শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২২, ০০:০০

পশু নয়, হোক পশুত্বের কোরবানি
অনলাইন ডেস্ক

‘ওরে হত্যা নয় রে সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ হ্যাঁ, বছর ঘুরে আবার আমাদের দুয়ারে হাজির পবিত্র কোরবানি। সমুপস্থিত ঈদুল আজহা। এবার যখন আমরা পবিত্র ঈদুল আজহা তথা কোরবানি-পর্ব সম্পাদন করতে যাচ্ছি তখন বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জে চলছে বানভাসি মানুষের আহাজারি। ঈদণ্ডআনন্দ কী জিনিস তা সেখানকার অধিকাংশ মানুষের বরাতে জুটছে না।

আমরা যখন কোরবানি করব, যখন ঈদের আনন্দসমুদ্রে অবগাহন করব, যখন স্বজনের সাথে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করবো, তখন ফিলিস্তিনি মুসলমানরা খয়েরখাঁদের মুহুর্মুহু বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিচ্ছে। অসংখ্য মুসলিম নারী তাদের সতীত্ব হারাচ্ছে। কেউ হচ্ছে ইজ্জতহারা, কেউ হচ্ছে স্বজনহারা, স্বামীহারা, সন্তানহারা। দু বছর আগের ঈদুল আজহার সময় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যস্থলে অবস্থিত নাফ নদীতে ভেসে গিয়েছিল অসংখ্য মুসলিমের লাশ। আবার কেউবা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তাদেরকে ‘পুশ ব্যাক’-এর নামে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল মৃত্যুদূতের থাবার দিকে। অবশ্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশে দশ লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য ভাসানচরে হয়েছে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।

এবার আমাদের ঈদের আনন্দের সময়ই সারাদেশে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বানভাসি মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হচ্ছে। তারা ঠিকমতো ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছে না। আবার সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তহবিলকে নিয়ে অনেক ফজার বাপে মজা মারছে বলেও অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় পত্রিকার পাতায়।

এবার আসি কোরবানির মৌলিক কথায়। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে হালাল পশু কোরবানি করার প্রচলন চলে আসছে। যুগে যুগে নবি-রাসুলগণ এবং আল্লাহর নেক বান্দারা রবের প্রতি নিজেদের প্রেমণ্ডভালোবাসা ও আনুগত্য নিবেদনের জন্য কোরবানি করেছেন। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘প্রত্যেক জাতির জন্যই আমি কোরবানির ব্যবস্থা রেখেছি’। (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)

মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সময় এসে বিশেষ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ কোরবানি আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। আল্লাহর নির্দেশে নবি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বীয় প্রিয়পুত্র কিশোর ইসমাঈলকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। তিনি নিজে যেমন সকল ব্যক্তিস্বার্থ তথা পুত্রের ভালোবাসা, মমতা, মায়া সবকিছুকে আল্লাহর ভালোবাসার বিনিময়ে কোরবানি দিয়েছেন, তেমনি ইসমাঈলও কোরবানি হতে শতভাগ প্রস্তুত হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা নবী ইবরাহিমের এহেন আন্তরিকতা, ত্যাগ ও উৎসর্গকে এমনভাবেই কবুল করেছেন যে, সেখান থেকেই প্রেম, ভালোবাসা, আনুগত্য ও উৎসর্গের এই অনুপম আদর্শকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক হিসেবে একই দিবসে বিশ্বমুসলিমকেও কোরবানির আদেশ করেছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, আমরা শুধু কোরবানি করি, কোরবান হই না; পশু জবেহ করি, পশুত্বকে দমন করি না। অথচ এরই নাম কোরবানি। দরবারে ইলাহি থেকে ফরমান শোনানো হচ্ছে- ‘কোরবানির পশুর গোশত কিংবা রক্ত কখনওই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তোমাদের কলবের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭)।

মূলত এটিই কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা যে, আগে কোরবান হও তারপর কোরবানি করো। হজরত ইবরাহিম ও হজরত ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম যখন আল্লাহর আদেশের সামনে কোরবান হয়ে গেলেন এবং পিতা ইবরাহিম পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের গলায় তীক্ষœ ধারালো ছুরি চালালেন তখনই আল্লাহ ‘নিদা’ করে বললেন- ‘থাম হে ইবরাহিম! স্বপ্নকে তো তুমি সত্য করে দেখালে!’ (সুরা আস সাফফাত : আয়াত ১০৫)

এ সময় আল্লাহ তায়ালা প্রধান ফেরেশতা হযরত জিবরাঈলের মাধ্যমে কোরবানি করার জন্য জান্নাত থেকে দুম্বা পাঠান। আর বলেন, ‘এভাবেই আমি মুহসিনীনদের পুরস্কৃত করি।’ (সুরা আস সাফফাত : আয়াত ১০৫)।

উল্লি­খিত আয়াতের তাফসিরে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (র) লিখেছেন, এখানে সন্তানকে কোরবানি করা উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়া। অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও দোয়া-মোনাজাতের পর যে সন্তান আল্লাহ তাকে দান করেছেন, সেই সন্তানের মায়া আল্লাহর আনুগত্যে বাঁধ সাধে কি না- তা প্রত্যক্ষ করাই আল্লাহ তায়ালার মূল উদ্দেশ্য ছিল। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী (রঃ)-ও অনুরূপ উদ্দেশ্য বয়ান করেছেন। তিনি লিখেছেন, এ ঘটনায় পিতার হাতে পুত্রের জবাই উদ্দেশ্য ছিল না; উদ্দেশ্য ছিল পিতৃস্নেহ তথা সেই পার্থিব প্রেমের জবাই, যা কখনও কখনও আল্লাহপ্রেমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সাইয়েদ কুতুব শহিদ (রঃ) তাফসির ফী যিলালিল কুরআনে লিখেছেন, এটি ছিল এক মহাপরীক্ষা। পরীক্ষার মাধ্যমে বান্দাকে কষ্ট দেয়া রবের উদ্দেশ্য নয়; বরং আল্লাহ শুধু দেখতে চান আমার হুকুম পালনে বান্দার মনে কোনো সংশয় দানা বাঁধে কি না। আমার আহ্বান শোনামাত্র বান্দা লাব্বাইক বলে, নাকি কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করে? যদি কোনো সংশয় দানা না বাঁধে, যদি কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করে, তাহলে সেই বান্দাকেও আল্লাহ নবি ইবরাহিমের মতোই সম্মানিত করবেন। তাই ইবরাহিমের ঘটনাটিকে আমাদের জন্য আলোর মিনার হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।

কথা হলো, আমরা কি আল্লাহর হুকুম পালনে সংশয়হীন হতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি প্রেমের সব বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহপ্রেমের বন্ধনকে মজবুত করতে? আমরা আজ সুন্দর সুন্দর মোটাতাজা পশু জবাই করছি বটে। কিন্তু আল্লাহর কাছে যা পৌঁছবে, তা সুন্দর করার চিন্তা করছি কি?। অথচ কিশোর ইসমাঈরের গলায় ছুরি চালানোর পরই নেমে এসেছিল জান্নাতি দুম্বা। সুতরাং আমাদেরও আগে নিজেদের গলায় তথা অদৃশ্য সেই পশুটির গলায় ছুরি চালাতে হবে। এরপরই নেমে আসবে আসমানি মদদ।

বিশ্বমুসলিম আমরা আজ পরাজিত, শত্রুভয়ে ভীত-কম্পিত। কারণ, আমরা আজ রবের আনুগত্য ছেড়ে নফসের গোলামিতে লেগে গেছি। বাইরের পশু জবাই করছি বটে; কিন্তু ভেতরের পশুকে মোটাতাজা করছি। আমরা আজ আমাদের মুসলিম নামের ইতিহাস ও তাৎপর্যও ভুলতে বসেছি। কেন আমাদের মুসলিম বলা হয়? কী এর তাৎপর্য? হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কাবাগৃহ নির্মাণের পর দোয়া করলেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের আপনার অনুগত বানান এবং আমাদের বংশধর থেকে মুসলিম উম্মাহ বা আপনার অনুগত জাতি সৃষ্টি করুন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৮)

প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিকারের মুসলিম হতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি মিল্লাতের পিতা ইবরাহিমের মতো অনুগত হতে, নিজেকে কুরবান করতে? জীবনে একটিবার যদি ইবরাহিমি কোরবানির বাস্তব নমুনা কায়েম করতে পারতাম, যদি ভেতরের পশুটিকেও জবাই করতে পারতাম, তাহলে আবার আমরা বিশ্বটাকে ন্যায়নীতি ও সুবিচার দিয়ে সাজিয়ে তুলতে সক্ষম হতাম।

তাই আসুন, এবারের কোরবানিতে আগে আমরা নিজেরা কোরবান হই, তারপর কোরবানি করি। পশু জবাই করার আগে নিজেদের পশুত্বকে জবাই করি। তাহলেই আমাদের কোরবানি প্রকৃত কোরবানি হবে।

প্রত্যেক বস্তুর দুটি দিক রয়েছে। একটি প্রকাশ্য অপরটি গোপনীয়। এ দিক হতেই কোরবানির দুটি অর্থ রয়েছে। একটি বাহ্যিক আরেকটি অভ্যন্তরীণ। আমরা কোরবানির শুধু বাহ্যিক দিক পশু কোরবানির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। অথচ নিজের অভ্যন্তরীণ মন্দ স্বভাবগুলো যেমন লোভ, লালসা, হিংসা, নফস বা রিপুগুলোকে কোরবানি বা ত্যাগ করতে সচেষ্ট থাকি না।

কোরবানির মূল তাৎপর্য হলো, মাবুদের প্রেমে বান্দা তার যাবতীয় প্রিয় বস্তুগুলো ত্যাগ করবে। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাহে নিজের একমাত্র প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈলের প্রতি ভালোবাসা ও প্রেমের আকর্ষণ ত্যাগ করে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করার জন্য পুত্রকে নিজ হাতে জবাই করার জন্য জমিনে শুইয়ে দিয়ে ছুরি চালাতে উদ্যত হয়েছিলেন। আল্লাহর প্রতি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের অগাধ প্রেম, ভালোবাসা, আকর্ষণ, নির্ভরতা, বিশ্বাস থাকার কারণে আপন পুত্রকে আল্লাহর নামে ত্যাগের মহিমাময় ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয় হয়ে আছে। মাবুদের প্রতি নবি ইবরাহিমের এরকম অসামান্য বিশ্বাসের কারণে ‘তাওয়াক্কুলে ইবরাহিম’-ও বলা হয়।

আমরা কোরবানির মূল তাৎপর্যকে এড়িয়ে এর বাহ্যিক অবস্থার প্রতি বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। অন্যের হক নষ্ট করা, গিবত, অর্থ-লালসা, কামনা-বাসনা, নফসের খায়েশগুলো দূর করে পশু কোরবানি দিলেই আমাদের কোরবানি যথার্থ হবে। আমরা আমাদের ভেতরের পশুত্বকে কোরবানি বা পরিত্যাগ করতে সচেষ্ট না থেকে শুধু বাহ্যিক পশু কোরবানি নিয়ে মহাধুমধামে ব্যস্ত থাকি। যা আদৌ উচিত নয়।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিজেদের নফসের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হওয়াকে জেহাদে আকবর তথা শ্রেষ্ঠ জেহাদ হিসেবে উল্লে­খ করেছেন। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ত্যাগের এ নজরানাটি পৃথিবীর বুকে ধরে রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা হালাল চতুষ্পদ জন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কোরবানি করার রীতি আবশ্যক করেছেন। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, পশু কোরবানির সময়ও আমাদের পরিপূর্ণ ইখলাস থাকে না। আমরা অন্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে গরু কিনে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে অহংবোধ করতে কার্পণ্য করি না। এমনকি কোরবানির গোশত শরিয়তের বিধান মোতাবেক বণ্টন করি না। একভাগ গরিব-দুঃখীদের, এক ভাগ আত্মীয় ও প্রতিবেশীর এবং একভাগ নিজের জন্য রেখে বিতরণ করলে কোরবানি যথার্থ ও সুন্দর হয়।

প্রতি বছর কোরবানি এসে আমাদের চেতনার দুয়ারে করাঘাত করে। কোরবানি আমাদের প্রেরণার দীপশিখা। কোরবানি মানবতাবোধ জাগ্রত করতে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, আমরা যেন নিছক গোশত খাওয়ার জন্যই কোরবানি করি! কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষা আমাদের হৃদয়ের মর্মমূলে পৌঁছতে দিই না।

কোরবানি যেমন আল্লাহপ্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ নজরানা তেমনি এটি ‘মানুষ মানুষের জন্য; জীবন জীবনের জন্য’ প্রেরণা যোগায়। কোরবানির শিক্ষা হিসেবে আমরা গ্রহণ করতে পারি বন্যার্ত, বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কর্মসূচি। গড়ে তুলতে পারি ভেদাভেদমুক্ত সাম্য-মৈত্রীর সোনার দেশ।

লেখক : আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়