প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২২, ০০:০০
পবিত্র কুরআনুল কারীমের নাযিল হওয়া প্রথম পাঁচ আয়াত- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে। পড়, আর তোমার রব মহামহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।’ (সূরা আলাক ১-৫)।
কুরআনুল কারীমের প্রথম শব্দ ‘পড়’। আল্লাহতা’য়ালা পড়ার জন্যে বলেছেন, তবে সেই আল্লাহর নামে পড়তে হবে, যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহতা’য়ালা বলেন, বল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর। (ত্বা-হা, আয়াত : ১১৪)।
তিনি অন্যত্র বলেন, বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? (যুমার, আয়াত : ৯)। আল্লাহ আরও বলেন, যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে বহু মর্যাদায় উন্নত করবেন। (মুজাদালা, আয়াত : ১১)। অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে থাকে। (ফাত্বের ২৮ আয়াত)।
মুআবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনী জ্ঞান দান করেন।” (বুখারী)।
ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কেবল দুজন ব্যক্তি ঈর্ষার পাত্র। সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তাকে তা সৎপথে ব্যয় করার শক্তিও দিয়েছেন। আর সেই লোক যাকে আল্লাহ জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছেন, যার বদৌলতে সে বিচার-ফায়সালা করে থাকে ও তা অপরকে শিক্ষা দেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)।
এখানে ঈর্ষা বলতে অপরের ধন ও জ্ঞান দেখে মনে মনে তা পাওয়ার আকাক্সক্ষা পোষণ করা। সেই সাথে এই কামনা থাকে না যে, অপরের ধ্বংস হয়ে যাক।
আবূ মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে সরল পথ ও জ্ঞান দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা ঐ বৃষ্টিসদৃশ, যা জমিনে পৌঁছে। অতঃপর তার উর্বর অংশ নিজের মধ্যে শোষণ করে। অতঃপর তা ঘাস এবং প্রচুর শাক-সবজি উৎপন্ন করে। এবং তার এক অংশ চাষের অযোগ্য (খাল জমি); যা পানি আটকে রাখে। ফলে আল্লাহ তা’আলা তার দ্বারা মানুষকে উপকৃত করেন। সুতরাং তারা তা হতে পান করে এবং (পশুদেরকে) পান করায়, জমি সেচে ও ফসল ফলায়। তার আর এক অংশ শক্ত সমতল ভূমি; যা না পানি শোষণ করে, না ঘাস উৎপন্ন করে। এই দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির যে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করল এবং আমি যে হিদায়েত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার দ্বারা আল্লাহ তাকে উপকৃত করলেন। সুতরাং সে (নিজেও) শিক্ষা করলো এবং (অপরকেও) শিক্ষা দিলো। আর এই দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তিরও যে এ ব্যাপারে মাথাও উঠালো না এবং আল্লাহর সেই হিদায়েতও গ্রহণ করল না, যা দিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি।” (বুখারী ও মুসলিম)।
সাহাল ইবনে সায়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (খায়বার যুদ্ধের সময়) আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সম্বোধন করে বললেন, “আল্লাহর শপথ! তোমার দ্বারা একটি মানুষকেও যদি আল্লাহ সৎপথ দেখান, তবে তা (আরবের মহামূল্যবান) লাল উটনী অপেক্ষা উত্তম হবে।” (বুখারী-মুসলিম)।
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে; যাতে সে বিদ্যা অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।” (মুসলিম)।
উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি সৎপথের দিকে আহ্বান জানাবে, সে তার অনুসারীদের সমতুল্য নেকীর অধিকারী হবে; তাতে তাদের নেকীর কিছুই হ্রাস পাবে না।” (মুসলিম)।
উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আদম সন্তান যখন মারা যায়, তখন তার তিন প্রকার আমল ছাড়া অন্য সব রকম আমলের ধারা বন্ধ হয়ে যায়; সদকা জারিয়াহ (বহমান দান খয়রাত, মসজিদ নির্মাণ করা, কূপ খনন করে দেয়া ইত্যাদি) অথবা ইলম (জ্ঞান সম্পদ) যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় অথবা সুসন্তান যে তার জন্যে নেক দো’আ করতে থাকে।” (মুসলিম)।
উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “ইহজগৎ অভিশপ্ত, এর মধ্যে যা কিছু আছে সব অভিশপ্ত। তবে মহান আল্লাহর যিকির ও তার সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া (তাঁর আনুগত্য) এবং আলেম অথবা তালিবে ইলমের কথা স্বতন্ত্র।” (তিরমিযী হাসান)।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে লোক জ্ঞানার্জন করার জন্যে বের হয় সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় আছে বলে গণ্য হয়। (ইমাম তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)।
আবূ সা’ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মু’মিনকে কল্যাণ (দ্বীনের জ্ঞান) কখনো তৃপ্তি দিতে পারে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত তার শেষ গন্তব্য জান্নাতে পৌঁছে। (তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)।
আবূ উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আলেমের ফজিলত আবেদের উপর ঠিক সেই রূপ, যে রূপ আমার ফজিলত তোমাদের উপর।” তারপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, আসমান-জমিনের সকল বাসিন্দা এমনকি গর্তের মধ্যে পিঁপড়ে এবং (পানির মধ্যে) মাছ পর্যন্ত মানবমণ্ডলীর শিক্ষাগুরুদের জন্যে মঙ্গল কামনা ও নেক দো’আ করে থাকে।” (তিরমিযী হাসান)।
আবূ দরদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, “যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে, যাতে সে জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফেরেশতাবর্গ তালেবে ইলমের জন্যে তার কাজে প্রসন্ন হয়ে নিজেদের ডানাগুলি বিছিয়ে দেন। অবশ্যই আলেম ব্যক্তির জন্যে আকাশ-পৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। আবেদের উপর আলেমের ফজিলত ঠিক তেমনি, যেমন সমগ্র নক্ষত্রপুঞ্জের উপর পূর্ণিমার চাঁদের ফজিলত। উলামা সম্প্রদায় পরগম্বরদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বরগণ কোনো রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের (দ্বীনী জ্ঞানভা-ারের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পূর্ণ অংশ লাভ করল।” (আবূ দাউদ ও তিরমিযী)।
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যাকে ধর্মীয় জ্ঞান বিষয়ক কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, আর সে (যদি উত্তর না দিয়ে) তা গোপন করে, কিয়ামতের দিন তাকে (জাহান্নামের) আগুনের লাগাম পরানো হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, হাসান)।
উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন কোনো জ্ঞান অর্জন করলো, যার দ্বারা আল্লাহ আয্যা অজাল্লার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, তা সে কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অর্জন করল, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না।” (আবূ দাউদ বিশুদ্ধ সানাদ)।
‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনে ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ লোকদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইলম তুলে নেবেন না; বরং উলামা সম্প্রদায়কে তুলে নেয়ার মাধ্যমে ইলম তুলে নেবেন (অর্থাৎ আলেম দুনিয়া থেকে শেষ হয়ে যাবে।) অবশেষে যখন কোনো আলেম বাকি থাকবে না, তখন জনগণ মূর্খ অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নেতা বানিয়ে নেবে এবং তাদেরকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হবে, আর তারা না জেনে ফতোয়া দেবে, ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)।
পরিশেষে বলবো, আমরা যে কোনো বিষয়ে পারদর্শী হই না কেনো, আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্ম ইসলাম। মুসলমান হিসেবে ইসলামী জ্ঞান আমাদের মধ্যে থাকা ফরজ। ইসলামী শিক্ষা একজন মানুষকে সৎ আদর্শ নিষ্ঠাবান করে গড়ে তুলতে পারে।
মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর, মনোহরখাদী মদিনাবাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।