প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২২, ০০:০০
হিজরি সন। মুসলিম জীবনের এক তাৎপর্যময় অধ্যায়। বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনার অবিস্মরণীয় স্মারক এ হিজরি সন। হিজরি সনের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোদ নবি করিম (সাঃ)। খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি চুক্তিপত্রের নিচে হিজরতের ৫ম বর্ষ উল্লেখ করার নির্দেশ দেন বলে ইসলামের ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে হিজরতের ১৭তম বর্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন গণনা শুরু করেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : হিজরি তারিখ গণনার সূচনা কিভাবে হলো, কবে থেকে হলো তা বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আল মাওসুয়াতুল ফিকহিয়া আল কুয়েতিয়া’ গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে এসেছে- ইসলাম আসার আগে আরবের সমষ্টিগত কোনো তারিখ ছিল না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর, মাস গণনা করত। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম (আঃ)-এর সন্তানরা কাবা শরিফ নির্মিত হওয়ার আগে তাঁর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে তারিখ নির্ধারণ করত। কাবা শরিফ নির্মাণের পর তারা বিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্ত এর আলোকেই সাল গণনা করতেন। তারপর বনু ইসমাঈলের যারা হেজাজের তেহামা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে অন্যত্র চলে যেত, তখন সেই গোত্র বেরিয়ে যাওয়ার দিন থেকে তারিখ গণনা করত। যারা তেহামাতে রয়ে যেত তারা বনি জায়েদ গোত্রের জুহাইনা, নাহদ ও সাদের চলে যাওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কাব বিন লুয়াইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ ধারা চলমান ছিল। পরে তার মৃত্যুর দিন থেকে নতুনভাবে সাল গণনা শুরু হয়। এটি চলতে থাকে হস্তীবাহিনীর ঘটনা পর্যন্ত। হজরত ওমর (রাঃ) হিজরি নববর্ষের ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত আরবে হস্তীবর্ষই প্রচলিত ছিল।
হিজরি সনের গোড়াপত্তন : মহানবি (সাঃ)-এর হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রাঃ) হিজরি সনের আনুষ্ঠানিক অপরিহার্যতা বোধ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র চান্দ্রমাসের পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। কেন একটি নতুন সন গণনা প্রথা চালু করতে হলো, এ নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়।
আল্লামা ইবনে সমরকন্দী (র) লিখেছেন, হজরত আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) ইরাকের গভর্নর থাকাকালে একবার হজরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে চিঠি লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে। কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সন গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রাঃ) হিজরি সনের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন।
যেভাবে সন গণনা শুরু : হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। যখন হজরত ওমর (রাঃ) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তখন তিনি এক পরামর্শসভার আহ্বান করেন। সভায় হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) রাসুল (সাঃ)-এর ওফাত থেকে সন গণনার প্রস্তাব দেন। হজরত তালহা (রাঃ) বিশ্বনবি (সাঃ)-এর নবুয়তের বছর থেকে সন গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। আর হজরত আলী (রাঃ) প্রস্তাব দেন হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে সন গণনার। অবশেষে সকলেই আলী (রাঃ)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।
মাস নিয়ে মতপার্থক্য : এরপর কোন মাস থেকে শুরু হবে এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আবদুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেননা এটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমে আসে। হজরত তালহা (রাঃ) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা এটি উম্মতের মাস। হজরত আলী (রাঃ) ও ওসমান (রাঃ) মহররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন।
হিজরতের সাল থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হলো, হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয় আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল তথা সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী বিষয় হিসেবে। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। প্রকাশ্যে আজান, নামাজ, জুমা, ঈদ ও অন্য সবকিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। এসব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তাৎপর্য : হিজরি সন আরবি মাস হলেও এ সনটিকে মুসলিম উম্মাহর সন হিসেবেই গ্রহণ করার প্রয়োজন অনেক বেশি। হিজরি সন মূলত চান্দ্র বর্ষের মাস। আরবিতে একে ‘আশশুহুরুল কামারিয়্যা’ বলা হয়। এ জন্য হিজরি সন একটি চান্দ্রবর্ষ। যেমন ঈসায়ী সনের মাসগুলোকে বলা হয় ‘আশশুহুরুশ শামসিয়্যা’ বা সৌরবর্ষের মাস। এ চান্দ্রবর্ষকে তাই কেবল আরবদের সন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না; বরং হিজরি মুসলমানদের সন। এটি ইসলামের সন।
হিজরি সনের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব আছে। বিশেষত ইবাদতের তারিখ, সময় ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরি সনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে হিজরি সনের হিসাব স্মরণ রাখা মুসলমানদের জন্য জরুরি। ধর্মীয় অনেক ক্ষেত্রেই হিজরি সনের প্রভাব রয়েছে। যেমন : রমজানের রোজা, দু’ঈদ, হজ, জাকাত ইত্যাদি।
শুধু হিজরি সন নয়, হিজরি সনের মাসগুলোর তারিখ ব্যবহারে ও চর্চায় রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কর্তব্য। মুসলমানদের হিসাব-নিকাশগুলো হিজরি তারিখ উল্লেখ করেই করা উচিত। অন্য সনের হিসাব হিজরি অনুগামী হিসেবে আসতে পারে। কারণ আধুনিক চিন্তাবিদগণের সিদ্ধান্তমতে, ইসলামি তারিখ বা চান্দ্রবর্ষের হিসাব রক্ষা করা মুসলমানদের জন্য ফরজে কেফায়া।
কথা হলো, প্রিয়নবি (সাঃ)-এর জন্ম, নবুয়ত লাভ এবং ওফাত- এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ থাকতেও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফত আমলে কেন ইসলামি সন বা বর্ষপঞ্জী এ তিনটির কোনো একটির স্মরণে প্রবর্তন করা হলো না? মূলত এ প্রশ্নটি নতুন নয়। সে আমলেই দেখা দিয়েছিল। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কা হতে মদিনায় হিজরতের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছিল। তখন প্রমাণ হিসেবে সামনে এসে যায় যে, খোদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় একাধিক ক্ষেত্রে হিজরি সন ব্যবহার করেছিলেন। যা ছিল সাহাবায়ে কেরামের নিকট অকাট্য দলিল। ঐতিহাসিকভাবে এ কথা সত্য যে, খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লিপিবদ্ধ করার জন্য মহানবি (সাঃ) চুক্তিপত্রের নিচে হিজরতের ৫ম বর্ষ উল্লেখ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ চুক্তি রচনাকারী ছিলেন হজরত আলী (রাঃ)। সম্ভবত এ কারণেই ঐতিহাসিক ইবনে আসাকের বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে হিজরি সনের সূচনা হয়েছিল রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আমলেই।
নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বর্ণনা মতে, মহানবি (সাঃ) রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ মোতাবেক ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ বৃহস্পতিবার হিজরত করেছিলেন। অতএব, এ মাস হতেই হিজরি সন আরম্ভ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম অভিমত প্রকাশ করেন যে, মহররম মাস হতে হিজরি নববর্ষ আরম্ভ করা অধিক যুক্তিযুক্ত। তাই দু’মাস ৮ দিন পিছিয়ে দিয়ে পহেলা মহররম হতে হিজরি সনের তারিখ গণণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১০ জমাদিউল আউয়াল, বুধবার হজরত ওমর (রাঃ) ফরমান জারি করেন যে, পহেলা মহররম হতে হিজরি সন চালু হবে। অপর বর্ণনা মতে, ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৮ হিজরিতে সাহাবিদের এক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এটি হজরত ওমরের (রাঃ) খেলাফতের চতুর্থ বছরের ঘটনা। ঐতিহাসিকদের সুচিন্তিত অভিমত হলো, ঐ বছর ১ হিজরি ১ মহররম পড়েছিল ১৬ জুলাই ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ রোজ শুক্রবার। এটিই হচ্ছে হিজরি সন প্রবর্তনের সূচনাকাল। আরবিতে একে বলা হয় ‘আস সানাতুল হিজরিয়া’ (হিজরি সন) এবং ‘আত তাকবীমুল হিজরি’ (হিজরি ক্যালেন্ডার)।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর। সে রাতেই মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের ফলে আল্লাহর নির্দেশে প্রিয়নবি মদিনায় হিজরত করেন। আর মদিনার মানুষগুলো প্রিয়নবির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশে তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত শুরু করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৮ রবিউল আউয়াল মদিনার পাশ্ববর্তী স্থান কুবায় এসে পৌঁছেন। অবশেষে ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল তিনি মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন। এ হিজরতেরই স্মৃতিবহন করে আসছে আরবি হিজরি সন।
হিজরি সন কেন মহররম দিয়ে শুরু : রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন মদিনা মুনাওয়ারায় আসেন, তখন মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল। আর হজরত ওমর (রাঃ) হিজরি সনের প্রথম মাস ধরেন মহররমকে। যদিও প্রিয়নবি (সাঃ) মদিনায় পৌঁছেন রবিউল আউয়াল মাসে। কিন্তু হিজরতের পরিকল্পনা হয়েছিল নবুয়তের ১৩তম বর্ষের হজের মৌসুমে। সময়টি ছিল মদিনার আনসারি সাহাবিদের সঙ্গে আকাবার দ্বিতীয় শপথ সংঘটিত হওয়ার পর। তখন ছিল জিলহজ মাস। আর তার পরের মাসই হলো মহররম।
বাংলাদেশে হিজরি সনের প্রচলন : ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর (রাঃ) কর্তৃক হিজরি সন প্রবর্তিত হওয়ার এক বছর পরই আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে বাংলার জমিনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়। এর ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদালাভের মাধ্যমে জাতীয় সন গণনায় পরিণত হয়। সন গণনায় ৫৫০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর থাকার পর ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের মাধ্যমে হিজরি সনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবসান হয়।
হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব মুসলিম জীবনে অনস্বীকার্য। কেননা হিজরি সন এমন একটি সন, যার সাথে সম্পৃক্ত বিশ্ব মুসলিমের তাহজিব-তামাদ্দুন। এছাড়াও রাসুল (সাঃ)-এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনাবলি যেনন- বদর, খন্দক, তাবুক প্রভৃতি যুদ্ধ, রাজ্য জয় এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলি হিজরি সনের সাথে সম্পৃক্ত। সম্পৃক্ত ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানও। যেমন- রোজা, হজ, ঈদ, লাইলাতুল কদর, শবে মিরাজসহ ধর্মীয় নানান আচার-অনুষ্ঠান। উপরন্তু হিজরি সন যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর সময়কাল থেকে শুরু হয়েছে এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) দ্বীনে ইসলামের অনুসারীদের তথা মুসলমানদের আদর্শের প্রতীক। তাই সর্বস্তরের মুসলমানদের এ হিজরি সালের প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিত।
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস) আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স।