রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

ই’তিকাফের তাৎপর্য ও ফজিলত
অনলাইন ডেস্ক

আল্লাহর বাণী, ‘ওয়া আনতুম আকিফুনা ফিল মাসাজিদে’। অর্থাৎ ‘আর তোমরা সালাতের নির্দিষ্ট স্থানসমূহে অবস্থান করো’। (সূরা আল বাকারা, আয়াত : ১৮৭)। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর আয়াতের এ অংশটুকু নাযিলের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনও ইতিকাফ ছাড়েননি। (তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ) হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সাঃ) প্রতি রমজানের দশদিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের বছরে তিনি বিশদিন ই’তিকাফ করেন। (বুখারী, আবু দাউদ)

ই’তিকাফ শব্দের অর্থ অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোনো স্থানে বদ্ধ হয়ে অবস্থান করা। শরীয়তের পরিভাষায়, রমজান মাসের শেষ দশদিন অথবা অন্য কোনোদিন জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিছিন্ন হয়ে পুরুষদের জন্যে যেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সাথে নিয়মিত আদায় হয় এমন মসজিদে আল্লাহর ইবাদাতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলে। আবার কোনো মহিলার জন্যে নিজ ঘরে সালাতের স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফের সময়সীমা হলো রমজানের শেষ দশকে অর্থাৎ বিশ রমজানের সূর্যঅস্ত যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়।

পৃথিবীতে মানুষ নানা ব্যস্ততার মধ্যে জীবনযাপন করে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি, সামাজিক যাবতীয় কাজকর্ম থেকে কিছুদিনের জন্যে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো ই’তিকাফ। মানুষ এটির মাধ্যমে সকল চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে একমাত্র আল্লাহর চিন্তায় নিমগ্ন হওয়ার অবারিত সুযোগ পায়। সে প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহকে ধ্যান করে, তাঁকে গভীরভাবে অনুভব করে।

ই’তিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ই’তিকাফের উল্লেখ রয়েছে, ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন আমি কাবা গৃহকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তারস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানকে সালাতের স্থানরুপে গ্রহণ কর এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আমার গৃহ তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীদের জন্যে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম। (সুরা বাকারা : ১২৫)। উক্ত আয়াত থেকে প্রমাণ হয় যে, ই’তিকাফের বিধান নতুন নয়। কাবা গৃহ নির্মাণের সময় হতে ই’তিকাফের বিধান চলে আসছে। উক্ত আয়াত থেকে তাওয়াফ ও ই’তিকাফ সমপর্যায়ের কাজ বলে প্রতীয়মান হয়। ইসলামী শরীয়তে ই’তিকাফ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কোথায় ইতিকাফ করবেন

ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী এরপর মসজিদে আকসা। এরপর জুম’আ মসজিদ, এরপর যে মসজিদে বেশি মুসল্লি সালাত আদায় করে থাকে। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেন, ইতিকাফ সহীহ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সঙ্গে আদায় করা হয়। (হিদায়া)। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেনো মসজিদে হারামে ইতিকাফ আদায় করে। এটি সওয়াবের ও জামায়াতের দিক থেকে সর্বোত্তম।

ই’তিকাফের ফজিলতের ব্যাপারে ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদিসে মহানবী (সাঃ) ই’তিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, ই’তিকাফকারী গুনাহর অবিচলতা থেকে মুক্ত থাকে এবং তার জন্যে সে যে সমস্ত নেকী লেখা হয় যেমনটি সেসব পূণ্য কাজ যারা করে তাদের জন্যে লেখা হয়। (মিশকাত, ইবনে মাজাহ)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি ও দোজখের মধ্যে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করেন। (তাবরানি ও হাকেম)। প্রত্যেক খন্দক পূর্ব ও পশ্চিমের দূরুত্বের চেয়ে আরো বহু দূর। আলী বিন হোসাইন (রাঃ) নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের দশদিন ইতিকাফ করে, তা দুই হজ ও দুই ওমরার সমান। (বায়হাকী)।

ইতিকাফকারীদের জন্যে রয়েছে এমন অশেষ পুরস্কারের ঘোষণা। মহানবী (সাঃ) নিজে ই’তিকাফ করছেন এবং ই’তিকাফ করার জন্যে সাহাবী কিরামদের উৎসাহিত করেছেন। আর একটি হাদিসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘মসজিদ মুত্তাকীদের ঘর। যে ইবাদাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে আল্লাহ তাঁর প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার করে বেহেশত পৌঁছাবার জিম্মাদার হবেন।’ ইতিকাফকারী আল্লাহর ঘর মসজিদের মেহমান।

ই’তিকাফ তিন প্রকার

ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব। মানতের ই’তিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বললো যে, আমার অমুক কাজ সমাধান হলে আমি একদিন ই’তিকাফ করবো। অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বললো, আমি একদিন অবশ্যই ই’তিকাফ করব। এমন ই’তিকাফ করা ওয়াজিব তথা বাধ্যতামূলক। উল্লেখ্য যে, ওয়াজিব ই’তিকাফের জন্যে রোজা রাখা শর্ত। রোজা না রেখে ই’তিকাফ করলে ওয়াজিব ই’তিকাফ শুদ্ধ হবে না। রমজান মাসের শেষ দশদিন ই’তিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। মসজিদের মহল্লাবাসীদের পক্ষ থেকে কোনও একজন বা একাধিক ব্যক্তি এ ই’তিকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। এই ই’তিকাফের ফলে লাইলাতুল কদর তালাশ করার মোক্ষম সময়। কোনো সুন্নত ই’তিকাফ ভঙ্গ করলেও তা ওয়াজিব হয়ে যাবে। নফল ইতিকাফ সাধারণভাবে যে কোনো সময় ই’তিকাফ করা নফল। নফল ই’তিকাফের কোনো সময় দিন-ক্ষণ নেই। যতোক্ষণ বা যতোদিন ইচ্ছা এই ই’তিকাফ করা যায়। এমনকি তা সারা জীবনের জন্যেও হতে পারে। অবশ্য অল্প সময়ের ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মতে, একদিনের কমে ই’তিকাফ জায়েজ নয়। তবে ইমাম মুহাম্মদ (রহঃ)-এর মতে, অল্প সময়ের জন্যেও ই’তিকাফ হতে পারে।

ই’তিকাফের শর্ত

মুসলমান হওয়া, পাগল না হওয়া, বালেগ হওয়া, নিয়ত করা, ফরজ গোসলসহ হায়েজ-নেফাজ থেকে পবিত্র হওয়া ও রোজা রাখা। মসজিদে ইতিকাফ করা। ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মতে, জামে মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মতে, যে মসজিদে জামাআত সহকারে সালাত হয় না, সে মসজিদে ইতিকাফ জায়েজ নেই।

ইতিকাফকারীর করণীয় ও বর্জনীয়

ইতিকাফ অবস্থায় ইতিাকাফকারী প্র¯্রাব-পায়খানার জন্যে মসজিদের বাইরে যেতে পারবেন। ফরজ গোসলের জন্যে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে। খানা খাওয়ার জন্যে বের হওয়া যাবে যদি মসজিদে খানা নিয়ে আসার মতো লোক না থাকে। জুমআর সালাতের জন্যে বের হওয়া যাবে যদি সে মসজিদে শুধু পাঞ্জেগানা সালাতের ব্যবস্থা থাকে। যে কোনো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বা শরীয়তের প্রয়োজনে মসজিদে বাইরে যাওয়া জায়েজ। যদি কোথাও আগুন লেগে যায় অথবা কেউ পানিতে পড়ে যায় অথবা কাউকে মেরে ফেলা হয় অথবা মসজিদ পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি তাহলে ইতিকাফের স্থান থেকে বের হয়ে পড়া জরুরি। ইতিকাফ অবস্থায় কাউকে দীনের বিষয়ে অথবা চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দেয়া জায়েজ। ইতিকাফের স্থান থেকে শরীয়তের অনুমতি অনুযায়ী বাইরে গেলেও সর্বাবস্থায় প্রয়োজন পূরণ হওয়া মাত্র বিলম্ব না করে ইতিকাফের স্থানে ফিরে আসতে হবে। ইতিকাফকারী বিনা কারণে, অযথা অল্প সময়ের জন্যেও মসজিদের বাইরে থাকা জায়েজ নয়। (শরহে আল বেদায়া)।

ইতিকাফ অবস্থায় দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরুহে তাহরীমী বা হারামের কাছাকাছি। যেমন বিনা প্রয়োজনে কেনা-বেচা বা ব্যবসা-সংক্রান্ত কোনো কাজ। মোবাইলে কল করা বা কল রিসিভ করা মাকরুহ। দৈনিক পত্রিকা পড়া, রেডিওতে খবর শোনা জায়েজ নাই। ই’তিকাফের সময় সালাত আদায়, কুরআন তেলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, ইলমে দীন শিক্ষা করা, সীরাতুন্নবী অধ্যয়ন করা, দুরূদ শরীফ ও জিকির-আজকার, তাসবীহ-তাহলীলসহ ইসলামী পুস্তক অধ্যয়ন ও আলোচনা করা জায়েজ।

মসজিদের ভেতরে ইতিকাফকারীদের নিয়ে ওয়াজ-নসীহত ও দীনের তাবলীগের কাজে নিয়োজিত থাকা। দীনি ইলম শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেয়া কিংবা অন্য কোনো ইবাদাতে সময় কাটানো উচিত। এক্ষেত্রে নফল সালাতও আদায় করা যেতে পারে। দীনের মাসআলা ও ইলমের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা, দীন সম্পর্কিত গবেষণা ও রচনার কাজে লিপ্ত থাকা। শুধু চুপ করে বসে থাকা ঠিক না। যে সব কথায় গোনাহও নেই এবং সওয়াব নেই সেটি না বলাই ভালো। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী)। অবশ্য যে কাজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেটি করা যাবে। যেমন ঘরে খাবার নেই, সে ব্যতীত খরিদ করার মতো লোকও নেই। এ অবস্থায় দোকান থেকে মাল খরিদ করে বাসায় দেয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, রমজানের দশদিন ইতিকাফ অবস্থায় এ সমস্ত প্রয়োজন হতেই পারে। এক্ষেত্রে মসজিদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ইতিকাফকারীদের জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেয়া দরকার। ইতিকাফকারী এ সময়ে দুনিয়ার যাবতীয় চিন্তামুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ তা’য়ালার সান্নিধ্য হাসিলের অমোঘ নিয়ামাত লাভে ধন্য হন। যেনো তারা ভালোভাবে ইতিকাফ পালন করতে পারে। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে নির্দেশ দিয়েছিলেন কাবা ঘরকে তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীদের জন্যে পবিত্র রাখতে।

ই’তিকাফ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের উপর জরুরি। মহিলারাও নিজেদের ঘরে সালাতের নির্দিষ্ট স্থানে ই’তিকাফ করতে পারে, তবে তার স্বামীর অনুমতি নেয়া জরুরি। তারা ইতিকাফ করা অবস্থায় নির্দেশ ও উপদেশের মাধ্যমে ঘর-কন্যার কাজে সাহায্য করতেও পারবে। মসজিদে ই’তিকাফ করা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করা নিষেধ। কোনো পীড়িত ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া যাবে না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার মতো মানবিক প্রয়োজন ছাড়া ই’তিকাফরত ব্যক্তির মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ নয়।

ই’তিকাফের জন্যে নিয়ত করা জরুরি। ইতিকাফ মানুষের উপর নৈতিক ও আধ্যাত্বিক প্রভাব সৃষ্টি করে। যা তাকে আল্লাহর পথে চলতে সাহায্য করে। ইতিকাফের মাধ্যমে মুসলিম জাতি একটি সুন্দর প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারে। ইতিকাফের মাধ্যমে মুসলিম জাতি পরিশুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে ই’তিকাফের মাধ্যমে পরিপূর্ণ সওয়াব প্রদানের তাওফিক দান করুন। আমিন।

ড. মোঃ আব্দুল গাফফার মল্লিক : প্রিন্সিপাল, পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়