগণও হতবাক হয়ে গেলেন। সেদিন থেকে তাঁর সম্মানিত পিতা তাঁকেই ফতুয়া প্রদানের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
বাইআত ও খিলাফত : আ’লা হযরত রাদ্বিয়ালল্লাহু তা’য়ালা আনহু এর সম্মানিত পিতা আল্লামা নক্বী আলী খাঁন (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) এর সাথে ওলীকুল সম্রাট যুগ শ্রেষ্ঠ কুতুব সৈয়দ আলে রাছুল মারহারাভীর দরবারে হাজির হয়ে ক্বাদেরিয়া সিলসিলার বাইআত গ্রহণ করে ধন্য হন। মুর্শিদে বরহক হযরতের আধ্যাত্মিক জ্ঞানকেও পরিপূর্ণতা দান করে সমস্ত সিলসিলার খিলাফত-বাইআত এর ইজাযত এবং হাদীছ শরীফের সনদ দ্বারা ধন্য করেন। মুর্শিদে মারহারাভী বাইআয়াতের পর উপস্থিত মজলিশকে লক্ষ্য করে ফরমান - ‘রোজ কিয়ামতে মহান রব আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, তুমি আমার জন্য কি এনেছ? তখন আমি আহমাদ রেজাকে পেশ করব।’ খোদা প্রদত্ত জ্ঞানে অবদান : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু পাঠ্য পুস্তক সমূহের অর্জিত জ্ঞান ছাড়াও মহান রবের একান্ত দয়াগুণে ও নবী পাকের কৃপানজরে কোন ওস্তাদের নিকট পড়াশুনা ছাড়াও নিরেট ইলমে লাদুনী বা খোদা প্রদত্ত নুরানী অন্তুর দ্বারাই নিম্নোক্ত বিষয়াদীতে দক্ষতা অর্জন করেন এবং সেগুলোতে শায়খ ও ইমাম এর মর্যাদা লাভ করেন। যথা- (১) ক্বিরাত, (২) তাজভীদ, (৩) তাসাওফ, (৪) ছুলুক, (৫) ইলমুল আখলাক, (৬) আছমাউর রিজাল, (৭) ছিয়ার, (৮) ইতিহাস, (৯) অভিধান, (১০) আদব (বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে), (১১) আরিসমাত্বী-কী, (১২) জবর ও মুক্বালাহ, (১৩) হিসাব-ই-সিত্তীনী, (১৪) লগারিথম, (১৫) ইলমুৎ তাওক্বীত, (১৬) ইলমুল আকর, (১৭) যীজাত, (১৮) মুসাল্লাম-ই-কুরাভী, (১৯) মুসাল্লাস-ই-মুসাত্তাহ্, (২০) হাইআত-ই-জাদীদাহ, (২১) মুরাব্বাআত, (২২) মুন্তাহা ইলমে জুফার, (২৩) ইলমে যাইচাহ্, (২৪) ইলমে ফারাইজ, (২৫) আরবী কবিতা, (২৬) ফার্সী কবিতা, (২৭) হিন্দি কবিতা, (২৮) আরবী গদ্য, (২৯) ফার্সী গদ্য, (৩০) হিন্দী গদ্য, (৩১) পান্ডুলিপি, (৩২) নাস্তাালীক লিপি, (৩৩) মুন্তাহা ইলমে হিসাব, (৩৪) মুন্তাহা ইলমে হাইআত, (৩৫) মুন্তাহা ইলমে হিন্দাসাহ্, (৩৬) মুন্তাহা ইলমে তকছীর ও (৩৭) কুরআন শরীফ লিখন পদ্ধতিসহ প্রভৃতি। এছাড়াও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লামের ফযীলতসহ জীবন চরিত আক্বাইদের বিষয়ে কিতাব লিখেছেন ৬৩টি। হাদীস ও উসুলে হাদীসের উপর লিখেছেন - ১৩টি। ইলমে কালাম ও মুনাযারাহ্ বিষয়ে লিখেছেন ৩৫টি। ফিক্বহ ও উসুলে ফিক্বহ বিষয়ে লিখেছেন ৫৯টি এবং বিভিন্ন বাতিল পন্থীদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডনে ৪০০টিরও অধিক সংখ্যক কিতাব লিখে নবী পাকের বিরুদ্ধাচরণকারীদের জবান বন্ধ করে দিয়েছেন। এতো সংখ্যক লেখনীর জ্ঞানগত অবদান ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে পবিত্র কোরআনের অনুবাদ ‘তরজমায়ে কুরআন কানজুল ঈমান’। এ অনুবাদটি অন্যান্য অনুবাদগুলোর মধ্যে অনন্য স্থানের দাবীদার। কানজুল ঈমানের অনুবাদ ও অন্যান্য অনুবাদগুলোর মধ্যেকার বাস্তব পার্থক্য নিরূপণের জন্যে কানজুল ঈমানে ‘কোরআন মজিদের ভুল অনুবাদগুলো চিহ্নিত করণ’ অধ্যায় তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে পরিস্কার হয়ে যায় যে, কানজুল ঈমান এক বিস্ময়কর খোদাপ্রদত্ত জ্ঞানসম্বলিত অনুবাদ গ্রন্থ। এতদভিন্নও তাঁর বিখ্যাত ফিক্বহ শাস্ত্রের বিশাল গ্রন্থ ফাতাওয়ায়ে রেজভীয়া, যা প্রতিটি মাসআলার হাওলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ ধর্মী অনন্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি ১২ খন্ডে সমাপ্ত বর্তমানে আরবী ফার্সীর উদ্ধৃতিগুলোর উর্দু অনুবাদসহ ৩০ খন্ডে প্রকাশ হয়েছে।
যুগের জলিলুল ক্বদর মুজাদ্দিদ হুজুর আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর পবিত্র জীবনের ইতিহাস লক্ষ্য করলে পরিস্কার বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহ এ বিশেষ বান্দাহ্কে তাঁর দ্বীনের হিফাজতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। নবী করিম রাউফুর রাহীম এরশাদ ফরমান, অর্থাৎ প্রতি একশত বৎসরের শেষপ্রান্তে মহান রব এ উম্মতের জন্যে অবশ্যই মুজাদ্দিদ প্রেরণ করবেন, যে উম্মতের জন্যে আল্লাহর দ্বীনকে সঠিক রাখবে (আবু দাউদ শরীফ)। সেই নির্মম সময়ে যখন কিছু সংখ্যক সার্থান্বেষী ধর্মগুরু দ্বীনকে নিজ ব্যাখ্যায় পরিবর্তন করতে লাগলো সেই সময় তিনি মুসলিম উম্মাহকে শরীয়তের বিলোপ্ত বিধানাবলী স্বরণ করিয়ে দেন, নূরে খোদা মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামা’র মৃত সুন্নাতকে জিন্দা করেন, বিশেষ ইলম (জ্ঞান) ও ধৈর্য্য সাধনায় সত্যের বাণী ঘোষণা করে মিথ্যা ও এর অনুসারীদের চিহ্নিত ও নির্মূল করেন এবং সত্যের পতাকাকে উজ্জীবিত করেন। তিনিই হলেন ১৪ শত শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, আ’লা হযরত, আজীমুল বারাকাত, হাফিজ, ক্বারী মাওলানা আলহাজ্ব, শাহ্ মুহাম্মদ আহমাদ রেজা বেরলভী সুন্নী হানাফী ক্বাদেরী বারকাতী রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু। হিজরি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে যখন তদানীন্তন ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সমগ্র উপমহাদেশে নাস্তিকতা এবং ওহাবী-দেওবন্দী প্রভৃতি মতবাদের বিষাক্ত হাওয়া প্রভাহিত হচ্ছিল এবং বিশ্ব তাদের ভ্রান্ত আকিদা দ্বারা দূষিত হয়েছিল, আর চতুর্দিকে ইলহাদ ও বে-দ্বীনীর ঘন্টা বাজতেছিল, তখনই এমন একজন আশিকে রাসূলের আবির্ভাব ঘটলো যিনি বাতিলের অমাবশ্যা অন্ধকারে সত্যের আলো জ্বালিয়ে দিলেন। যার কলম নবীপাকের প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারীদের উপর আল্লাহর গজবের অগ্নিমালা রূপে পতিত হয়ে তাদের ভ্রান্ত আকিদাগুলোকে জ্বালিয়ে দিল, যিনি মুসলমানদেরকে ইংরেজ ও হিন্দুদের গোলামীর শৃংখল থেকে মুক্ত হবার তালিম দিলেন। সর্বোপরি যার সম্মুখে আরবীয় ও অনারবীয়, হেরম শরীফ ও হেরম শরীফের বাইরের বিজ্ঞ থেকে বিজ্ঞতর আলিমগণও একান্ত শ্রদ্ধাবনত হয়েছেন এবং যার সারাটি জীবন আক্বা ও মাওলা মুহাম্মদ মোস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামা’র মহান গোলামীতে কুরবান করেছেন। তিনিই মহান মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত। বিধর্মী ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু ইংরেজদের ধর্মাচার, তাদের শিক্ষানীতি ও তাদের কাছারীর প্রতি যথেষ্ঠ ঘৃণা পোষণ করতেন। এমনকি তিনি তৎকালীন ইংরেজ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর ফটো সম্বলিত পো’ কার্ড ও খামকে উল্টো করেই ঠিকানা লিখতেন, যাতে রাণী ভিক্টোরিয়া সপ্তম এওয়ার্ড এবং পঞ্চম জর্জের মাথা নিচু হয়ে থাকে। তিনি বলতেন, আহমাদ রেজার জুতোও ইংজেদের কাছারীতে যাবে না। বিরুদ্ধচারীরা অনেক চেষ্টা করেছে, মামলা দায়ের করেছে যেন যে কোন প্রকারে হোক তাঁকে কাছারীতে হাজির হতে হয়; কিন্তু প্রতিটি মামলায় হযরতকে অদৃশ্য সাহায্য হিফাজত করেছে। পক্ষান্তরে শত্রুদের ভাগ্যে জুটেছে বেদনাদায়ক অপমান।
হজ্জে বায়তুল্লাহ্ : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু ১৩২৩ হিজরি মোতাবেক ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার বায়তুল্লাহ শরীফ হজ্জ এবং হারামাইন-শরীফাঈন এর যিয়ারত করেন। এ সফরে হিযাজবাসী ওলামা কেরাম তাঁর সম্মানে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ হুস্সামুল হারামাইন, আদ্দৌলাতুল মক্কীয়াহ, ক্বিফলুল ফক্বীহ প্রভৃতি কিতাবসমূহ পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায়। মক্কা মুয়ায্যমায় তাঁকে সংবর্ধনা দেয়ার প্রত্যক্ষ দৃশ্য শেখ ইসমাঈল রাহমাতুল্লাহ আলাইহি নিজেই এভাবে বর্ণনা করেছেন যে- ‘দলে দলে মক্কাবাসী ওলামা কিরাম তাঁর নিকট সমবেত হন। তাঁদের অনেকেই তাঁর নিকট ‘ইজাযতের সনদ’ (খিলাফত) প্রদানের জন্যে অনুরোধ করেন। তাছাড়া অন্যান্য ওলামা ও বুযর্গ ব্যক্তিবর্গও তাঁর নিকট আসতে আরম্ভ করেন। এভাবে অনেককেই মক্কায় ইজাযত প্রদান করেন আর অনেককে বেরেলী শরীফ ফিরে এসে তথা থেকে ইজাযতের সনদ প্রেরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।’ অতঃপর আ’লা হযরত প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামা’র স্মৃতি বিজড়িত মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ নেন। সেখানেও তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী হযরত মাওলানা আবদুল করিম মুহাজিরে মক্কী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বর্ণনা করেন যে- ‘আমি কয়েক বছর ধরে মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করে আসছি। হিন্দুস্থান থেকে অসংখ্য জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিগণ হজ্জে আসেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আলিম, বুযুর্গ ও পরহেজগার ছিলেন। আমি যা লক্ষ্য করেছি তাঁরা মদীনা শহরের অলিগলিতে ইচ্ছা মাফিক ঘুরে বেড়াতেন, কেউ তাঁদের দিকে ফিরেও তাকাত না; কিন্তু আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু এর শান ছিল আশ্চর্যমন্ডিত। তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে সেখানকার বুযর্গানে দ্বীন, ওলামা কিরাম দলে দলে তাঁর সাথে সাক্ষাত লাভের জন্য আসতে আরম্ভ করেন এবং তাঁর সম্মানে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।’ মদীনা পাকে সেখানকার অনেকেই হযরতের নিকট থেকে ইজাযত বা খিলাফত লাভ করেন। অনেককে মৌখিক ইজাযত দান করেন, অনেককে স্বস্থান বেরেলী শরীফ আসার পর সনদ প্রেরণ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ মহান আশেকে রাসূলের প্রসিদ্ধি শুধু উপমহাদেশেই নয় বরং সমগ্র আরব আজমেও তাঁর পরিচিতি। তৎকালীন সময়ই বিদ্যমান ছিল।
জ্ঞানজগতে আ’লা হযরতের অবস্থান ও প্রতিপক্ষের অভিমত ! আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু এর কলমের এমন শান ছিল যে, তিনি কম বেশি পঞ্চাশটি বিষয়ের উপর কয়েকশত বড় বড় কিতাব রচনা করেছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন প্রস্রবন জারি করে দিয়েছেন যার থেকে আজও দুনিয়া তৃপ্তির সাথে উপকার গ্রহণ করছে। পক্ষের লোকতো পক্ষেরই, মুখালিফিনরাও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে যে, মাওলানা আহমাদ রেজা খাঁন সাহেব কলম সম্রাট ছিলেন। যে বিষয়ের উপর কলম ধরেছেন দ্বিতীয় কারোও কলম ধরার সাহস হয়নি। এ মহান হাস্তী সম্পর্কে পক্ষের লোক তো আছেই, প্রতিপক্ষের কতিপয় পরিচিত মনীষীর অভিমত নিম্নে উপস্থাপন করা হল। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব বলেন- ১. আমার যদি সুযোগ হতো, তাহলে আমি মৌলভী আহমাদ রেজা খাঁন বেরলভীর পিছনে নামাজ পড়ে নিতাম। (উসওয়ায়ে আকাবির- পৃঃ ১৮) ২. তিনি আরো বলেন- ‘তাঁর সাথে আমাদের বিরোধিতার কারণ বাস্তবিক পক্ষে ‘হুব্বে রাসূল’ (নবীপাকের ভালবাসা)-ই। তিনি আমাদেরকে হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লামের প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারী (গোস্তাখে রাসূল) মনে করতেন। (আশরাফুস্ সাওয়ানিহ্, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৯) ৩. যখন আ’লা হযরত ইহধাম ত্যাগ করেছেন, তখন কোন একজন মাওলানা আশরাফ আলী থানভীকে সংবাদ দিলে শুনামাত্রই তিনি আ’লা হযরতের জন্য মাগফেরাত কামনা করেন। জনৈক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাওলানা আহমদ রেজা খাঁনতো আপনাকে কাফের মনে করতেন। অথচ আপনি তাঁর মাগফিরাত কামনা করছেন। তিনি বলেন, আহমাদ রেযা আমাকে এজন্যই কাফের মনে করতেন, যেহেতু আমি তাঁর দৃষ্টিতে গোস্তাখে রাসূল ছিলাম। তিনি একথা জানার পরও যদি কাফের না বলেন, তিনি নিজে কাফের হয়ে যাবেন। (দৈনিক রাওয়ালপিন্ডি, ১লা নভেম্বর ১৯৮১) আবুল আ’লা মওদুদী সাহেব বলেন- মাওলানা আহমাদ রেজা খাঁন (মরহুম মগফুর) আমার দৃষ্টিতেতে একজন অসাধারণ জ্ঞানী ও দূরদর্শীতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি মুসলিম মিল্লাতের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। যদিও তাঁর সাথে আমার কতিপয় বিষয়ে বিরোধ রয়েছে। তবুও আমি তাঁর প্রভূতঃ দ্বীনি খেদমতকে স্বীকার করি। (আল মিযান, পৃঃ ১৬, সন- ১৯৭৬ মুম্বাই ও মাকালাতে ইয়াওমে রেজা, ২য় খন্ড, পৃঃ ৫৪০)। মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরীর ছেলে মাওলানা খলীলুর রহমান এর বক্তব্য- ১৩০৩ হিজরি সনে মাদ্রাসাতুল হাদীস, পীলীভেত এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে আয়োজিত জলসায় সাহারানপুর, লাহোর, কানপুর, জৌনপুর, রামপুর এবং বদায়ুনের আলেমগণের উপস্থিতিতে মুহাদ্দীস-ই সুরতীর একান্ত ইচ্ছাক্রমে আ’লা হযরত হাদীস শাস্ত্রের উপর অনবরত তিন ঘন্টা যাবৎ সারগর্ভ ও সপ্রমাণ বক্তব্য রাখলেন। জলসায় উপস্থিত ওলামা কেরাম তাঁর বক্তব্য অবাকচিত্তে শ্রবণ করলেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। মাওলানা আহমদ আলী সাহরানপুরীর পুত্র মাওলানা খলীলুর রহমান বক্তব্য শেষ হলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আ’লা হযরতের হাতে চুম্বন করলেন। আর বললেন, যদি এ মুহূর্তে আমার সম্মানিত পিতা থাকতেন তবে তিনি আপনার জ্ঞান সমুদ্রের মুক্তমনে প্রশংসা করতেন। আর তখন তাঁর এটা উচিতই ছিল। উল্লেখ্য, মুহাদ্দিস সুরতী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুঙ্গরী নদওয়াতুল ওলামা, লক্ষৌ এর প্রতিষ্ঠাতা তাঁর মন্তব্যের প্রতি সমর্থন জানালেন। (মাক্কালা-ই-মাহমুদ আহমদ ক্বাদেরী প্রণেতা, তাযকিরাই ওলামাই আহলে সুন্নাত মাহনামাই আশরাফিয়া মুবারকপুর, ১৯৭৭)।
বিদায়নামা : বেসাল শরীফের দুই দিন পূর্বে আ’লা হযরত কিবলা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তার এনে শিরা দেখতে বললেন। ডাক্তার সাহেব শিরা (নাড়ী) খুঁজে পেলেন না। জিজ্ঞেস করলেন কী অবস্থা? ডাক্তার সাহেব বললেন, দুর্বলতার কারণে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে হযরত জিজ্ঞাসা করলেন আজকের দিনটি কোন দিন? বলা হল, বুধবার। আ’লা হযরত বললেন, জুমআ আগামী পরশু দিন। বেশ কিছু পরে জবান মোবারক থেকে শুনা গেল (হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল) কালেমাটি পড়ছেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রিতে পরিবারবর্গ সকলে জাগ্রত থাকার ইচ্ছা করলেন। তখন তিনি তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বললেন রাত্রে জাগ্রত থাকার প্রয়োজন নেই। তাঁরা বললেন, যদি হঠাৎ কোন বিশেষ প্রয়োজন হয়ে যায়। তা শুনে হযরত কিবলা বললেন, আল্লাহ্ চাহে তো আজ ঐ রাত নয় যা তোমরা চিন্তা করছ, তোমরা সকলে ঘুমিয়ে পড়। রাত্রি অতিবাহিত হল। ভোরবেলা তিনি বললেন, আজ শুক্রবার। আবার বললেন, গত জুমায় ছিলাম চেয়ারের উপর, আজ থাকব খাটিয়ার উপর। অতঃপর আবার বললেন, আমার কারণে জুমআর নামাজে যেন দেরী করা না হয়। অতঃপর সফরের (মৃত্যুর) জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলেন। জমি-জমা সম্পর্কিত ওয়াক্ফনামা পরিপূর্ণ করলেন। সম্পত্তির চার ভাগের একভাগ আলাদা করে রাখলেন। বাকী উত্তরাধিকার শরয়ী কানুন মোতাবেক আওলাদদের জন্য রেখে দিলেন। অতঃপর নিম্নোক্ত অসীয়তনামা বললেন- ১। অন্তিম মুহূর্তের সময় কার্ড, খাম, রূপিয়া, পয়সা বা এমন কোন বস্তু যেন দেওয়ালে বা সামনে না থাকে, যাতে কোন ছবি থাকে। ২। অপবিত্র অবস্থায় কোন লোক বা ঋতুস্রাবওয়ালা কোন মহিলা যেন না আসে। ৩। কোন কুকুর এখানে আসতে দিবে না। ৪। সূরা ইয়া-সীন এবং সূরা রাদ আওয়াজ দিয়ে পড়তে থাকবে। ৫। কালিমায়ে তৈয়্যেবাহ্ আওয়াজ করে সীনায় দম আসা পর্যন্ত পড়তে থাকবে। ৬। কেহ যেন উঁচু আওয়াজে কথা না বলে। ৭। কোন কান্নাকাটি করা ছোট বাচ্চা এখানে আসতে দিওনা। ৮। অন্তিম সময়ে আমার এবং তোমাদের জন্য দোয়ায়ে খায়র করতে থাক। ৯। কোন খারাপ কথা জবান থেকে যেন বের না হয়, যেন ফেরেশতারা আমিন না বলে ফেলে। ১০। অন্তিম সময় বরফের অথবা খুব ঠান্ডা পানি পান করাবে। ১১। রূহ কবয হওয়ার পর ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আ’লা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ’ বলে নরম হাতে চোখগুলো বন্ধ করে দিবে এবং এটি পড়েই হাত এবং পা সোজা করে দিবে। ১২। গোসল এবং অন্যান্য কাজগুলো সুন্নাত মোতাবেক সম্পাদন করবে। ১৩। জানাযায় যেন শরয়ী কারণ ছাড়া দেরী না করা হয়। ১৪। জানাযা উঠানোর সময় সাবধান কোন আওয়াজ যেন না হয়। ১৫। জানাযার সামনে আমার প্রশংসামূলক কোন শের কখনো যেন গাওয়া না হয়। ১৬। কাফনের উপর যেন কোন পশমী চাদর না দেয়া হয়। ১৭। এমনিভাবে কোন কাজ যেন খেলাফে সুন্নাত না হয়। ১৮। কবরে খুব ধীরে ধীরে নামাবে, ডান করটে (পার্শ্বে) ঐ দোয়াটি পড়েই শুয়ায়ে দিবে এবং পরে নরম মাটি দিয়ে ভরাট করে দিবে। ১৯। কবর তৈরিতে বিলম্ব হলে কবর তৈরি করা পর্যন্ত এই দোয়াটি পড়বে- ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহুম্মা ছাব্বিত উবাইদাকা হাজা বিল ক্বাওলিছ্ ছাবিতি বিজাহি নাবিয়্যিকা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।’ ২০। কোন শস্য বা ফলমূল কবরের উপর নিয়ে যাবে না। এগুলোকে বন্টন করে দিবে। যেন কবরস্থানে শুরগোল না হয় এবং কবরের অসম্মান না হয়। ২১। দাফনের পরে মাথার দিকে থেকে পর্যন্ত এবং পায়ের দিকে থেকে এ সূরার শেষ পর্যন্ত পড়বে। ২২। দাফনের পর (মাওলানা শাহ) হামিদ রেজা খাঁন সাহেব সাতবার উঁচূ আওয়াজে আযান দিবে। ২৩। পরিবারভুক্ত ব্যক্তিরা আমার সামনাসামনি (মুখের নিকট) তিনবার তালকীন করবে। ২৪। দেড় ঘন্টা পর্যন্ত আমার মুখোমুখি দরূদ শরীফ এরূপ আওয়াজে পড়তে থাকবে যেন আমি শুনতে পাই। পরে আমাকে দয়াময় আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে চলে আসবে। আমার দু’জন প্রিয়ভাজন বা বন্ধু মনোনীত করে তিন রাত তিন দিন পূর্ণ প্রহরার সাথে আমার মুখের দিকে কুরআন মাজীদ এবং দরূদ শরীফ আওয়াজ করে একটানা পড়তে থাকবে। আল্লাহ চাহে তো ঐ নতুন স্থানে আমার মন বসে যাবে। ২৫। আরও অসিয়ত করেছেন যে, গরীব-মিসকীনদেরকে ফাতেহা করে যেন পালা করে খাবার খাওয়ানো হয়। তবে সুন্নাতের খেলাফ যেন না হয়।
ওফাত শরীফ : আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু এর ওফাত শরীফ হয়েছিল ২৫ সফর ১৩৪০ হিজরি মোতাবেক ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ, জুমআ বার (শুক্রবার) বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে বেরেলী শরীফে। দিনের ২টা বাজার আর ৪ মিনিট বাকী ছিল। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সময় কত? কেউ আরয করল ২টা বাজার ৪ মিনিট বাকী। বললেন, ঘড়ি রেখে দাও। ফটো সরিয়ে দাও। এ কথা শুনে সকলে চিন্তামগ্ন! এখানে তাসবীর তথা ফটো কোথায়! আবার তিনি নিজে থেকেই বললেন, এ রূপিয়া, পয়সা, কার্ড, খাম। অল্প কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত হামিদ রেজা খাঁন সাহেবকে বললেন যে, ওযু করে কুরআন শরীফ লও। এখনো তিনি ফিরে আসেননি। এদিকে হুজুর মুফতীয়ে আযম হিন্দ মোস্তফা রেযা খাঁন সাহেবকে বললেন, এখন বসে কি করছ? সূরা ইয়াসীন ও সূরা রা’দ শরীফ তিলাওয়াত কর। হুজুর মুফতীয়ে আযম হিন্দ তিলাওয়াত শুরু করলেন। এখন পবিত্র হায়াতের আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকী। তখন আ’লা হযরত কিবলা এমন মনোযোগের সহিত তিলাওয়াত শুনতে ছিলেন, যে আয়াত স্পষ্টভাবে শুনেননি তা তিনি নিজেই তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দিতেন। সাইয়্যেদ মাহমুদ জান সাহেব আসলেন। হযরত কিবলা দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন সাইয়্যেদ সাহেবের সাথে মুসাফাহা করলেন। সফরের দোয়াগুলো পড়লেন, এমনকি অন্যান্য বারের তুলনায় বেশী পড়লেন। অতঃপর কালিমায়ে তায়্যিবাহ পড়লেন। শেষ নিঃশ্বাস যখন বক্ষে এসে পড়ল পবিত্র ওষ্ঠদ্বয়ের স্পন্দন এবং যিকরে পাস আনফাস করার মাত্রা শেষ হয়ে আসছে। হঠাৎ চেহারা মোবারকের উপর নূরের একটি আলোকরশ্মি চমকে উঠল, যাতে প্রতিফলন ছিল যেমনিভাবে আয়নার উপর পতিত চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়। এ আলোকরশ্মি অদৃশ্য হতেই সেই নূরানী রূহ পবিত্র শরীর থেকে উড়ে গিয়েছিল। বারগাহে রেসালাতে তাঁর মর্যাদা : হুজুর কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে আ’লা হযরতের গ্রহণযোগ্যতা কেমন ছিল, তা নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়। মাওলানা আব্দুল আযীয মুরাদাবাদী যিনি দারুল উলুম আশরাফিয়া, আযমগড়-এর শিক্ষক ছিলেন, তিনি আজমীর শরীফ দরগাহর সাজ্জাদানশীন দিওয়ান সাইয়্যেদ আলে রাসূল সাহেবের সম্মানিত চাচা হতে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ১২ রবিউস্সানি, ১৩৪০ হিজরি। একজন সিরিয়াবাসী বুযুর্গ দিল্লীতে তাশরীফ আনলেন। তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। বড়ই শান-শওকতপূর্ণ বুযর্গ ছিলেন তিনি। মন-মানসিকতায় সাবলিলতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। মুসলমানগণ ওই আরবীয় বুযর্গের খিদমত করার নিমিত্তে নযরানা পেশ করতে লাগল। কিন্তু তিনি তা ক্ববুল করতে অস্বীকার করছিলেন, আর বলতে লাগলেন, আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে আমি আর্থিকভাবে সচ্ছল। এ সবের প্রয়োজন নেই। এটা সত্যি আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, তিনি দীর্ঘদিন যাবত সফর করছেন অথচ কোন অভাববোধ করছেন না। আরয করলেন, এখানে তাশরীফ আনার কারণ কী? তিনি বললেন, উদ্দেশ্য তো বড়ই উঁচুমানের ছিল। কিন্তু হাসিল হলো না, আফসোস! ঘটনা হচ্ছে এ যে, ২৫ সফর ১৩৪০ হিজরি আমার সৌভাগ্য জেগে উঠল। স্বপ্নে আমার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যিয়ারত নসীব হল। দেখলাম, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ রাখলেন। সাহাবায়ে কেরাম মহান দরবারে উপস্থিত আছেন; কিন্তু মজলিসে নিরবতা বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল কারো জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। আমি রাসূলে পাকের দরবারে আরয করলাম, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! কার জন্য অপেক্ষা? এরশাদ ফরমালেন, আহমাদ রেযার জন্য এ অপেক্ষা। আরয করলাম, কে সে ? এরশাদ হলো, হিন্দুস্থানের বেরিলীর বাসিন্দা। স্বপ্ন ভাঙার পর খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম, মাওলানা শাহ আহমাদ রেযা খুবই উঁচু মানের একজন আলেম। তিনি জীবিত আছেন। তাই সাক্ষাতের দারুণ আগ্রহ নিয়ে বেরেলী শরীফ পৌঁছেছি। এসে জানতে পারলাম যে, তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আর ওই ২৫ সফরই তার মৃত্যুকালের তারিখ ছিল। তাঁর সাথে সাক্ষাতের অদম্য আগ্রহে এ দীর্ঘ সফর করলাম কিন্তু আফসোস! সাক্ষাত করতে পারলাম না। এ মহান মনীষী ইন্তেকালের ৪ মাস বাইশ দিন পূর্বে কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারা নিজের ওফাতের তারিখ নির্বাচন করেন ১৩৪০ হিজরি। আয়াতটি হল- অর্থাৎ জান্নাতে লোকেরা পূণ্যবানদের চতুপার্শ্বে রৌপ্য প্লেইট এবং গ্লাস নিয়ে প্রদক্ষিণ করবে।
গোসল শরীফ, কাফন ও নামাযে জানাযা : হযরত কিবলার কবর শরীফ খনন করেন সৈয়্যদ আযহার আলী সাহেব। সদরুশ শরীয়ত মুফতী আমজাদ আলী সাহেব অসীয়ত অনুযায়ী গোসল দিলেন। হাফেজ আমির হোসেন সাহেব মুরাদাবাদী তাঁর সহযোগী ছিলেন। মাওলানা সৈয়্যদ সোলায়মান আশরাফ ছাহেব, সৈয়দ মাহমুদ জান সাহেব, সৈয়্যদ মমতাজ আলী সাহেব ও জনাব মাওলানা মুহাম্মদ রেযা খাঁন ছাহেব প্রমুখ পানি ঢেলে ধৌত করার দায়িত্ব পালন করেন। জনাব হাকিম রেযা খাঁন সাহেব, জনাব লিয়াকত আলী খাঁন সাহেব রেজভী এবং মুন্সী ফেদা ইয়ার খাঁন রেজভী সাহেব পানি সরবরাহ করেন। মুফতীয়ে আযম হিন্দ মোস্তফা রেযা খাঁন ছাহেব অসীয়ত মোতাবেক দোয়া দরূদসমূহ উপস্থিত লোকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। হুজ্জাতুল ইসলাম শাহ্ হামেদ রেযা খাঁন ছাহেব কপালের সিজদা স্থানে কাপুর লাগিয়ে দেন। ছদরুল আফাযিল সৈয়দ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী সাহেব কাফন শরীফ বিছালেন। গোসল কাফনের পর দর্শনের সুযোগ দেয়া হয়। অতঃপর ঈদগাহে বিশাল জানাযা সম্পাদন করেন বাহারে শরীয়ত গ্রন্থ প্রণেতা মুফতী আমজাদ আলী রেজভী সাহেব (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম)।
মাজার শরীফ : বেরেলী শরীফ শহরের সওদাগরাঁ মহল্লায় দারুল উলূম মানজারুল ইসলাম এর উত্তর পাশে এক আলীশান দালানের অভ্যন্তরে তাঁর মাজার শরীফ।
তাঁর ওরস শরীফ; যা শরীয়তেরই প্রতিচ্ছবি, প্রতি বছর ২৫শে সফর অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সারা ইসলামী বিশ্বের চতুর্দিক থেকে প্রসিদ্ধ আলেম ওলামা,পীর-মাশায়েখ,ইমাম ও খতিব সাহেবগণ শরীক হয়ে ধন্য হয়ে থাকেন।