প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
মুফতী এইচ.এম. আনোয়ার মোল্লা ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। ১৯৯৭ সালে জুলাই মাস থেকে তিনি ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি ইলমে ফিকহের খেদমতের পাশাপাশি যুগ-জিজ্ঞাসার বিভিন্ন বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক সঠিক সমাধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
মুফতী এইচ.এম. আনোয়ার মোল্লা সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ইসলামী কণ্ঠের মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নেন মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : আলহামদুলিল্লাহ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে ভালো আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ফরিদগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহ বিভাগে আপনার খেদমত কতদিন চলছে?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : ১৯৯৭ সালের জুলাই মাস হতে অদ্যাবধি, ২৫ বছর ইলমে ফিকহের খেদমতের পাশাপাশি যুগ-জিজ্ঞাসার বিভিন্ন বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক সঠিক সমাধানের কাজে নিয়োজিত আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কামিল ফিকাহ বিভাগের ১ম ও ২য় বর্ষে কী কী কিতাব পড়ানো হয়?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : কামিল ফিকাহ বিভাগে বর্তমানে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণীত এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সিলেবাস অনুযায়ী পাঠ্য কিতাবগুলো হলো : ইমাম আবু জাফর ত্বহাভী রচিত শরহু মাআনিল আছার ত্বহাভী শরীফ, বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন, ইমাম ফখরুল ইসলাম বজদুবী রচিত উসূলে বজদুবী, ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান হানাফী রচিত তাহসিলুল উসূল, ইমাম আবু ইসহাক ইব্রাহিম ইবনে মুসা সাতেবী রচিত মাকাচিদুশ শরীয়্যাহ, শাহ ওয়ালী উল্লাহ রচিত আসরারুশ শরীয়্যাহ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ), তবকাতুল ফুকাহা (ফকিহগণের ৭টি স্তর বিস্তারিত), ইসলামী বিচার ব্যবস্থা, ইসলামী রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থা, ফতওয়া দেয়ার অধিকার, নিয়ম ও শর্তসমূহ এবং বৈশিষ্ট্য (মুফতী আমিনুল এহসান রচিত আদাবুল মুফতী), ফিকহুল একতেসাদ ইসলামী অর্থনীতি এবং ইসলামি ব্যাংকিং, বীমা ও সুদের কুফল।
চাঁদপুর কণ্ঠ : একজন যোগ্য ফকিহ হওয়ার জন্যে কী কী কিতাব পড়তে হয়।
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : একজন যোগ্য ফকীহ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এবং বর্তমান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার সিলেবাস অনুযায়ী কমপক্ষে নিম্নবর্ণিত কিতাবসমূহ অধ্যায়ন করতে হয়। বিষয়টি অনেক ব্যাপক আলোচনার। সময়ের স্বল্পতায় নি¤েœ সংক্ষেপে কিছু কিতাবের নাম উপস্থাপন করছি। তাফসীর বিষয়ক : তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বায়জাভী, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে ইবনু কাসির, তাফসীরে খাজেন, সফওয়াতুত তাফাসীর, তাফসীরে দুরে মানসুর। হাদিস বিষয়ক : ছিহাহ ছিত্তার সকল হাদিসের কিতাবের পাশাপাশি মুসনাদে ইমাম আজম, মুসনাদে ইমাম শাফেয়ী, মুসনাদে আহমদ, মুয়াত্তায়ে মালেক, মুয়াত্তায়ে মোহাম্মদ, সরহু মাআনিল আছার এছাড়াও মেসকাতুল মাসাবীহ, রিয়াদুস সলেহীন, মেরকাত শরহে মেশকাত ইত্যাদি কিতাবের জ্ঞান অর্জন করা ন্যূনতম প্রয়োজন। উসূলুল ফিকহ বিষয়ক : উসূলুশ শাশী, নূরুল আনওয়ার, কাশফুল আসরার, উসূলে বজদুভী, আলওয়াজিজ ফি উসূলে ফিকহ, উসূলে কারখী। ফিকহ বিষয়ক : মোখতাছারুল কুদুরী, শরহে বেকায়াহ, কানজুদ দাকায়েক, বাহারুর রায়েক, মালা বুদ্ধা মিনহু, হেদায়া আল আসবাহ ওয়ান নাজায়ের, তবাকাতুল ফোকাহা, কাওয়ায়েদুল ফিকহ, ইলমুল একতেসাদ, ইসলামী অর্থনীতি, কাজাও ছিয়াছাহ সম্বলিত বিভিন্ন ফকিহ ও মুজতাহীদগণের রচিত কিতাব সমূহ। ফতওয়া বিষয়ক : ফতওয়ায়ে কাজীখান, দুররে মোখতার, ফতওয়ায়ে শামী, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, মাজমুয়ায়ে ফতওয়া, ছারছীনা শরীফের তরিকুল ইসলাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আক্বিদা বিষয়ক : শরহে আক্বায়েদে নাসাফী, শরহে মাওয়াফে, আক্বিদায়ে ত্বহাবীয়া, ফিকহুল আকবর, হুজ্জাতুল্লা হিল বালেগাহ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার উপরে লিখিত আরো অনেক কিতাবের জ্ঞান অর্জন আবশ্যক। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন, ইসলামী ব্যবসা-বাণিজ্য, ওয়াকফ, হেবা, উত্তরাধিকারী আইন, ইসলামী ব্যাংকিং, বীমা, দেশীয় উরফ, প্রচলিত নীতিমালা, সামাজিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিভাষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা একজন যোগ্য ফকিহ এর জন্য অত্যাবশ্যক।
চাঁদপুর কণ্ঠ : হানাফী মাযহাবের কিছু প্রসিদ্ধ কিতাবের নাম জানতে চাই।
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : হানাফী মাজাহাবের কিছু কিতাবের তালিকা : বিষয়টি অনেক ব্যাপক আলোচনার বিষয় উপরে বর্ণিত তাফসীর, হাদিস, ফিকহ ও ফতওয়ার কিতাব এবং এসব কিতাবের শরাহ ব্যাখ্যা সম্বলিত হানাফী মাজাহাবের অসংখ্যা কিতাব রয়েছে। যেমন জাহেরে রেয়ায়েত, ছিয়ারে সগীর, ছিয়ারে কবীর, জামে সগীর, জামে কবীর, মাদসুত, জিয়াদাত, বাহারুর রায়েক, ফতহুল কাদির, শরহে হেদায়া, এনায়া, নেহায়া ইত্যাদি কিতাব সমূহ।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কুরআন সুন্নাহর আলোকে মাযহাব মানার প্রয়োজন কতটুকু?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : কুরআন-সুন্নাহের আলোকে মাজাহাব মানার প্রয়োজনীয়তা বলতে সংক্ষেপে এককথায় বলা যায়, ইসলামী শরীয়ত মানার যে হুকুম মাজহাব মানার একই হুকুম। মাজহাব বলতে বুঝায়, চলার পথ। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী জীবন চলার জন্য পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসের জ্ঞান অর্জনকারী বিজ্ঞ ফকিহ মুজতাহিদগণের যেকোনো একজনের সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যে অতীব ও জরুরি। যেমন : বলা যায় কোনো ব্যক্তি চাঁদপুর হতে ঢাকা যেতে হলে নৌপথ, স্থলপথ ও আকাশ পথের যে কোনো একটি চলার পথকে অনুসরণ করতেই হবে তার জন্য ঢাকা যাওয়া যেমন জরুরি তেমনিভাবে ঢাকা যাওয়ার জন্যে যে কোনো একটি চলার পথ অনুসরণ জরুরি। অতএব, মাজহাব মানা মানেই হলো ইসলামের শরীয়তকে মেনে চলা। শরীয়ত মানা মানেই মাজহাব মানা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কুরআন-হাদিস থেকে সরাসরি আমল করা যাবে কী?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : ফতওয়ায়ে শামীর ভূমিকায় রয়েছে, বর্তমান যুগ হলো তাকলীদের (বিজ্ঞ মুজতাহিদদের অনুসরণের) যুগ। আমরা কেহই শরীয়তের মুজতাহিদ নই। সকলেই মুকাল্লীদ, আমাদের জন্য সরাসরি কুরআন-হাদিস হতে আমল করা সম্ভব নয়। কেননা কুরআনের সকল আয়াত শরীয়তের মাসয়ালার জন্যে দলিল নহে। মাত্র ৫০০ আয়াত শরীয়তের মাসয়ালার দলিল, এমনিভাবে সকল হাদিস শরীয়তের দলিল বা সুন্নাহ নহে। মাত্র ৩০০০ হাদিসকেই সুন্নাহ বা শরীয়তের দলিল হিসেবে মুজতাহিদগণ স্থির করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের কুরআন-হাদিস হতে ইজতিহাদ করার বা সমস্যার সমাধান উদ্ঘাটন করার যথাযথ জ্ঞান নেই বিধায় আমাদের জন্যে কুরআন হাদিস থেকে সরাসরি আমল করা অসম্ভব।
চাঁদপুর কণ্ঠ : একজন মুফতি ফতোয়াদেয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে ফতোয়া প্রদান করবে?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : একজন মুফতী ফতওয়া দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে সমস্যামান জিজ্ঞাসিত বিষয়টি ভালোভাবে বুঝবেন। এ বিষয়টি ইসলামের শরীয়তের ত্বহারাত, ইবাদাত, মোয়ামালাত, মোয়াশারাত, সিয়াসাত ৫টি বিভাগের কোন বিভাগের সাথে প্রযোজ্য তা নির্ণয় করবেন। এ বিষয়ের সমাধানে মাজহাবের বিজ্ঞ ফকিহ, মুজতাহিদগণ ও তাদের অভিমত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন। আন্তর্জাতিক ইসলামিক আইন, রাবেতায়ে আলমে ইসলামি, ওআইসি, দেশের প্রচলিত আইনের সমন্বয়ে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, উর্ফ নজরে রেখে বিজ্ঞ মুজতাহিদগণের মতামত ব্যক্ত করে যুগ জিজ্ঞাসার সমাধানে সঠিক ও প্রায়োগিক দিক বিচার করে ফতওয়া দিবেন। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, কোন মাসায়ালার সমাধানে সমাজে যেনো কোনো নতুন ফেতনা, বিশৃংখলা অনৈক্য সৃষ্টি না হয়। প্রয়োজনে মুফতী সাহেব আদালতের বিচারকের ন্যায় ফতওয়া প্রদানে বিরত থাকবেন বা বিব্রতবোধ করবেন, ফতওয়া দেয়ার সঠিক সময়ের অপেক্ষা করবেন। এক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীনে এজাম, মাজহাবের ইমামদের নীতি অনুসরণ করবেন। ফতওয়া প্রদানে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিবেন। কোনো অবস্থায় মানুষের মনে ইসলামী শরীয়তের বিষয়ে সংশয়, সন্দেহ, অবজ্ঞা, অবহেলা সৃষ্টি করা যাবে না। শরীয়তের কোনো বিষয় কোনো সমাজে অকার্যকর হয় এমতাবস্থায় ফতওয়া প্রদান থেকে বিরত থাকা জরুরি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মাসয়ালা-মাসায়েল জানতে বাংলায় প্রসিদ্ধ কীতাবে নাম জানতে চাই?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : মাসয়ালা-মাসায়েল জানতে বাংলা ভাষায় ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফতওয়ায়ে শামী, ছারছীনা শরীফ হতে প্রকাশিত তরীকুল ইসলাম, বাংলাদেশে আলেম সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র ড. আল্লামা মুফতী কাফীল উদ্দীন সরকার ছালেহীসহ আরো অনেক বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামদের রচিত মাসায়েলের বাংলা ভাষায় বিভিন্ন কিতাব রয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ফতোয়া কে দিতে পারবে?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : মুফতী আমিমুল এহসান (রহঃ) রচিত আদাবুল মুফতী কিতাবের আলোকে যিনি ইসলামী শরীয়তের পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস এবং মাজহাবের ইমামগণের শরীয়তের মাসায়ালা ব্যাপারে বর্ণিত অভিমত সমূহের জ্ঞান রাখেন। পাশাপাশি দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন, আন্তর্জাতিক ইসলামী আইনের সংস্করণ এবং সমাজের প্রচলন ও উফ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অধিকারী, উপরে বর্ণিত একজন যোগ্য ফকিহ হওয়ার গুণাবলির অধিকারী তিনি একমাত্র ফতওয়া দিতে পারেন। অদূরভবিষ্যতে ফতওয়া দেয়ার অধিকার যথাযথ যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হওয়া আবশ্যক।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বর্তমানে ইউটিউবে, ফেসবুকে অনেক অনেক ফতোয়া শুনতে পাওয়া যায়, যে কোনো জন ফতোয়া দিতে থাকে। যা শুনে সাধারণ মানুষ সন্দেহের মধ্যে পড়ে তাদের জন্যে কিছু বলার আছে?
মুফতী আনোয়ার মোল্লা : বর্তমানে ইউটিউবে, ফেসবুকে অনেকেই অনেক মাসয়ালা বর্ণনা করে থাকেন। যা তাদের একক দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো মহলের প্রশ্নের জবাব বলে আমি মনে করি। এটি গোটা দেশ ও মুসলিম জাতির জন্যে সার্বজনীন ফতওয়া বলে আমি মনে করি না। যে সকল প্রশ্নের জবাবে সমাজে বিশৃংখলা, মানুষের মনে সন্দেহ, শরীয়তের বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে তা ফতওয়া হতে পারে না।